করোনাভাইরাস বনাম ধর্ষণভাইরাস

Published: 10 October 2020

।। মোফাজ্জল করিম।।

করোনা এখন নায়ক থেকে মহানায়ক হয়ে উঠেছে। বাংলাদেশে মার্চ মাসে মুক্তিপ্রাপ্ত তার অভিনীত ‘অপারেশন কিল হিউম্যান’ ছায়াছবিটি এখন শুধু সুপারহিটই নয়, আজকালকার ভাষায় সুপার-ডুপার হিট। বক্স অফিসের পূর্বের সব রেকর্ড ভেঙ্গে টুকরো টুকরো করে দোর্দণ্ড প্রতাপে এগিয়ে চলেছে এই হালাকু খান। বাংলাদেশে রোজ কমসে কম ৪০/৫০টি মানবসন্তান না হলে তার প্রাতরাশই হয় না। খবরের কাগজ খুললেই তার খবর। আর টিভির পর্দায় তার তাণ্ডবের বিস্তারিত বিবরণ না থাকলে পুরো সংবাদ পরিবেশনই কেমন যেন পানসে মনে হয়।

হ্যাঁ, সারা বিশ্বে আলোড়ন নয়, রীতিমত কিয়ামত সৃষ্টি করা এই বিপর্যয়কে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়েছেন এই গ্রহেরই একটি মাত্র মানুষ, যাঁকে তাঁর অনুসারীরা নিশ্চয়ই বলবেন মহামানব। (আর অন্যরা বোধ করি বলবেন মহাদানব!) পাঠক, নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন তিনি আর কেউ নন, তিনি ক্ষমতার দর্পে ধরাকে সরা জ্ঞান করা মহানায়ক (কেউ আবার ভুলে খলনায়ক বলে বসবেন না, বললে কিন্তু খবর হয়ে যেতে পারেন) মার্কিন প্রেসিডেন্ট জনাব ডোনাল্ড ট্রাম্প। তিনি মহাভারতের দুষ্ট চরিত্র দুর্যোধনের মত—যিনি প্রকাশ্য সভায় পঞ্চপাণ্ডবপত্নী দ্রৌপদীর সম্মুখেই নিজের উরুদেশ প্রদর্শিত করে তাঁকে অপমান করেছিলেন—দম্ভভরে বললেন : কভিড সুন্দরী, তুমি মোরে কী দেখাও ভয়/ও ভয়ে কম্পিত নয় আমার হৃদয়। বলেই দেশবাসীর উদ্দেশে উদাত্ত আহ্বান জানালেন, প্রিয় দেশবাসী, তোমরাও আমার মত শতকরা এক শ ভাগ করোনা পজিটিভ রেজাল্ট হলেও মাস্ক-ফাস্ক খুলে ঘরের বাইরে বেরিয়ে আসো, আমার সঙ্গে গান ধরো : যাব না, যাব না, যাব না ঘরে, বাহিরে করেছে পাগল মোরে। (ডাক্তার বলবে কী, নিজেই আত্মস্বীকৃত পাগল!) তবে কুরু-পাণ্ডব যুদ্ধের শেষ অঙ্কে নিজের প্রতিজ্ঞা রক্ষা করে দ্বিতীয় পাণ্ডব ভীম কিন্তু তাঁর গদার আঘাতে দুর্যোধনের উরু ভেঙ্গে দিয়েছিলেন। জানি না ট্রাম্প সাহেবের সে কথা জানা আছে কিনা। সেই প্রাচীন বাংলা প্রবচন ‘অতি দর্পে হত লঙ্কা’ও তাঁর জানার কথা না। তবে যেভাবে করোনা তাঁর পিছু নিয়েছে তাতে ভয় হয়, গড ফরবিড, তাঁর না আবার কিছু একটা হয়ে যায়।

তা সেই মহারাষ্ট্রপতি মহোদয় (না, না, ভারতের মহারাষ্ট্র রাজ্যের রাজ্যপাল নন, মহা মহারাষ্ট্রপতি উপাধি ট্রাম্প মহোদয় গৌরবার্থে পেতেই পারেন) তাঁর দেশের ত্রিশ কোটি মানুষের জীবনে যে বিপর্যয় ডেকে আনছেন সেদিকে তাঁর মনে হয় খেয়াল নেই। খেয়াল না থাকারই কথা। কারণ যে দেশে বিরতিহীনভাবে হাজার হাজার লোক মারা যাচ্ছে কভিডাক্রান্ত হয়ে, সে দেশে এই শীর্ষ ব্যক্তিটির আচরণে বিরক্ত হয়ে তাঁরই চিকিৎসক বলেছেন, এটা নিছক ‘পাগলামি’ ছাড়া আর কিছু না। বলে কী? একজন চিকিৎসক হয়ে বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর ব্যক্তিটি, যিনি কিনা তাঁরই দেশের প্রেসিডেন্ট, তাঁকে বলে পাগল! এই মন্তব্য শুনে সে দেশের ভোটাররা যদি নভেম্বর ৩ তারিখের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে ট্রাম্পের ওপর থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়, তখন? যদি বলে, পাগলে কী না বলে, ছাগলে কী না খায়, তখন? (অবশ্য ভোটে সূক্ষ্ম কারচুপির নজির ওই দেশেও আছে বলে জনশ্রুতি আছে। আর, পাগল আর যাই হোক মিথ্যা বলে না, ছাগলও সব কিছু খেলেও ঘুষ খায় বলে শোনা যায় না। ট্রাম্প সাহেবের মিথ্যাকথনের রেকর্ডও নাকি আজতক কোনো রাজনীতিবিদ ‘ওভার ট্রাম্প’ করতে পারেননি।)

শেখ সাদীকে (নাকি মধ্যপ্রাচ্যের লোকমান্য পণ্ডিত লোকমান হাকিমকে?) এক ব্যক্তি যখন জিজ্ঞেস করেছিল, আচ্ছা, আপনি এত আদব-কায়দা শিখলেন কার কাছ থেকে? সেই মহাপুরুষ নাকি বলেছিলেন : বেআদবের কাছ থেকে। প্রশ্নকর্তা জানতে চাইল, সেটা কী রকম? উত্তরে বলা হলো : বেআদব যা বলে বা করে আমি তা বলি না, বা করি না।… করোনাভাইরাস সম্বন্ধে (এবং আরো অনেক কিছু সম্বন্ধেও) জনাব ট্রাম্প যা বলেন বা করেন তাঁর দেশের লোক এবং বিশ্ববাসী তা না বলে বা না করে উল্টোটা বললে বা করলেই বিশ্ব বিপদমুক্ত থাকবে বলে অনেকেই মনে করেন। সে যাই হোক, আপাতত এই ‘খ্যাপা বাউলের’ আশু রোগমুক্তি একজন মানুষ হিসেবে, বিশেষ করে শান্তিপ্রিয় বাংলাদেশের একজন নাগরিক হিসেবে, আমি অবশ্যই কামনা করি।

২.
যেই বলেছি ‘শান্তিপ্রিয় বাংলাদেশ’, অমনি দেখতে পাচ্ছি অনেকেই হাঁ হাঁ রব তুলে আমার দিকে ছুটে আসছেন। ‘হেই মিয়া আপনি কি তালকানা, না দলকানা? রোজ সকালে খবরের কাগজগুলো যখন খুন-জখম-ধর্ষণ-অপহরণ-রাহাজানি-ডাকাতি-জুয়াচুরি ইত্যাদির বয়ানসহ রক্তরঞ্জিত চেহারা নিয়ে আপনার আমার দরজায় এসে হাজির হয়, যখন টিভি খুললেই খুন-ধর্ষণের রগরগে দগদগে ছবি দেখে আবালবৃদ্ধবনিতা সবার প্রাণটা হলকুমের কাছে উঠে আসে তখনও কি এদেশটাকে আপনি শান্তিপ্রিয় বাংলাদেশ বলবেন? নিশ্চয়ই কিছুসংখ্যক তালকানা-দলকানা লোক ছাড়া এখন আর এদেশকে কেউ শান্তিপ্রিয় দেশের তকমা দেবে না। জবাবে আমি বলব, তারপরও আমি মনে করি বাংলাদেশ শান্তিপ্রিয়। এদেশের শতকরা পঁচানব্বই জন মানুষ শান্তিপ্রিয়। তারা সমাজে অশান্তি সৃষ্টি না করে সত্ভাবে নির্বিবাদে জীবন যাপন করতে চায়। সমাজে খুন-জখম-ধর্ষণ-দুর্নীতি করে শতকরা কয়জন? যারা দুর্নীতিবাজ-লম্পট-লুটেরা তাদের কারণে কলঙ্ক লেপিত হচ্ছে ‘আমার সোনার বাংলা’র ললাটে। বাংলা মায়ের অমলধবল অঞ্চলে যারা মালিন্যের ছোপ লাগায় তারা কারা? তারা কি আপামর জনগোষ্ঠীর প্রতিভূ? এদের কারণে বিশ্বদরবারে আজ ত্রিশ লক্ষ শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত প্রাণের দেশের মাথা হেঁট হতে যাচ্ছে, কিন্তু কেন? কাদের আশ্রয়ে-প্রশ্রয়ে এরা এমন ধর্ষণের দিগ্বিজয়ে বের হয়ে পড়ল? এরা কি এতই প্রবল পরাক্রান্ত যে তাদের সম্মুখে পুরো রাষ্ট্রযন্ত্র অক্ষম অসহায়? এরা কি আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট? না, চেঙ্গিস খান? নিশ্চয়ই না। এমনটি মনে করার কোনো কারণ নেই। এদের দমন করার জন্য দেশের ১৭/১৮ কোটি মানুষ ঐক্যবদ্ধ হয়ে আওয়াজ তুলছে : ধর্ষকের ফাঁসি চাই, বাংলার মাটিতে ধর্ষকের স্থান নাই। তা হলে কেন এদের নির্মূল করা যাচ্ছে না? এর উত্তর আপনাদের জানা আছে কিনা জানি না, আমার অন্তত জানা নেই। আবার কখনো কখনো মনে হয় উত্তরটা জানি, তবে ঝেড়ে কাশতে গেলে যে সাহসের দরকার সে সাহস আমার বা আমার মত অনেকেরই নেই।

সব কিছুরই একটা সীমা আছে, সীমা থাকা বাঞ্ছনীয়। খুন-জখম-ধর্ষণ বা এ ধরনের জঘন্য অপরাধের বেলায়ও সেকথা প্রযোজ্য। কিন্তু গত কয়েক সপ্তাহ ধরে সিলেট-বেগমগঞ্জ-লক্ষ্মীপুর প্রভৃতি জায়গায় যেসব মধ্যযুগীয় পৈশাচিক বর্বরতা আমরা প্রত্যক্ষ করেছি তা এক কথায় নজিরবিহীন। এগুলোর প্রতি ঘৃণা ও নিন্দা জানাবার ভাষা আমাদের নেই। আগে কোনো এক ব্যক্তির অপরাধ অর্থাৎ একজন ধর্ষকামী পুরুষ কর্তৃক একজন নারীকে ধর্ষণের কথা শোনা যেত। ইদানীং এটা রূপ নিয়েছে ‘গ্যাং রেপ’-এর। তার মানে কি এসব দুর্বৃত্ত এখন সংগঠিত হয়ে নতুন নতুন কৌশল উদ্ভাবন করছে? কীভাবে কোথায় কোন ভিকটিমকে আক্রমণ করতে হবে, নির্যাতনের বীভৎসতাকে কী করে আরো গভীরভাবে ফুটিয়ে তুলে তা ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দিয়ে পৈশাচিক সুখানুভূতি লাভ করা যায়, আইনের চোখে ধুলো দেওয়ার জন্য কাকে কী প্রক্রিয়ায় কব্জা করা যায়, ইত্যাদি এন্তার ফন্দি-ফিকির বের করার জন্য এমন যৌথ পশুখামার গড়ে তোলা হচ্ছে সদস্যদের মামা-চাচার আশীর্বাদপুষ্ট হয়ে। এরা এখন এমন আসুরিক শক্তি অর্জন করেছে যে সমাজের আর দশটা নিরীহ সজ্জন এদের বিরুদ্ধে টুঁ শব্দটিও করতে ভয় পায়। এসব অসহায় মানুষ সব সময় ভয়ে সিঁটকে থাকে কখন না তার পরিবার, বিশেষ করে তার বৌ-ঝিদের ওপর মুসিবত নেমে আসে।

এসব অপরাধীর মধ্যে যৌন-বিকৃতি এমনভাবে ছড়িয়ে পড়েছে যে ইদানীং দেখা যাচ্ছে ৫/৬ বছরের শিশু বা সত্তরোর্ধ্ব বৃদ্ধাও এদের লালসার আগুন থেকে রেহাই পাচ্ছে না। গণধর্ষণ বা গ্যাং রেপ ও ধর্ষণ-নির্যাতনের ছবি কোটি কোটি মানুষের মধ্যে ইন্টারনেটের মাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়া, শিশু-বৃদ্ধা-মানসিক প্রতিবন্ধীদের নিপীড়ন ইত্যাদি এই পুরো অপরাধটিতে নতুন মাত্রা (ডাইমেনশন) যোগ করেছে। এসব নারকীয় কর্মকাণ্ডে অপরাধীরা এক ধরনের পৈশাচিক আনন্দলাভ করে। অপরাধবিজ্ঞানী বা মনোবিজ্ঞানীরা এর কারণ নানাভাবে ব্যাখ্যা করে থাকেন, যার ভেতর অপরাধীর পরিবার, পরিবেশ, শিক্ষাদীক্ষা ইত্যাদি নানা বিষয় প্রাধান্য পেয়ে থাকে। তবে সাম্প্রতিককালে যে বিষয়টি সমাজের সব শ্রেণি ও স্তরের মানুষকে বিশেষভাবে ভাবিত করে তুলেছে তা হচ্ছে বিচারহীনতা ও আইনের শাসনের অভাব। একজন ধর্ষকের বিরুদ্ধে কেউ সাহস করে মামলা করলে অনেক সময় দেখা যায় অপরাধী দিব্যি গায়ে ফুঁ দিয়ে বেড়াচ্ছে, তার কিছুই হচ্ছে না, বরং পরিণতিতে বাদীকে নানান ধরনের হুমকি-ধমকি ও হয়রানির শিকার হতে হচ্ছে। কখনো কখনো তা ঘরবাড়িতে অগ্নিসংযোগ এবং বাদী বা তার পরিবারের লোকজনকে হত্যা পর্যন্ত গড়ায়। আর লজ্জায় এই পৃথিবীর কোথাও মুখ লুকাবার জায়গা না পেয়ে ভিকটিমের আত্মহত্যা তো প্রায়শই ঘটতে দেখা যায়।

৩.
এবার আসা যাক এই হিংস্র পশুগুলোকে খাঁচাবন্দি করার জন্য আমরা কী করছি সে আলোচনায়। পাড়ায় যখন একটা পাগলা কুকুরের উৎপাত শুরু হয়, যখন সেই সারমেয় পুঙ্গব ডানে-বাঁয়ে যাকে পায় তাকে কামড়ায়, মানুষ-গরু-ছাগল কেউই বাদ যায় না, তখন আমরা কী করি? দৌড়ে থানায় যাই ওসি সাহেবকে খবর দিতে? ইউএনও সাহেবের কাছে দরখাস্ত দিতে ছুটে যাই? হয়ত প্রয়োজনবোধে একসময় এসব পদক্ষেপ নিই। কিন্তু সবার আগে আমরা পাড়ার বাসিন্দারা সবাই মিলে লাঠিসোঁটা নিয়ে কুকুরটাকে পিটিয়ে শায়েস্তা করতে অগ্রসর হই। এবং বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ওতেই কাজ হয়। বড়জোর যার বাড়িতে একটা বন্দুক আছে তিনি হয়ত একটা গুলি খরচ করেন ওই উপদ্রবটাকে ঠাণ্ডা করতে। আর সারা শহরে যদি পাগলা কুকুরের বেসামাল উৎপাত শুরু হয় তখন হয়ত প্রশাসনের বা স্থানীয় মেয়র-কাউন্সিলর-ইউপি চেয়ারম্যানের সাহায্য চাওয়া হয়। ধর্ষক নামক পাগলা কুকুর দমনের জন্য সংশ্লিষ্ট এলাকার নাগরিক তৎপরতা কিন্তু এতদিন চোখে পড়ার মত ছিল না। উল্টো বরং কাউকে কাউকে ব্যক্তিগত আক্রোশ বা পারিবারিক দ্বন্দ্বের কারণে ভিকটিম মেয়েটার দোষত্রুটি ও চরিত্রহননে লিপ্ত হতে দেখা গেছে। সিলেটের ঘটনার পর অবশ্য পুরো সমাজকে এখন আন্দোলিত হতে দেখা যাচ্ছে। সেখানেও আবার ঐতিহ্যগতভাবে ‘লিড’ দিয়েছে তরুণসমাজ—স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা। তাদের পাশে দাঁড়িয়েছে বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন। এমন কি যাদের দিকে অভিযোগের তির ছুড়ে তাদের বিব্রতকর অবস্থায় ফেলে দেওয়া হয়েছে সেই ছাত্রলীগও মিটিং মিছিল করছে, তীব্র ভাষায় নিন্দা জানাচ্ছে, মৃত্যুদণ্ড দাবি করছে অপরাধীদের। এটা আমি বলব শুভলক্ষণ। এরপর আশা করা যায় এ ধরনের ঘটনা ঘটলে সবচেয়ে আগে রাজপথে নেমে আসবে স্থানীয় এলাকাবাসী। তা না হলে ‘যার বিয়ে তার খোঁজ নেই, পাড়াপড়শির ঘুম নেই’ অবস্থায় আর যাই হোক উদ্বাহক্রিয়া সম্পন্ন হবে না।

এসব বিষয়ে সবার মনে একটা প্রশ্ন সারাক্ষণ ঘুরপাক খেতে থাকে। ধর্ষণের মত জঘন্য অপরাধ দমনে রাষ্ট্র কী করছে? যারা অপরাধী তারা কি রাষ্ট্রীয় মদদে এরূপ আকাম-কুকাম চালিয়ে যাচ্ছে? এর উত্তরে আমার মাঠ প্রশাসনের দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা থেকে বলব, কোনো সরকারই এসব কুকীর্তিতে সায় দেয় না। আসলে সায় দেওয়ার প্রশ্নই আসে না। সরকার কি জানে না, এসব অপকর্মে সায় দেওয়া মানে নিজেদের রাজনীতির পায়ে কুড়াল মারা? তা হলে অব্যাহতভাবে একের পর এক এসব ঘটনা সংঘটিত হয় কীভাবে? এর জবাবে আমি বলব, উচ্চ পর্যায়ের দৃঢ় ইচ্ছা এবং কঠোর হুঁশিয়ারি-আদেশ-নির্দেশ থাকা সত্ত্বেও মাঠ পর্যায়ে কিছু কিছু নেতা নিজের ভাই-ভাতিজা ও রাজনৈতিক টেণ্ডলকে রক্ষা করার ‘পবিত্র’ দায়িত্ব অম্লান বদনে নিজেদের স্কন্ধে তুলে নেন। তাঁদের প্রতিক্রিয়া হয় অনেকটা এই রকম : এই হারামজাদা, আবার কী কুকাম কইরা আইস্যা আমার পায়ে হুমড়ি খাইয়া পড়ছস? তুই হাতে গোনা কয়টা ক্যাডারের নেতা অইছস দেইখ্যা কি মনে করছস যার-তার বৌ-ঝিরে লইয়া টানাটানি করার লাইসেন্স তোরে আমরা দিয়া দিছি? ভাগ এখান থাইকা বদমাশের বাচ্চা। অহন জেলের ভাত খা গিয়া বাকি জীবন। ক্যাডার তখন নাক-কান মলে কসম-কিরা করে পার পেয়ে যায় : আর কুনুদিন ওই পথে যামু না লীডার। ওখানেই রফা হয়ে যায়। বিনিময়ে লীডারের যত উল্টোসিধা কায়-কারবার আছে তার সব কিছুর আঞ্জাম দেয় ওই দুষ্কৃতকারী।

তবে হঠাৎ আলোর ঝলকানির মত কখনো কখনো এর ব্যতিক্রমও দেখা যায়। যেমন সিলেটের সাম্প্রতিক কলঙ্কজনক ঘটনার সঙ্গে সঙ্গে ঘটনাস্থলের নিকটবর্তী একজন আওয়ামী নেতা যেভাবে সম্পূর্ণ বিবেকের তাগিদে এগিয়ে এসে ভিকটিম মেয়েটি, তার স্বামী ও স্থানীয় পুলিশ কর্তৃপক্ষের দিকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন তা নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয় এবং অবশ্যই অনুকরণীয়। ভদ্রলোক ব্যাপারটি দলীয় নয়, সম্পূর্ণ মানবিক ও আইনি দৃষ্টিকোণ থেকে দেখেছেন। এ ধরনের নাগরিক দায়িত্বপালন দলমত নির্বিশেষে সকলের কাছ থেকে প্রত্যাশিত। অপরাধীরা দলীয় ‘শেল্টার’ না পেলে সব ধরনের অপরাধ কমে আসতে বাধ্য। সেই সঙ্গে দেশে যে বিচারহীনতার সংস্কৃতির কথা শোনা যায় তা থেকে অবশ্যই বেরিয়ে আসতে হবে।

আমরা পাকিস্তান ও বাংলাদেশ উভয় আমলে যারা সরকারি চাকরি করেছি, বিশেষ করে মাঠ পর্যায়ে, তারা নির্দ্বিধায় স্বীকার করব, আমাদের সময়ে আইন-কানুনের প্রয়োগ ও বিচারকার্যে কোনো ধরনের হস্তক্ষেপ ছিল না বললেই চলে। স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু এই নীতি কঠোরভাবে মেনে চলেছেন এবং তাঁর সকল নেতাকর্মীকে তা পালন করতে বাধ্য করেছেন। ফলে প্রশাসনকে লেজুড়বৃত্তি করতে হতো না। তখন অকুতোভয়ে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে সচেষ্ট থাকার পরিবেশ ছিল। আমি বা আমার ওই সময়ের সহকর্মীরা মাথা উঁচু করে ন্যায়নীতি মেনে চলে চাকরি করেছি জনগণের কল্যাণের জন্য, কারো ব্যক্তিগত বা দলগত স্বার্থসিদ্ধির জন্য নয়। বঙ্গবন্ধুর প্রদর্শিত সেই পথ থেকে নব্বইয়ের দশকে প্রশাসন কেন বিচ্যুত হয়ে পড়ল তা গুরুত্বসহকারে দেখা দরকার বলে আমি মনে করি। কেন নব্বইয়ের দশকের শেষার্ধ্বে ‘ধর্ষণের সেঞ্চুরি করেছি’ বলে বিজয়োল্লাসে মত্ত জাহাঙ্গীরনগরের সেই বিশ্বরেকর্ড গড়া ছাত্রলীগ নেতাটির বিচার হলো না, কেন সিলেটের অনুপম শৈল্পিক স্থাপনা এমসি কলেজ ছাত্রাবাসটি পুড়িয়ে ছাই করে দেওয়ার পরও আত্মস্বীকৃত অপরাধীরা পার পেয়ে গেল, ত্বকী-তনু-সাগর-রুনি হত্যার বিচার কেন বছরের পর বছর ধরে হচ্ছে না—এসব বিষয়ে জাতিকে অন্ধকারে না রেখে সরকার একটু আলো জ্বালালে আখেরে সরকারই লাভবান হবে বলে আমি মনে করি।

প্রাসঙ্গিক আরো দু’একটি কথা না বললে পরে নিজের কাছেই জবাবদিহি করতে হবে বলে উল্লেখ করতে চাই। প্রথমেই বলব, রাজনৈতিক সদিচ্ছার কথা। এ ব্যাপারে কি সবগুলো রাজনৈতিক দল একটি যৌথ ইশতেহারে স্বাক্ষর করে ঘোষণা দিতে পারে না, আমরা সবাই বাংলাদেশ থেকে ধর্ষণ নামক ভাইরাসটিকে চিরতরে নির্মূল করতে চাই। ধর্ষণকারী যে দলেরই হোক তার বিচার করে তাকে সর্বোচ্চ শাস্তি দেওয়ার পক্ষে আমরা সবাই ঐকমত্য প্রকাশ করছি। দ্বিতীয়ত, ধর্ষণের তদন্ত ও বিচারকার্য হতে হবে দ্রুততম সময়ের মধ্যে। তার জন্য প্রচলিত আইনের/বিধির সংশোধন-সংযোজন করতে হবে। তৃতীয়ত, এবং আমি মনে করি এটা এখন সময়ের দাবি—ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি জেল-জরিমানা-যাবজ্জীবন কারাদণ্ড নয়, সর্বোচ্চ শাস্তি হওয়া উচিত মৃত্যুদণ্ড। আমাদের মনে রাখতে হবে, এই কিছুদিন আগেও দেশে এসিড-সন্ত্রাস ছড়িয়ে পড়েছিল ভয়াবহরূপে। তৎকালীন রাষ্ট্রপতি এরশাদ সাহেব এসিড মারার শাস্তি মৃত্যুদণ্ড করার পর, মাশাল্লাহ, এই অপরাধ সাফল্যজনকভাবে নিয়ন্ত্রণ করা গেছে। ধর্ষণের শাস্তিও মৃত্যুদণ্ড (ফাঁসি) করুন এবং দু’চারটা অপরাধীকে আইনী প্রক্রিয়ায় দ্রুত ঝুলিয়ে দিন, দেখবেন বাকি শয়তানগুলো বাপ বাপ করে দেশ ছেড়ে পালাচ্ছে, আর দেশকে ধর্ষণমুক্ত করে আপনারা ইতিহাসে অমর হয়ে থাকবেন।

৪.
শুরুতেই বলেছি, সারা বিশ্বে আজ করোনাভাইরাস দোর্দণ্ড প্রতাপে দিগ্বিজয় করে বেড়াচ্ছে। তাকে পরাস্ত করার লক্ষ্যে বিজ্ঞানীরা ভ্যাকসিন আবিষ্কারের জন্য রাতদিন পরিশ্রম করছেন। জনাব ট্রাম্পই সারা বিশ্বে একমাত্র রাষ্ট্রনায়ক যিনি করোনাকে কলা দেখিয়ে ডাক্তারদের নিষেধ-টিষেধকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়ে তাঁর নির্বাচনী প্রচারণা চালিয়ে যাওয়ার জন্য মাঠে নেমে পড়েছেন। (ইংরেজিতে যে ‘ফুলহার্ডি’ বলে একটা কথা আছে, যার বাংলা বোধ হয় গোঁয়ার, তার এর চেয়ে বড় উদাহরণ আর কী হতে পারে?)

তো বাংলাদেশে, আল্লাহ মাপ করুন, এমন ফুলহার্ডি কেউ বোধ হয় নেই। সেই সঙ্গে আমরা করোনার ভ্যাকসিন আবিষ্কার করতেও পারছি না। তাই বলে কি করোনাকে একেবারে আনচ্যালেঞ্জড যেতে দেবো আমরা? না, তা তো হতে পারে না। তা আমরা কী করলাম? আমাদের কিছু ফুলহার্ডিরও গুরু ছেলে-ছোকরা ধর্ষণভাইরাস ছেড়ে দিয়েছে গ্রামে-গঞ্জে-শহরে। এই মারাত্মক প্রাণঘাতী, তার চেয়েও বেশি দেশ ও জাতির মান-সম্মান ভূলুণ্ঠনকারী, ভাইরাসের ভ্যাকসিন আশা করি আমরা শিগগিরই আবিষ্কার করে শিগগিরই নোবেল প্রাইজ বিজয়ের দৌড়ে নাম লেখাতে পারব।

করোনাভাইরাস বনাম ধর্ষণভাইরাসের খেলায় জঘন্য রকম ফাউলের জন্য উভয় দলকেই লাল কার্ড দেখানো হোক, বিশ্বনিয়ন্তা রেফারির কাছে এই কামনা।

লেখক : সাবেক সচিব, কবি