হাদিসের বর্ণনায় দাজ্জালের বিচরণভূমি

Published: 2 October 2021

।। ড. মুহাম্মদ তাজাম্মুল হক।।


মুসলিম জাতির বিশ্বাস অনুসারে কিয়ামতের আগে ‘দাজ্জাল’-এর আগমন হবে। দাজ্জাল শয়তানি শক্তির প্রতীক হয়ে আসবে এবং পৃথিবীতে বিপর্যয় সৃষ্টি করবে। নবীজি (সা.) বলেন, ‘দাজ্জাল পূর্বাঞ্চলীয় কোনো স্থান থেকে বের হবে। স্থানটির নাম হলো খোরাসান। কিছু সম্প্রদায় তার অনুসরণ করবে। তাদের চেহারা হবে স্ফীত চ্যাপ্টা ঢালের মতো।’ (সুনানে তিরমিজি, হাদিস : ২২৪০)

খোরাসান মধ্য এশিয়ার একটি ঐতিহাসিক অঞ্চল। নবীযুগে বর্তমান উত্তর-পূর্ব ইরান তথা নিশাপুর, তুশ, মাসহাদ, জুরজান, দামাঘান; উত্তর-পশ্চিম আফগানিস্তান তথা হেরাত, বালখ, কাবুল, গাজনি, কান্দাহার; দক্ষিণ তুর্কমেনিস্তান তথা মেরি প্রদেশ-মার্ভ, সানজান; উত্তর-পশ্চিম তাজিকিস্তান তথা সুগ্ধ প্রদেশের খোজান্দ, পাঞ্জাকেন্ত; উত্তর ও দক্ষিণ-পূর্ব উজবেকিস্তান তথা সামারকান্দ, বুখারা, সেহরিসাবজ, আমু নদী ও সীর নদীর মধ্যাঞ্চল, উত্তর-পশ্চিম পাকিস্তান তথা মালাকান্দ, সোয়াত, দির, চিত্রাল এবং দক্ষিণ কাজাখস্তানের এক বিস্তীর্ণ অঞ্চল খুরাসানের অন্তর্ভুক্ত বলে পরিগণিত হতো। এই অঞ্চলের উত্তর সীমায় ছিল আমু নদী, পশ্চিমে কাস্পিয়ান সাগর, দক্ষিণে মধ্য ইরানের মরু অঞ্চল ও পূর্বে মধ্য আফগানিস্তানের পার্বত্য উচ্চভূমি।

খোরাসানের একটি প্রসিদ্ধ এলাকা ছিল ‘ইসফাহান’। বর্তমান ইরানের জাগ্রোস পর্বতমালার পাদদেশে জায়েন্দে নদীর তীরে শহরটি অবস্থিত। নবীজির (সা.) অন্য এক হাদিসে দাজ্জাল প্রকাশের স্থান খোরাসানের ইসফাহানকে সুর্নিদিষ্ট করেছেন। আয়েশা (রা.) বলেন, নবীজি (সা.) বলেছেন, ‘দাজ্জাল ইসফাহানের ইহুদিয়া থেকে বের হবে।’ (মুসনাদে আহমদ, হাদিস ২৪৫১১)

ইবনুল ফকিহ লেখেন, ইহুদিরা বখতনসরের ধ্বংসলীলা থেকে পালিয়ে আসার সময় সঙ্গে করে জেরুজালেম থেকে পানি এবং মাটির নমুনা নিয়ে এসেছিল। তারপর প্রতিটি জায়গার পানি ও মাটি পরীক্ষা করে অগ্রসর হচ্ছিল। কিন্তু কোনো শহরে তারা বসতি স্থাপন করেনি। ইসফাহান শহরের পানি ও মাটি পরীক্ষা করে দেখল উভয়ই জেরুজালেমের অনুরূপ। তারপর তারা এখানে বসতি স্থাপন করে। ফলে মহল্লাটির নাম হয় ইয়াহুদিয়া। (কিতাবুল বুলদান, পৃষ্ঠা ২৬১-২৬২)

আল্লামা ইবনে হাজার (রহ.)-এর মতে, নবীজি (সা.) ও সাহাবিদের সময়ে সন্দেহকৃত দাজ্জাল ইবন সাইয়্যাদ একসময় তার বন্ধুদের নিয়ে ইসফাহানে অদৃশ্য হয়েছে। (ফাতহুল বারি : ১৩/৩২৮)

আবদুর রহমান (রহ.) বলেন, যখন আমরা ইসফাহান বিজয় করি তখন আমাদের সেনাকেন্দ্র এবং ইয়াহুদিয়া এলাকার মধ্যে এক ফারসাখ (৫.৮ কি.মি.) পরিমাণ দূরত্ব ছিল। আমরা নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রী ক্রয়ের জন্য প্রায়ই ইয়াহুদিয়া এলাকায় যাতায়াত করতাম। একদিন আমি সেখানে গিয়ে দেখি, ইহুদিরা তবলা বাজিয়ে নেচে-গেয়ে উৎসব পালন করছে। ওখানে আমার পরিচিত এক ইহুদি ছিল। তাকে গিয়ে উৎসব পালনের কারণ জিজ্ঞেস করলে সে বলে, আজ আমাদের মুক্তিদাতা মহান সম্রাটের আগমন হবে, যার নেতৃত্বে আমরা পুনরায় আরবদের ওপর বিজয় অর্জন করব। তার উত্তর শুনে আমি সে রাতটি পাশের পাহাড়ের উঁচু একটি টিলার ওপর কাটালাম। যখন ভোর হয়ে সূর্যোদয় হলো তখন আমাদের সেনাকেন্দ্রের দিক থেকে ধুলাবালি উড়তে দেখা গেল। আমি দেখি, এক ব্যক্তি এগিয়ে আসছে, যার পরনে রাইহান সুগন্ধিযুক্ত পোশাক ছিল। ইহুদিরা তখন আরো বেশি নাচছিল। কিছুটা কাছে আসার পর যখন আমি লোকটাকে ভালো করে প্রত্যক্ষ করলাম তখন দেখি সে হলো ইবনে সাইয়্যাদ। এরপর সে ইয়াহুদিয়া এলাকায় প্রবেশ করে। এখন পর্যন্ত সে ওখান থেকে ফিরে আসেনি। (ফাতহুল বারি : ৩০/৪৩; তারিখে ইসফাহান : ১/১৪)

পুরনো ইয়াহুদিয়ার বর্তমান নাম ‘জোবরেহ’, যা ইসফাহানের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সাংস্কৃতিক ও পর্যটন কেন্দ্র। মহল্লা জোবরেহ ইসফাহানের উত্তর-পূর্বে অবস্থিত। এটা ইসফাহানের প্রধান ইহুদি এলাকা, অতীতে যা ঘনবসতি ছিল। ইরানে ইহুদিদের ধর্মীয় উপাসনা এবং উপাসনালয় প্রতিষ্ঠা আইনত স্বীকৃত। ফলে সেখানকার খুব কমসংখ্যক ইহুদি ইসরায়েলে ফিরে যায়। তেহরানে ৩২টি, সিরাজে ১৮টি, ইসফাহানে ২৬টি, ইয়াজদে ৯টি, হামাদানে আটটি এবং বিভিন্ন প্রদেশ ও জেলা শহরে ছড়িয়ে আছে আরো বহু সিনাগগ। ইসফাহানের ‘জোবরেহ’ ও ‘মোল্লা জেকব সিনাগগ’ ইহুদিদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ।

দাজ্জালের অবস্থান সম্পর্কিত সবচেয়ে প্রাসঙ্গিক সাহাবি তামিম আদ-দারির ঘটনা যা নবীজি (সা.) সাহাবিদের বর্ণনা করে শুনিয়েছিলেন, সেখানে নবীজি (সা.) বলেন, ‘সাবধান! সে সিরিয়া সাগরে বা ইয়ামান সাগরে রয়েছে; না; বরং সে পূর্বদিকে রয়েছে, সে পূর্বদিকে রয়েছে, সে পূর্বদিকে রয়েছে। এ সময় তিনি তার হাত দ্বারা পূর্ব দিকে ইশারাও করলেন।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ৭১১৯)

এ হাদিসে দাজ্জাল ছাড়াও ’জাসসাসাহ’ নামক একটি অদ্ভুত প্রাণীর কথা বলা হয়েছে যে দ্বীপে দাজ্জালের জন্য গোপন সংবাদ সংগ্রহ করে। আল-কাজবিনি ‘জাজিরাতুল জাসসাসাহ’ বলতে ‘কাস্পিয়ান সাগরের দ্বীপ বুঝিয়েছেন। (আসরারুল বিলাদ, পৃষ্ঠা ১৭৮)

দাজ্জাল জাবালু কেলেস্তান থেকে মুক্তি পেয়ে ইসফাহানের মারু হয়ে ইয়াহুদিয়া প্রবেশ করবে। আয়েশা (রা.) বলছেন, ইয়াহুদিয়া থেকে তার গন্তব্য হবে মদিনা। (মুসনাদে আহমদ, হাদিস ২৩৯৪)

তবে মদিনায় আসার পথে খুজিস্তান ও কিরমানে অবতীর্ণ হবে। তারপর সে দজলার পারে কুসায় আসতে পারে। মুয়াবিয়ার (রা.) আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রা.)-কে তিনি বলেছিলেন, “তুমি কি ‘কুসা’ নামক একটি এলাকা চেন, যা খুব লবণাক্ত ভূমি? সে বলল, হ্যাঁ! তিনি বললেন, সেখান থেকে দাজ্জাল বের হবে।” (আল-ফিতান, ১৫০৪)। কুসার বর্তমান নাম ‘তাল্ল ইবরাহিম, যা দজলা নদীর পারে অবস্থিত। স্থানটিকে ইবরাহিম (আ.)-এর জন্মস্থান মনে করা হয়।

আরব ভূমিতে প্রবেশের পূর্বে ডানে-বামে বিপর্যয়ের কথা বলা হয়েছে। আবদুল্লাহ ইবন মাসউদ (রা.) মনে করতেন, দাজ্জাল কর্তৃক কুফা আক্রান্ত হবে। তিনি বলেন, ‘নিশ্চয়ই আমি দাজ্জাল কর্তৃক তোমাদের সর্বপ্রথম আক্রান্ত ঘরগুলোর অধিবাসীদের সম্পর্কে অবহিত হে কুফাবাসী!’ (মুসান্নাফে ইবনে আবি শায়বা, হাদিস : ৩৮৬৯৪)

কাব (রা.)-এর বর্ণনা মতে, দাজ্জাল বসরা শহরেও অবতীর্ণ হবে। তিনি বলেন, ‘সর্বপ্রথম দাজ্জাল যে পানিতে অবতীর্ণ হবে তা হলো বসরার উঁচু পাহাড়ের পাদদেশের পানি। সেখানে অনেক বালি মিশ্রিত পানি রয়েছে, তাতে দাজ্জাল সর্বপ্রথম অবতীর্ণ হবে।’ (আল-ফিতান, ১৫০৭)

দাজ্জালের একমাত্র গন্তব্য মদিনা হলেও সে তাতে প্রবেশ করতে পারবে না। (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৬৬৪৮) তবে সে মদিনার বাহিরে জুরুফের এক অনুর্বর লবণাক্ত ভূমিতে অবতরণ করবে এবং এখানেই সে তার শিবির স্থাপন করবে। (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ৭১২৪)

আবু হুরাইরা (রা.) থেকে বর্ণিত যে নবীজি (সা.) বলেছেন, মাসিহ দাজ্জাল মদিনা আক্রমণের উদ্দেশে এসে উহুদ পাহাড়ের পশ্চাতে অবতরণ করবে এবং ফেরেশতারা তার মুখ (গতি) সিরিয়ার দিকে ফিরিয়ে দেবে আর সেখানেই সে ধ্বংস হবে। (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ৩২১৭)

পূর্ব দামেশকের একটি মসজিদে ঈসা (আ.) অবতরণ করবেন এবং নবী ঈসার (আ.) ভয়ে দাজ্জাল পালিয়ে ‘লুদ্দ’ নামক শহরে আশ্রয় নেবে। নবী ঈসা (আ.) তাকে হত্যার জন্য খোঁজ করবেন এবং ‘লুদ্দের নগরদ্বারে পেয়ে হত্যা করবেন। (সুনানে তিরমিজি, হাদিস : ২২৪০)

লুদ্দ বর্তমান ইসরায়েল অধিকৃত ঐতিহাসিক ফিলিস্তিন ভূখণ্ডের একটি ছোট শহর, যা তেলআবিব থেকে ১৫ কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্বে অবস্থিত। ইসরায়েলের প্রধানতম বিমানবন্দর বেন গুরিয়ান বিমানবন্দর এ শহরের কাছেই অবস্থিত। আল্লাহ তাআলা শেষ যুগের ফিতনা থেকে আমাদের রক্ষা করুন। আমিন।

লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা।