অর্থনৈতিক অগ্রগতির এক যুগ

Published: 19 January 2021

।। মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া ।।

সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দুই বছর মেয়াদের শেষদিকে ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ দিনবদলের রূপকল্প-২০২১ অঙ্গীকার নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে দুই-তৃতীয়াংশের অধিক আসনের সংখ্যাগরিষ্ঠতাসহ জয়লাভ করে এবং বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ৬ জানুয়ারি ২০০৯ তারিখে সরকার গঠন করে। পরবর্তীকালে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির সাধারণ নির্বাচন-পরবর্তী সময়ে পুনরায় সরকার গঠন করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আসে।
এরই ধারাবাহিকতায় ২০১৮ সালের ডিসেম্বরের নির্বাচনেও জয়লাভ করে তৃতীয় মেয়াদে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে। ২০২১ সালের ৬ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার ১২ বছর বা এক যুগ পূর্ণ করে। সরকারের রূপকল্প-২০২১-এর মূল লক্ষ্য ছিল বাংলাদেশকে একটি মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত করা। যেসব বিবেচনায় একটি দেশ স্বল্পোন্নত দেশের পর্যায় থেকে উন্নয়নশীল মধ্যম আয়ের দেশ হিসাবে উন্নীত হয়, সেসব অর্জন করেই বাংলাদেশ এরই মধ্যে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছে গেছে। নিয়মানুযায়ী ২০২৪ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশ এলসিডি গ্রুপ থেকে বেরিয়ে আসবে। বঙ্গবন্ধুর কাঙ্ক্ষিত সোনার বাংলা গড়ার যে প্রত্যয় নিয়ে তার কন্যা ধারাবাহিকভাবে সরকারের নেতৃত্ব দিয়ে যাচ্ছেন, তার সরকারের বিগত এক যুগের মূল্যায়ন ভবিষ্যতে হয়তো নানাভাবে করা হতে পারে। আমি এ নিবন্ধে শুধু অর্থনৈতিক উন্নয়ন তথা জিডিপি প্রবৃদ্ধি, জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন, দারিদ্র্য হ্রাস, কর্মসংস্থানসহ এসবের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সূচকগুলোর ওপরই আলোকপাত করতে চাই।
স্বাভাবিকভাবেই সরকারের দীর্ঘ কর্মকালের অন্য আনুষঙ্গিক অর্জন ও চ্যালেঞ্জগুলোও উঠে আসবে। ২০০৯ সালে আমি অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের অতিরিক্ত সচিব পদে কর্মরত ছিলাম। ২০১০ সালের ফেব্রুয়ারিতে সচিব পদের দায়িত্ব নিয়ে যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের সেতু বিভাগে যোগদান করি। সৈয়দ আবুল হোসেন সাহেব ছিলেন যোগাযোগমন্ত্রী। তার সঙ্গে কর্মকালে কথাচ্ছলে একদিন তিনি তার মন্ত্রী হিসাবে নিয়োগপ্রাপ্তির বিষয়ে গল্প করেন। তিনি জানান, শপথ গ্রহণের আগে কেবিনেট ডিভিশন থেকে তাকে ফোন করা হয়। পরে জানতে পারেন তাকে পূর্ণ মন্ত্রী করা হবে। শপথ গ্রহণ শেষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যখন বঙ্গভবন ত্যাগ করার জন্য গাড়িতে উঠবেন, তখন তিনি তাকে সালাম দেওয়ার জন্য এগিয়ে যান। প্রধানমন্ত্রী মুচকি হেসে তাকে বলেন, ‘আবুল, পদ্মা সেতু আমাদের মেয়াদকালেই করতে হবে। তখনই সৈয়দ আবুল হোসেন বুঝতে পারলেন তাকে যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেওয়া হতে পারে। এ ঘটনাটি অবতারণার উদ্দেশ্য, সবাইকে এ বিষয়টি জানানো যে, পদ্মা সেতু নির্মাণ প্রধানমন্ত্রীর একটি লালিত স্বপ্ন। ১৯৯৬ সালে সরকার গঠনের পর তিনি এ স্বপ্ন দেখেন এবং সেতু নির্মাণের আনুষ্ঠানিকতা শুরু করেন। তার মেয়াদকালের শেষ দিকে ৪ জুলাই ২০০১ তিনি পদ্মা নদীর মাওয়া প্রান্তে এ সেতুর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। ২০০৯ সালে দেশের শাসনভার গ্রহণের পর পদ্মা সেতুর জন্য জমি অধিগ্রহণ, ডিজাইন প্রণয়ন, পুনর্বাসন এলাকার উন্নয়নসহ আনুষঙ্গিক সব কাজ যুগপৎ চলতে থাকে। সরকার পদ্মা সেতু প্রকল্পকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত প্রকল্প হিসাবে ঘোষণা করে। আমি সেতু বিভাগের সচিব হিসাবে যোগদানের পর থেকেই মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ও যোগাযোগমন্ত্রীর তত্ত্বাবধানে পদ্মা সেতু প্রকল্পের কাজ দ্রুত এগিয়ে নিয়ে যাই। প্রকল্পে নিয়োজিত কর্মকর্তা, উন্নয়ন-সহযোগী সংস্থাগুলো ও প্যানেল বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে সমন্বয় করে ডিজাইন প্রণয়ন, প্রিকোয়ালিফিকেশন টেন্ডার ডকুমেন্ট তৈরি ও টেন্ডার আহ্বান, টেন্ডার মূল্যায়নসহ গুরুত্বপূর্ণ প্রাথমিক কাজ সমাপ্তির পর্যায়ে একটি স্বার্থান্বেষী মহলের ষড়যন্ত্রে পদ্মা সেতুর কাজ স্থগিত হয়ে যায়। বিশ্বব্যাংকের নেতৃত্বে উন্নয়ন-সহযোগীরা প্রকল্প থেকে সরে দাঁড়ায়। বিশ্বব্যাংক সরকারের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী, উপদেষ্টা, সচিবসহ অনেকের বিরুদ্ধে দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের অভিযোগ করে। অভিযোগের তীর প্রকারান্তরে প্রধানমন্ত্রীর পরিবারের সদস্য ও সরকারের বিরুদ্ধেও নিক্ষিপ্ত হয়। প্রধানমন্ত্রী বিশ্বব্যাংকের ঋণ প্রত্যাখ্যান করে নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেন। অবশেষে বাংলাদেশ দুর্নীতি দমন কমিশনের তদন্তে ২০১৪ সালে দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের অভিযোগ মিথ্যা প্রমাণিত হয়। একইভাবে ২০১৭ সালে কানাডার সুপিরিয়র কোর্ট দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের অভিযোগ ভিত্তিহীন, গুজব, শোনা কথা ইত্যাদি বলে মামলার আসামিদের অব্যাহতি দেন। দেশি-বিদেশি মিডিয়ার অপপ্রচার, সুশীল সমাজ ও দেশের একশ্রেণির মানুষের সন্দেহ ও সমালোচনাসহ অনেক দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে সরকার ও অভিযুক্তদের। অবশেষে জাতি কলঙ্কমুক্ত হয়েছে। নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণ করে বাংলাদেশ তার আর্থিক সামর্থ্য প্রমাণ করতে পেরেছে। প্রধানমন্ত্রীর এ একটি আত্মবিশ্বাসী সিদ্ধান্ত সারাবিশ্বে বাংলাদেশের মর্যাদা ও সক্ষমতা বিশ্বাসযোগ্যভাবে প্রতিষ্ঠিত করেছে।
কৃষির আধুনিকায়ন, নতুন উদ্ভাবন, সারের ব্যবহার এবং সর্বোপরি প্রতি বছর প্রায় ৮-৯ হাজার কোটি টাকা সরকারি ভর্তুকি দেওয়ার ফলে শস্য উৎপাদন, শাকসবজি, মাছ ও গবাদিপশু উৎপাদনে দেশ স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়েছে। ধান, সবজি ও মাছ উৎপাদনে বাংলাদেশ সারা বিশ্বে তৃতীয় থেকে পঞ্চম স্থানের মধ্যে অবস্থান করে। শিল্পোন্নয়নের একটি বড় অনুষঙ্গ হলো বিদ্যুৎ ও গ্যাস উৎপাদন ও সরবরাহ বৃদ্ধি। ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পর সরকার বিদ্যুৎ উৎপাদনের দিকে সবিশেষ গুরুত্বারোপ করে। বিদ্যুৎ উৎপাদনে সরকারের কার্যক্রম যাতে ভবিষ্যতে প্রশ্নবিদ্ধ না হয়, সেজন্য বিশেষ আইন করা হয়েছে। উদ্যোক্তাদের উৎপাদনের শুরু থেকে ১৫ বছরের কর মওকুফ করা হয়েছে। কারখানা, শিল্প স্থাপন এবং ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি, নির্মাণসামগ্রী ও কাঁচামাল আমদানিতে শুল্ক কর মওকুফ করা হয়। ফলে দেশ এখন বিদ্যুৎ উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়েছে। ২০০৪-০৫ সালে যেখানে দৈনিক বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিমাণ ছিল সাড়ে চার হাজার মেগাওয়াট, সেখানে ২০২০ সালে দৈনিক উৎপাদন সক্ষমতা দাঁড়িয়েছে ২৪ হাজার মেগাওয়াট। বিদ্যুৎ সুবিধাপ্রাপ্ত লোকসংখ্যা ২০০৫-০৬ সালের ৪৭ শতাংশ থেকে বৃদ্ধি পেয়ে বর্তমানে প্রায় ৯৯ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। বিদ্যুৎ সরবরাহ নিরবচ্ছিন্ন রাখার জন্য রামপাল, পায়রা, বাঁশখালী, মহেশখালী ও মাতারবাড়ীতে আরও ৭ হাজার ৮০০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের কাজ চলছে। রাশিয়া থেকে প্রায় ১২ বিলিয়ন ডলার ঋণসহায়তায় মোট ২৪০০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপিত হচ্ছে। ২০২৩ সাল নাগাদ এ বিদ্যুৎকেন্দ্রের ১২০০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন প্রথম ইউনিটের নির্মাণ সমাপ্তির পর বিদ্যুৎ সঞ্চালন সম্ভব হবে। শিল্প ও গৃহস্থালি কাজে গ্যাস সরবরাহ স্থিতিশীল রাখার জন্য গ্যাস উৎপাদনের পাশাপাশি ২০১৮ সাল থেকে তরলীকৃত গ্যাস আমদানি করে জাতীয় গ্রিডে সরবরাহ করা হচ্ছে। কর অব্যাহতিসহ গ্যাস সরবরাহেও সরকার ভর্তুকি দিচ্ছে। ২০০৯ সালে যেখানে জাতীয় গ্রিডে গ্যাস সরবরাহ ছিল ১ হাজার ৭৪৪ মিলিয়ন ঘনফুট, সেখানে বর্তমানে সরবরাহ ২ হাজার ৫২৫ মিলিয়ন ঘনফুট। বর্তমান সরকারের সবচেয়ে বড় সাফল্য অবকাঠামোগত উন্নয়ন। সড়ক বিভাগ, সেতু বিভাগ ও স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের মাধ্যমে বহু রাস্তাঘাট, ব্রিজ, কালভার্ট ও অসংখ্য স্থাপনা নির্মাণ করা হয়েছে। ২০০৯ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে ঢাকা-চট্টগ্রাম, ঢাকা-ময়মনসিংহ, ঢাকা-মাওয়া-ভাঙ্গাসহ ৪৫৩ কিলোমিটার জাতীয় মহাসড়ক চার বা তদূর্ধ্ব লেনে উন্নীত করা হয়েছে। ঢাকা-সিলেটসহ আরও ৬৬১ কিলোমিটার মহাসড়ক চার বা তদূর্ধ্ব লেনে উন্নীত করার কাজ চলছে। এছাড়া পল্লি এলাকায় পাকা সড়ক উন্নয়ন, ব্রিজ, কালভার্ট, উপজেলা কমপ্লেক্স, ইউনিয়ন পরিষদ কমপ্লেক্স, সাইক্লোন শেল্টার ও প্রাথমিক বিদ্যালয়সহ অসংখ্য উন্নয়নমূলক কাজ সম্পন্ন হয়েছে। গ্রোথ সেন্টার, হাট-বাজার, পৌরসভার উন্নয়নের ফলে গ্রামীণ জনগণও নাগরিক সুবিধাসহ উন্নয়নের সব সুবিধা ভোগ করছে।
বর্তমান সময়ে দেশে অন্তত ১০-১২টি মেগা প্রকল্প চলমান রয়েছে। পদ্মা সেতুর কাজ ৮২ শতাংশ, কর্ণফুলী টানেল ৬২ শতাংশ, ঢাকা বিমানবন্দর থেকে কুতুবখালী পর্যন্ত ৪৬.৭৩ কিলোমিটার এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে ও উত্তরা-মতিঝিল মেট্রোরেলের কাজ ৬০ শতাংশের ঊর্ধ্বে সমাপ্ত হয়েছে। ২০২২-২৩ সালের মধ্যে এ দুটো মেগা প্রকল্পের কাজ শেষ হবে বলে আশা করা যায়। জাপানের সহায়তায় মেঘনা-গোমতী নদীর ওপর আগের সেতুর তুলনায় প্রশস্ত আরও একটি নতুন সেতু নির্মাণ করা হয়েছে। এছাড়া দেশের বিভিন্ন নদীর ওপর ১৫০০ মিটার কম দৈর্ঘ্যরে অসংখ্য সেতু নির্মাণ করে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন ঘটানো হয়েছে। কিশোরগঞ্জ জেলার হাওড় এলাকার যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নকল্পে ইটনা-মিঠামইন-অষ্টগ্রাম ৪০ কিলোমিটার সড়ক নির্মাণ করা হয়েছে।
হাওড়ের পানি চলাচলে যাতে বিঘ্ন না ঘটে, সেজন্য এ সড়কে অসংখ্য ব্রিজ-কালভার্ট স্থাপিত হয়েছে। কিশোরগঞ্জের সঙ্গে মিঠামইনের সংযোগের জন্য প্রায় ১২ কিলোমিটার এলিভেটেড সড়ক নির্মাণের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। পদ্মা সেতু চালুর পর ঢাকা শহরের ওপর যানবাহনের চাপ কমানোর জন্য ঢাকা ইস্ট ওয়েস্ট এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে ঢাকা-আরিচা ও ঢাকা-মাওয়া মহাসড়ককে যুক্ত করে ঢাকা-চট্টগ্রাম সড়ক পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া হবে। পায়রা সমুদ্রবন্দর, মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্রবন্দর ও মাতারবাড়ি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রসহ আরও অন্যান্য মেগা প্রকল্প চলমান থাকায় করোনাকালে কর্মসংস্থান ও অর্থনীতিতে ইতিবাচক সুবাতাস দিচ্ছে।
আমি সেতু বিভাগের সচিব থাকাকালীন তৎকালীন যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনের তত্ত্বাবধানে কর্ণফুলী টানেল, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, পটুয়াখালীতে বেকুটিয়া সেতু, ঢাকা আশুলিয়া চন্দ্রা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, ঢাকা-গাজীপুর বিআরটি-১ ডেজিগনেটেড সড়ক, নির্মীয়মাণ মেট্রোরেলসহ অসংখ্য প্রকল্পের ফিজিবিলিটি স্টাডি, ডিজাইন প্রণয়ন ও নেগোসিয়েশনের সঙ্গে যুক্ত ছিলাম। সৈয়দ আবুল হোসেন তিন শতাধিক রাস্তা, ব্রিজসহ অবকাঠামো নির্মাণ প্রকল্পের পরিকল্পনা করেছিলেন। এসব প্রকল্পের অনেক এখন পর্যায়ক্রমে বাস্তবায়িত হচ্ছে। প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়নে এ সরকারের আগ্রহ, সাহস ও সদিচ্ছা প্রশংসনীয়। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সভাপতিত্বে প্রতি সপ্তাহে একদিন করে নিয়মিত মন্ত্রিসভা ও একনেক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে যথাক্রমে আইন প্রণয়ন ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এবং প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়ন বিষয় আলোচিত হয়। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, শিল্প, কৃষি, সড়ক, বন্যা নিয়ন্ত্রণ ইত্যাদিবিষয়ক যে কোনো প্রকল্প দেশের কোন এলাকায়, কোথায় নেওয়া প্রয়োজন তা প্রধানমন্ত্রীর নখদর্পণে। কারণ তিনি দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল ও আনাচে-কানাচে ঘুরে বেড়িয়েছেন। দীর্ঘ সময় ধারাবাহিকভাবে সরকার পরিচালনার দায়িত্বে থাকায় এবং দেশপ্রেম ও দেশের মানুষের জন্য কাজ করার মানসিকতা উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত হওয়ায় উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়নে তার দক্ষতা, আগ্রহ ও সাহস অতুলনীয়। জনমুখী প্রকল্প বাস্তবায়নে সরকারের অর্থাভাব হয় না। কৃষি খাতের প্রধান উপকরণ সার সরবরাহ বৃদ্ধির জন্য এ সরকারের সময়ে ফেঞ্চুগঞ্জে শাহজালাল সার কারখানা নির্মিত হয়। এর বার্ষিক উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা তিন লাখ টন। নরসিংদীর পলাশে আরও একটি ইউরিয়া সার কারখানা প্রতিষ্ঠার কাজ জাপানি ঋণে চলমান। কয়েক বছরের মধ্যে নির্মাণ ও মেশিন স্থাপন শেষ হলে এ কারখানায় বছরে কমপক্ষে চার লাখ টন ইউরিয়া সার উৎপাদিত হবে। পদ্মা সেতু প্রকল্প থেকে উন্নয়ন-সহযোগী সংস্থাগুলো সরে গেলেও মেট্রোরেল প্রকল্পে জাপানের জাইকা একাই ৭ বিলিয়ন ডলারের প্রতিশ্রুতি নিয়ে এগিয়ে আসে। মেট্রোরেল চালু হলে ঢাকা শহরের যাতায়াত ব্যবস্থায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসবে। ২০২১ সালেই এটি চালু করার পরিকল্পনা রয়েছে। পদ্মা সেতু চালু হলে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিম বাংলার জেলাগুলোর সঙ্গে রেল যোগাযোগও সহজ হবে। এছাড়া যমুনা বঙ্গবন্ধু সেতুর পাশে আরও একটি রেল সেতু স্থাপিত হবে। ঢাকা শহরে পাতাল রেল প্রকল্প গ্রহণের বিষয়ে সেতু বিভাগ প্রয়োজনীয় সমীক্ষা ও পরিকল্পনা প্রণয়ন করছে।
বাংলাদেশ বিমান এয়ারলাইনসে ছয়টি অত্যাধুনিক বোয়িং ড্রিমলাইনার যুক্ত হওয়ার পর বিমানবহরে এখন বিমানসংখ্যা ১৮টি। চলতি মাসে আরও দুটি ড্যাশ ৮-৪০০ উড়োজাহাজ যুক্ত হলে এ সংখ্যা দাঁড়াবে ২০। যুক্তরাষ্ট্র, কানাডাসহ বিশ্বের আরও বেশক’টি দেশের সঙ্গে বিমান চলাচলের জন্য আলোচনা চলছে।
বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। এর মাধ্যমে দেশের সবক’টি টেলিভিশন চ্যানেলের অনুষ্ঠান সম্প্রচার ছাড়াও ৩১টি দ্বীপে ইন্টারনেট সেবা প্রদান করা হচ্ছে। কয়েকটি ব্যাংক এবং বাংলাদেশ সেনাবাহিনীও স্যাটেলাইট বঙ্গবন্ধু-১-এর সেবা গ্রহণ করছে। দেশে বর্তমানে ১৭ কোটি মোবাইল ব্যবহৃত হয়। ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা ১১ কোটিতে উন্নীত হয়েছে। অর্থনৈতিক উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে কর্মসংস্থান বৃদ্ধি ও জনগণের জীবন মানোন্নয়নের পাশাপাশি দারিদ্র্যদূরীকরণে আশানুরূপ সাফল্য পাওয়া গেছে। ২০০৬ সালের দারিদ্র্যের হার ৪০ শতাংশ থেকে কমে ২০১৯ সালে ২৪ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। চরম দারিদ্র্য জনগোষ্ঠীর সংখ্যা ১১ শতাংশে নেমে এসেছে। অবশ্য ২০২০ সালে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ও বৃদ্ধির কারণে দরিদ্র ও চরম দরিদ্র জনগোষ্ঠীর সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। সরকারি স্বাস্থ্য খাতে দুর্নীতি ও অব্যবস্থার কিছু দুর্নাম রয়েছে। করোনাভাইরাসের প্রাথমিক অবস্থায় কিছুটা সমন্বয়হীনতা থাকলেও এরই মধ্যে সংকট উত্তরণে ইতিবাচক পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। সারা দেশে সরকারি হাসপাতাল, স্বাস্থ্যকেন্দ্র, কমিউনিটি ক্লিনিক ইত্যাদির পাশাপাশি প্রায় সাড়ে ১২ হাজার ছোট-বড় প্রাইভেট হাসপাতাল, নার্সিং হোম ও ক্লিনিক জনগণের চিকিৎসাসেবায় নিয়োজিত। স্বাস্থ্যব্যবস্থার সম্প্রসারণ ও মানোন্নয়নের ফলে এবং টিকাদান কর্মসূচির সাফল্যের কারণে ২০১৯-২০ সালে দেশের মানুষের গড় আয়ু ৭২.৬ বছরে উন্নীত হয়েছে। শিশুমৃত্যু ও মাতৃমৃত্যুর হার তুলনামূলকভাবে ভারত ও পাকিস্তানের চেয়ে কম। এ সরকারের মেয়াদকালে দেশের সামষ্টিক অর্থনীতি স্থিতিশীল রয়েছে। মুদ্রাস্ফীতি গড়ে ৬ শতাংশের নিচে। অর্থনৈতিক উন্নয়নের এ পর্যায়ে শিল্পায়ন ও ভোগ চাহিদা বৃদ্ধির কারণে এরূপ মুদ্রাস্ফীতি সহনীয় বলা চলে। বিনিয়োগ সুবিধাসহ ব্যাংক ঋণের কোনো অপ্রতুলতা নেই। মুদ্রা সরবরাহ স্থিতিশীল। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বরাবরই পর্যাপ্ত ছিল, যা বর্তমানে রেকর্ড ৪৩ বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করেছে। তবে ব্যাংক ঋণ ও জামানতের সুদের হার ৯-৬-এ বেঁধে দেওয়ায় ব্যাংকগুলো চাপের মধ্যে রয়েছে এবং আমানতকারীরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। দেশের অভ্যন্তরীণ রাজস্ব আহরণে ২০০৯-১০ অর্থবছর থেকে প্রতি বছর গড়ে ১৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি লক্ষ করা গেছে। যদিও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে অর্থ বিভাগ কর্তৃক দেওয়া লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় রাজস্ব কম আহরিত হয়েছে। ২০১৯-২০ অর্থবছরে করোনা মহামারির কারণে রাজস্ব আহরণে পূর্ববর্তী বছরের তুলনায় ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধি হয়েছে। কর জিডিপি অনুপাত বৃদ্ধির লক্ষ্যে রাজস্ব আহরণে আরও গতি সঞ্চার করতে হবে।
‘সকলের সাথে বন্ধুত্ব, কারো সাথে বৈরিতা নয়’, বৈদেশিক নীতির এ মূলমন্ত্রে সরকার কাজ করে বিধায় সারা বিশ্বে বাংলাদেশ একটি উদীয়মান মর্যাদাশীল জাতি হিসাবে পরিগণিত হচ্ছে। প্রতিবেশী, উন্নত-অনুন্নত সব দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের মর্যাদাপূর্ণ সুসম্পর্ক রয়েছে। মিয়ানমার থেকে বিতাড়িত, বাস্তুচ্যুত প্রায় ১২ লাখ রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে আশ্রয় দিয়ে বাংলাদেশ বিশ্ববাসীর প্রশংসা কুড়িয়েছে। তাদের শান্তিপূর্ণভাবে নিজ দেশে ফেরত পাঠানোর সব প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।
জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী বাহিনীতে শান্তিরক্ষী প্রেরণকারী দেশ হিসাবে বাংলাদেশের অবস্থান শীর্ষে। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী জাতিসংঘসহ সব আন্তর্জাতিক ফোরামে আর্তমানবতার পক্ষে, শোষণ-নিপীড়নের বিরুদ্ধে, বিশ্ব সম্পদের প্রতি সবার সমঅধিকার এবং বিশ্ব পরিবেশ রক্ষার জন্য কথা বলেন। আন্তর্জাতিক ফোরামে বাংলাদেশের ভূমিকা প্রশংসিত হয়। আর্থ-সামাজিক খাতে বাংলাদেশের বিস্ময়কর উত্থান ও অগ্রযাত্রা এখন সারা বিশ্বে স্বীকৃত। প্রভাবশালী ম্যাগাজিন ইকোনমিস্টের ২০২০ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী ৬৬টি উদীয়মান সবল অর্থনীতির দেশের তালিকায় বাংলাদেশের স্থান নবম। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের পূর্বাভাস অনুযায়ী, ২০৩০ সাল নাগাদ বাংলাদেশ হবে বিশ্বের ২৪তম বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ। রূপকল্প ২০৪১-এর লক্ষ্য হলো ২০৪১ সালের মধ্যে একটি উন্নত দেশে পরিণত হওয়া। সে লক্ষ্যে দেশের অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা এবং দ্বিতীয় প্রেক্ষিত পরিকল্পনা ২০২১-৪১ প্রণয়ন করা হয়েছে। এসব পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হলে বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান বৃদ্ধি পাবে এবং দারিদ্র্যের হার আরও নেমে আসবে। দেশের এতসব অর্জন ও সাফল্যের মধ্যেও কতিপয় সমস্যা ও চ্যালেঞ্জ মাঝে মাঝে আমাদের অগ্রযাত্রা ব্যাহত করে কিংবা গতি দুর্বল করে দেয়। দেশপ্রেম ও নীতিবিবর্জিত এক শ্রেণির মানুষের অপকর্মের জন্য দেশ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। মানি লন্ডারিংয়ের মাধ্যমে প্রতি বছর বিপুল পরিমাণ টাকা বিদেশে পাচার হচ্ছে। অসাধু ব্যবসায়ীরা ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে আর পরিশোধ করছে না। ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের কারণে কতিপয় ব্যাংক খুব আর্থিক চাপে রয়েছে। কতিপয় জনপ্রতিনিধি, সরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মচারী-কর্মকর্তা, অসৎ ব্যবসায়ীর দুর্নীতির বিষয়ে দেশে-বিদেশে বিরূপ প্রচারণা রয়েছে।
এসবের কারণে ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের ২০১৯ সালের এক মূল্যায়ন প্রতিবেদনে বাংলাদেশের অবস্থান অনেক নিচে নেমে গেছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বিগত সাধারণ নির্বাচনের পর দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স ঘোষণা করেছেন। অতি সম্প্রতিও সবাইকে দেশপ্রেম ও সততার সঙ্গে জীবনযাপন ও কাজ করার নির্দেশ দিয়েছেন। বাংলাদেশের অব্যাহত অগ্রযাত্রা বজায় রাখার স্বার্থে আমাদের সততা, নিষ্ঠা ও ধৈর্যসহ দেশপ্রেম বজায় রেখে কাজ করতে হবে।
মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া : সাবেক সিনিয়র সচিব, বর্তমানে জার্মানিতে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত