দীর্ঘমেয়াদে স্বাদ ও গন্ধ হারাচ্ছেন বহু কোভিড রোগী!

Published: 5 January 2021

পোস্ট ডেস্ক : রেসিপি না জেনেও, কেবল খাবারের গন্ধ ও স্বাদ বিচার করেই রেস্তোরাঁয় খাওয়া যেকোনো খাবার নিজ থেকে রান্না করতে পারতেন ক্যাথেরিন হানসেন। এতই তীব্র ছিল তার গন্ধ ও স্বাদের সংবেদনশীলতা।

কিন্তু গত বছরের মার্চ মাস থেকে সে গুণ হারিয়ে ফেলেন তিনি। এরপর থেকে সব খাবারই বিস্বাদ লাগতে থাকে তার। মার্চে করোনা ভাইরাসে (কোভিড-১৯) আক্রান্ত হয়েছিলেন তিনি। তার প্রথম উপসর্গগুলোর একটি ছিল গন্ধ না পাওয়া। এরপর স্বাদের অনুভূতিও হারান। হানসেন করোনা থেকে সুস্থ হয়ে উঠেছেন।
কিন্তু আজও খাবারে স্বাদ পান না তিনি।

যুক্তরাষ্ট্রের সিয়্যাটলের বাসিন্দা হানসেন বলেন, আমি যেন দৃষ্টিশক্তি হারানো কোনো বৃদ্ধের মতো হয়ে গেছি। তারা অন্ধ হলেও জানে যে কোনোকিছু দেখতে কেমন, কিন্তু বাস্তবে দেখতে পান না। আমিও জানি কোনো কিছুর স্বাদ কিরকম হওয়া উচিৎ, কিন্তু তা টের পাই না।

করোনার প্রথম শনাক্ত হওয়া উপসর্গগুলোর একটি হচ্ছে গন্ধের অনুভূতি হারানো। গন্ধ না পাওয়ার অবস্থাকে এনসমিয়া ডাকা হয়। অনেকের ক্ষেত্রে এনসমিয়া হচ্ছে করোনায় আক্রান্ত হওয়ার প্রথম লক্ষণ, আবার অনেকের জন্য একমাত্র লক্ষণ। অনেকে এর পাশাপাশি স্বাদও হারান। বেশিরভাগ মানুষই সুস্থ হওয়ার পর ধীরে ধীরে অনুভূতিগুলো ফিরে পান। কিন্তু হানসেনের মতো গুটিকয়েক মানুষের ক্ষেত্রে তা ঘটেনি। এমনকি চিকিৎসকরাও জানেন না স্বাদ ও গন্ধের অনুভূতি তারা আর কখনো ফিরে পাবেন কিনা।

করোনা ভাইরাস কিভাবে দীর্ঘমেয়াদী এনসমিয়া ঘটায় ও কীভাবে এটি দূর করা যায় সেই বিষয়ে বিজ্ঞানীরাও বেশি কিছু জানেন না। বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন, এই মহামারি শেষে বিশ্বের বহু মানুষ আজীবনের জন্য স্বাদ ও গন্ধের অনুভূতি হারিয়ে ফেলতে পারেন।

খাবারের স্বাদ ও রুচির সঙ্গে গন্ধের অন্তরঙ্গ সম্পর্ক রয়েছে। এনসমিয়া আক্রান্ত মানুষ খাবার খেয়ে তৃপ্তি পান না। আচমকা এনসমিয়ার শিকার হলে অনেকক্ষেত্রে মানুষের মেজাজ ও জীবনমানেরও অবনমন ঘটতে পারে। গবেষণায় দেখা গেছে, এনসমিয়ায় আক্রান্তরা নিজেদের সামাজিকভাবে আলাদা করে নেন। এছাড়া এর সঙ্গে অনেকে সুখ অনুভবের ক্ষমতাও হারিয়ে ফেলেন।

হার্ভার্ড মেডিকেল স্কুলের নিউরোবায়োলজি বিষয়ক সহযোগী অধ্যাপক ডা. সন্দ্বীপ রবার্ট দত্ত বলেন, মানুষের স্মৃতি ও আবেগের সঙ্গেও স্বাদ ও অন্যান্য ঘ্রাণ সম্পর্কিত স্নায়ুর জটিল সম্পর্ক রয়েছে।
তিনি বলেন, আমরা মনে করি এটা কেবল কোনো নান্দনিক বোনাস কোনো অনুভূতি। কিন্তু কেউ যখন গন্ধের অনুভূতি হারায়, এটা তাদের পরিবেশ ও পরিবেশে নিজের অবস্থান সম্পর্কে দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টে দেয়। মানুষের নিজের সুস্থ থাকার বোধ কমতে থাকে।

এনসমিয়ার ভুক্তভোগীদের মতে এটা অত্যন্ত পীড়াদায়ক একটি অভিজ্ঞতা। কিন্তু বাকিদের চোখে এ সমস্যাটি দৃশ্যমান নয়।

চেতনা ও অনুভূতির সঙ্গে গন্ধের সম্পর্ক নিয়ে গবেষণা করছেন ফিলাডেলফিয়ার মনেল ক্যামিকেল সেন্সেস সেন্টারের পামেলা ডাল্টন। তিনি বলেন, আসলে গন্ধের অনুভূতি হারিয়ে ফেলার আগে কেউ বিষয়টা তেমন করে খেয়াল করে না। চলে যাওয়ার পর ব্যাপারটা খেয়াল হয়। আর গন্ধ চলে যাওয়ার অনুভূতি অত্যন্ত মোটেই সুখকর কিছু নয়। কোনোকিছুই আর আগের মতো লাগে না।

করোনা আক্রান্ত হওয়ার পর স্বাদ ও গন্ধ হারিয়েছেন এমন ৯ হাজার ব্যক্তিকে নিয়ে ফেসবুকে একটি সাপোর্ট গ্রুপ খুলেছে দাতব্য সংস্থা এবস্যান্ট। বৃটিশ বিজ্ঞানীরা ওই ব্যক্তিদের অভিজ্ঞতা নিয়ে গবেষণা করেছেন। গবেষণাটিতে অংশ নেওয়া ব্যক্তিরা জানান, খাবার খাওয়ায় তৃপ্তি পাচ্ছেন না তারা। একইসঙ্গে কমে যাচ্ছে সামাজিক যোগাযোগও। অন্যান্যদের সঙ্গে সম্পর্ক দুর্বল হয়ে পড়ছে তাদের। তারা বলেন, বাস্তবতা থেকে বিচ্ছিন্ন মনে হচ্ছে নিজেদের।

এক অংশগ্রহণকারী বলেন, নিজের কাছেই নিজেকে অচেনা লাগে। এটা একধরণের নিঃসঙ্গতা। মনে হয় যে, আমার একটা অংশ যেন আর নেই। আমি নিত্যদিনের আবেগ-অনুভূতিগুলো টের পাই না, গন্ধ পাই না।

আরেকজন বলেন, আমার মনে হয় আমার অস্তিত্বই নেই। আমি বাড়ির গন্ধ পাই না, বাড়িতে আছি বলে মনে হয় না। আমি বাইরে গেলে নতুন বাতাসের, ঘাসের গন্ধ পাই না। বৃষ্টির গন্ধ পাই না।

গন্ধের অনুভূতি হারানোর সঙ্গে বিষণ্ণতা ও দুশ্চিন্তার ঝুঁকি বাড়ে। ডা. দত্ত বলেন, জনস্বাস্থ্য বিবেচনায় এটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিশ্বব্যাপি মোট করোনা আক্রান্তের ১০ শতাংশও যদি দীর্ঘমেয়াদে গন্ধের অনুভূতি হারায়, এই শতাংশ কয়েক কোটিতে গিয়ে পৌঁছবে।

সবচেয়ে বড় পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হচ্ছে পুষ্টিগত। এনসমিয়ায় ভোগা মানুষেরা হয়তো মৌলিক স্বাদগুলো যেমন লবণাক্ততা, টক, মিষ্টি, তেতো- অনুভব করে থাকতে পারেন। কিন্তু মানুষের স্বাদ গ্রহণের গ্রন্থিগুলো খুব সূক্ষ্মভাবে কাজ করে না। স্বাদ গ্রহণের ক্ষেত্রে গন্ধের ব্যাপক ভূমিকা রয়েছে। গন্ধ হারিয়ে ফেলা অনেকেই খাওয়ার রুচি হারিয়ে ফেলবেন। এতে তাদের অপুষ্টিতে ভোগার ঝুঁকি তৈরি হয়। ব্রুকলিনের বাসিন্দা কারা ভ্যানগিল্ডার জানান, গত মার্চে করোনা আক্রান্ত হওয়ার পর গন্ধের অনুভূতি হারান তিনি। এরপর থেকে প্রায় ২০ পাউন্ড ওজন কমেছে তার।

গন্ধের সঙ্গে বিপদ টের পাওয়ারও সম্পর্ক রয়েছে। গ্যাস লিক, অগ্নিকাণ্ড ইত্যাদি টের পাওয়ার ক্ষেত্রে মানব ইন্দ্রিয়গুলোর মধ্যে অন্যতম ভূমিকা রাখে গন্ধের অনুভূতি। ডা. ডাল্টন বলেন, মানুষ প্রতিনিয়ত গন্ধের জন্য তার চারপাশ স্ক্যান করে থাকে। পরিবেশে কী পরিবর্তন এসেছে, কোনো বিপদের আশঙ্কা আছে কিনা ইত্যাদি বোঝার চেষ্টা করে। এ প্রক্রিয়া অবচেতনভাবেই হয়ে থাকে বেশিরভাগ সময়।

তিনি আরো বলেন, গন্ধের মাধ্যমে ময়লা কাপড়, নষ্ট খাবার, ইত্যাদি বিষয়ও টের পাওয়া যায়। এসব না ধরতে পারলে মানুষ বিভিন্ন বিষয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে।

এই অবস্থা থেকে সুস্থ হয়ে উঠা কিছু মানুষের অবস্থা অবশ্য আরও খারাপ। অনেকে দাবি করেন, সুস্থ হওয়ার পর থেকেই তারা পোড়া প্লাস্টিক, অ্যামোনিয়া বা মলমূত্রের গন্ধ পাচ্ছেন।

ভার্জিনিয়া কমনওয়েলথ ইউনিভার্সিটির গন্ধ ও স্বাদ বিষয়ক কেন্দ্রের মেডিক্যাল পরিচালক ডা. ইভান আর রেইটার করোনায় স্বাদ ও গন্ধের অনুভূতি হারানো ২ হাজার মানুষকে নিয়ে কাজ করছেন।

তিনি বলেন, গন্ধের অনুভূতিতে গোলমাল হওয়াটা খুব সম্ভবত সুস্থ হয়ে উঠার সঙ্গে সম্পর্কিত। গন্ধের অনুভূতি হারানোর পর বিভিন্ন রিসেপ্টরে ভিন্ন ভিন্ন মাত্রায় এর প্রভাব পড়তে পারে। এতে মস্তিষ্কে ভুল বার্তা যেতে পারে।

সম্প্রতি জার্মানির এক গবেষণায় দেখা গেছে, বিভিন্ন ধরণের বস্তুর – তেল, ল্যাভেন্ডার, ইউক্যালিপ্টাস, দারুচিনি, চকলেট, ইত্যাদি- গন্ধ প্রতি দিন কয়েকবার করে শুঁকলে ঘ্রাণ শক্তির কিছুটা উন্নতি হয়।