সবাইকে নিয়ে পথ চলাই ‘এগিয়ে যাওয়া’

Published: 26 November 2021

।। ড. মীজানুর রহমান।।

পরিসংখ্যানই আপাতত সত্য। যদিও ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন ডিজরেলি নাকি বলেছিলেন, ‘মিথ্যা তিন প্রকার : মিথ্যা, ডাহা মিথ্যা এবং পরিসংখ্যান।

স্বাধীনতার পঞ্চাশে দাঁড়িয়ে পাকিস্তানের তো বটেই, এমনকি ভারতের চেয়েও মাথাপিছু আয়ে আমরা এগিয়ে। নতুন পরিসংখ্যান অনুযায়ী আমাদের মাথাপিছু আয় ২৫৫৪ ডলার। ২০২০-২১ সালে অর্থনীতির আয়তন দাঁড়িয়েছে ৪০৯ বিলিয়ন ডলার।

তবে আমাদের সম্পদ, আয়ের প্রবৃদ্ধি এবং উন্নয়ন যে হারে হয়েছে, আমাদের বৈষম্য, দুর্নীতি, ধর্মান্ধতা, অধিকারহীনতা, পরিবেশ দূষণ ও বঞ্চনা সে হারে কমেনি; বরং আয় উন্নতি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এগুলোও বেড়েছে। মানুষের মৌলিক চাহিদা অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থান-শিক্ষা-চিকিৎসাবঞ্চিত মানুষের সংখ্যা গত ৫০ বছরে অনেক কমে এলেও সব নাগরিকের জীবনে মৌলিক চাহিদা এখনো নিশ্চিত হয়নি।

পুষ্টিকর খাবার ও সুপেয় পানি দূরে থাক, ন্যূনতম খাবার ও পানির সুবিধাও পাচ্ছে না অনেক নাগরিক। স্বাস্থ্যব্যবস্থার অনেক উন্নয়ন হওয়া সত্ত্বেও এর ফাঁকফোকরগুলো দেখা গেছে গত বছর করোনা দুর্যোগের সময়। যেমনটা বলেছেন অরুন্ধতী রায়-‘করোনা আসলে একটা এক্সরে, সেটা অর্থনীতি আর স্বাস্থ্যব্যবস্থার কঙ্কালের ছবি বের করে এনেছে।

আমরা অবশ্যই জানতাম ভেতরে একটা ভয়ংকর কঙ্কাল আছে।’ বাংলাদেশের উন্নত চিকিৎসাব্যবস্থার যতটুকু আছে সেটা কেবল ধনীদের জন্য, সাধারণ মানুষের চিকিৎসাব্যবস্থা এখনো প্রাথমিক পর্যায়ে রয়ে গেছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যুক্তরাজ্যে দ্রুত National Health Service (NHS) প্রতিষ্ঠা করা হয়। এর দূরদর্শী প্রতিষ্ঠাতা অহবঁৎরহ ইবাধহ যে দর্শনটির ওপর জোর দিয়েছিলেন সেটি হচ্ছে, ‘the essence of satisfactory health service is that the rich and poor are treated alike, that poverty is not a disability and wealth is not advantaged.’

এখনো দেশের আনাচে-কানাচে বহু মানুষ আধপেটে বা একবেলা খেয়ে বেঁচে থাকে। আমাদের উত্তরবঙ্গে মঙ্গা অবস্থা এখন আর নেই, কিন্তু তারপরও মানুষের দুরবস্থা এখনো পুরোপুরি ঘোচেনি। যা কিছু রাষ্ট্রের আয়োজন, তার ৮০ শতাংশ করছে শহুরে ধনীরা। গ্রামের মানুষ এখনো বঞ্চিত অনেক কিছু থেকে। তাই হয়তো সরকার শহরের সুবিধা গ্রামে নিয়ে যেতে চাইছে। কিন্তু শহুরে সুবিধাভোগীরা তা কতটা বাস্তবায়ন করবে তা নিয়ে সন্দেহ আছে। ‘স্বাধীনতা যুদ্ধের পরপরই দেখা গেছে, যে গ্রামের মানুষ শহরের মানুষকে একাত্তরের যুদ্ধের সময় আশ্রয় ও খাবার দিয়েছিল, তারাই যখন ১৯৭৪ সালে খাবার না পেয়ে শহরে এলো, তাদের আমরা খাবার দেয়নি। অনেকেই দুর্ভিক্ষে মারা গেল। যদিও শহরের বাড়িতে এবং দোকানগুলোতে প্রচুর খাবার মজুত ছিল।’ ২০২০ সালে করোনার সংকটের সময় দেখা গেল শহরে কাজ হারিয়ে অনেকেই তাদের গ্রামের শেকড়ে ফিরে যাচ্ছেন নিরাপত্তার খোঁজে। গ্রাম ও কৃষিকে অগ্রাহ্য করে এ দেশের কোনো অর্জনই টেকসই হবে না।

অবকাঠামোগত (ইনপুট) উন্নয়নের ক্ষেত্রে দৃশ্যমানতা যত বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে, ফলাফল (আউটপুট) বিশ্লেষণ ততটা গুরুত্ব পাচ্ছে না। যোগাযোগ ব্যবস্থায় অভূতপূর্ব উন্নয়নের পরও আমাদের যাতায়াতের গতি বাড়ছে না। ঢাকা শহরের যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নয়নের জন্য মেগা প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নের পরও অব্যবস্থাপনার কারণে আমাদের গতি বাড়বে কিনা তা নিয়ে সন্দেহ আছে। সরকারি অর্থায়নে মডেল মসজিদ নির্মাণ করেও প্রকৃত নামাজির সংখ্যা বাড়াতে পারছি না। উন্নয়ন ও স্বাচ্ছন্দ্য বাড়াতে গিয়ে আমরা পরিবেশের বিপর্যয় ডেকে আনছি।

পৃথিবীটাকে কেবল আমাদের করতে গিয়ে অন্যান্য প্রাণী, উদ্ভিদ ও প্রতিবেশের অপূরণীয় ক্ষতি করে যাচ্ছি। চলমান করোনা সংকটের উৎপত্তি নিয়ে রাজনৈতিক বিতর্ক চলতেই পারে। তবে আমার ধারণা, এটাও পরিবেশ বিপর্যয়ের একটা ফল। মহামারি বিশেষজ্ঞ রব ওয়ালেস যেমনটা বলেছেন-‘মুনাফাতাড়িত পুঁজিতান্ত্রিক যুক্তি বন্যপ্রাণীর বাস্তুতন্ত্রের ওপর দখলদারি কায়েম করেছে। ফলে মানুষ ও বন্যপ্রাণীর মধ্যে সংঘাত পরিণত হয়েছে নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপারে। এটি মানুষের মধ্যে ভাইরাস আসার পথ সুগম করেছে। কাজেই পুঁজিবাদের সংকট প্রকাশিত হয়েছে স্বাস্থ্য সংকটের রূপে এবং মানুষ আর আগের স্বাভাবিক রূপে ফিরতে পারছে না।’

শেরপুরের ঝিনাইগাতী এলাকায় মানুষ হাতির উপদ্রবে ঘুমাতে পারছে না। রাত জেগে ফসল পাহারা দিচ্ছে। গত এক দশকে কমপক্ষে ৭০ কৃষক হাতির পায়ে পিষ্ট হয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন। জাতিসংঘের অর্থায়নে বৈদ্যুতিক বেড়া দিয়েও হাতিকে ঠেকানো যাচ্ছে না।

যেখানে ছিল হাতির আবাস, সেখানে মানুষ বসতি গড়েছে বলেই এমনটি হয়েছে। হাতির আবাসে মানুষ ফসল চাষ করেছে তার নিজের খাবারের জন্য, তাই কৃষকের ফসলের ওপর হাতির আক্রমণ। তাছাড়া জেনেটিক কারণেও এ হাতির আগমন রোধ করা যাবে না। যেমনটি বলেছেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের শিক্ষক আমির হোসেন-যিনি নিজেও একজন হাতি বিশেষজ্ঞ-‘যে হাতির পালটি প্রতিবছর শেরপুরে আসে, এ পালের সর্বশেষ হাতিটি বেঁচে থাকা পর্যন্ত প্রতিবছর একই পথে একই জায়গায় হাতি আসবেই, কোনো প্রতিবন্ধকতা হাতিকে ঠেকাতে পারবে না।’

অর্থনৈতিক কাঠামোর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সংগঠন হচ্ছে ব্যাংক। ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা এবং আর্থিক নৈতিকতা ধ্বংসের মুখোমুখি। ব্যাংক বাংলাদেশের ঐতিহ্যমণ্ডিত প্রতিষ্ঠানগুলোর একটি, অথচ বর্তমানে এ দেশেই এ খাতে সবচেয়ে বেশি অরাজকতা চলছে। আজ থেকে ১০৭ বছর আগে ১৯১৪ সালে ‘কুমিল্লা ব্যাংকিং করপোরেশন’ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন এ দেশেরই ব্যবসায়ী কুমিল্লার কৃতী সন্তান নরেন্দ্র চন্দ্র দত্ত, যে ব্যাংকের শাখা ছিল দিল্লি, লক্ষ্ণৌ, কানপুর, মুম্বাই থেকে শুরু করে সুদূর লন্ডন পর্যন্ত।

ব্যাংকিং ব্যবস্থাপনায় ঐতিহ্যবাহী এ বাংলাদেশের অসংখ্য ব্যাংক আজ কু-ঋণে জর্জরিত। সঙ্ঘবদ্ধ প্রতারক গোষ্ঠী এবং উইগি’র দল কোনো কোনো ব্যাংকের প্রায় সব টাকাই বিদেশে পাচার করে দিয়েছে। বেসরকারি ব্যাংক চলছে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের টাকায়, আর সরকারি ব্যাংক চলছে সরকারের মূলধনের ভর্তুকি নিয়ে।

প্রযুক্তির ব্যবহারে আমরা অনেক দূর এগিয়েছি, বিশেষ করে ‘আইসিটি’ ক্ষেত্রে আমাদের যথেষ্ট অগ্রগতি হয়েছে; তবে এর ফলে যে ‘cyber

poverty gap’ তৈরি হয়েছে, তা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও ইউনেস্কোর ৪১তম অধিবেশনে তুলে ধরেছেন। ইউনেস্কোর মতে, স্কুল আংশিক বা পুরোপুরি বন্ধের কারণে বিশ্বের প্রায় অর্ধেক শিক্ষার্থী ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সম্প্রতি প্যারিসে অনুষ্ঠিত ইউনেস্কো সম্মেলনে বিভিন্ন বক্তার বক্তৃতায় এ বিষয়টি ফুটে উঠেছে। সবার জন্য সমান সুযোগ তৈরি করা যায়নি বিধায় দূরশিক্ষণ ও অনলাইন শিক্ষার মাধ্যমে নতুন বৈষম্য সৃষ্টি হয়েছে। বাংলাদেশ এ থেকে বাদ যায়নি।

লকডাউনের কারণে চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত অর্থনীতিকে সহায়তা দিতে সরকারি প্রণোদনায় মালিকপক্ষই বেশি লাভবান হয়েছে। ‘যদিও নয়া উদারবাদী মতামত মনে করে বেসরকারি শক্তি নিয়ন্ত্রিত দুনিয়ায় সরকার হস্তক্ষেপ করতে পারবে না, কিন্তু ধনী ও করপোরেট দুনিয়া আক্রান্ত হলে উদ্ধারের জন্য সরকারকেই হস্তক্ষেপ করতে হয়’ (নোয়াম চমস্কি, ২০২০)।

শিক্ষার হার ও শিক্ষায়তনের সংখ্যা বাড়ছে, কিন্তু সে হারে কমছে না সমাজে কুসংস্কার ও ধর্মান্ধতা। কিছুতেই সমাজের অন্ধকার দূর হচ্ছে না; বরং আরও ঘনীভূত হচ্ছে। শতভাগ বিদ্যুতায়নেও কাজ হচ্ছে না।

অনেকে বলেন, এ দেশের মানুষ ধর্মভীরু, ধর্মান্ধ নয়। প্রকৃত অবস্থা হচ্ছে, ধর্মভীরুরা যদি বিজ্ঞানমনস্ক না হয়, শিক্ষিত না হয়, তাহলে সে ধর্মান্ধ হতে বাধ্য।

বিজ্ঞানের পড়াশোনা বেড়েছে, আমরা অনেকগুলো বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় তৈরি করেছি, কিন্তু মানুষ বিজ্ঞানমনস্ক হচ্ছে না। যেমনটা আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায় একবার বলেছিলেন-‘আমি ক্লাসে এত করিয়া ছাত্রদের পড়াইলাম যে পৃথিবীর ছায়া চাঁদের উপর পড়িয়া চন্দ্রগ্রহণ হয়। তাঁহারা তা পড়িল, লিখিল, নম্বর পাইল, পাস করিল। কিন্তু মজার ব্যাপার হইল, যখন আবার সত্যি সত্যি চন্দ্রগ্রহণ হইল তখন চন্দ্রকে রাহু গ্রাস করিয়াছে বলিয়া তাঁহারা ঢোল, করতাল, শঙ্খ লইয়া রাস্তায় বাহির হইয়া পড়িল। ইহা এক আশ্চর্য ভারতবর্ষ।’

নির্বাচনব্যবস্থা নিয়ে বিতর্ক শেষ হচ্ছে না। রাজনৈতিক দলগুলোর সদিচ্ছার অভাবে পুরো ব্যবস্থাটাই ভেঙে পড়েছে। এ ব্যবস্থাটা কীভাবে আবার দাঁড়াবে, তা নিয়ে আলোচনা ও বিতর্ক চলছে। পক্ষে-বিপক্ষে যুক্তি উপস্থাপিত হচ্ছে। কিন্তু আমি আরও গোড়ায় যেতে চাই। নির্বাচনের মধ্য দিয়ে যে জনপ্রতিনিধিত্ব তৈরি হয়, তাদের কয়জন আসলে সত্যিকারের জনপ্রতিনিধি। ব্যতিক্রম ছাড়া বেশিরভাগ লোকের কাছেই জনপ্রতিনিধিত্ব এখন ব্যবসায় পরিণত হয়েছে। অনেকে বলেন, আমাদের রাজনীতি এখন ব্যবসায়ীদের হাতে চলে গেছে; কিন্তু ব্যবসা না করেও যারা রাজনীতিতে জড়িয়েছে, তাদের কয়জন জনপ্রতিনিধি হওয়ার পর ব্যবসায়ী হননি বা পরিবারের সদস্যদের ব্যবসায়ী বানাননি?

সেবা করতে করতে আগের চেয়ে আর্থিক অবস্থা খারাপ হয়ে গেছে-এমন কয়জন জনপ্রতিনিধি আছেন? প্রত্যেকেই মনে করে, অন্যান্য ব্যবসার মতো জনপ্রতিনিধিত্ব একটি লোভনীয় ব্যবসা।

লোভীরা সেখানে ভিড় করছে। প্লেটো তার ‘রিপাবলিকে’ যেমনটা বলেছিলেন-‘পাবলিক অফিসে যারাই থাকবেন তাদের খুব বেশি আর্থিক সুবিধা না দেওয়াটাই সমীচীন। কারণ তাতে ভয়টা হলো তখন পাবলিক অফিসগুলোতে স্বার্থপর লোকের ভিড় জমতে পারে।’

জনপ্রতিনিধিত্ব সামাজিক পুঁজির (social capital) বদলে এখন আর্থিক পুঁজির ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। এক সময় জনপ্রতিনিধিত্বের মূল ভিত্তি ছিল সামাজিক পুঁজি। পৃথিবীর উন্নত গণতান্ত্রিক দেশে এখনো সামাজিক পুঁজিই জনপ্রতিনিধিত্বের মুখ্য বিষয়। আমেরিকান সমাজ সংস্কারক লিডা জুডসন ১৯১৬ সালে ‘ব্যক্তি, পরিবার ও গোষ্ঠীর মধ্যে শুভেচ্ছা, সহযোগিতা, পারস্পরিক সহানুভূতি এবং সামাজিক সম্পর্ক’ বোঝাতে ‘সামাজিক পুঁজি’ শব্দটি ব্যবহার করেন। ১৯৯০-এ এসে ধারণাটি ব্যাপক পরিচিতি লাভ করে।

সাধারণভাবে মানুষের মনোগত অবস্থা বা মানসিকতার পরিবর্তন ঘটিয়ে কোনো ধরনের বৈষয়িক স্বার্থে চিন্তা না করে কাউকে সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে ব্যাপৃত করতে পারাকেই ‘সামাজিক পুঁজি হিসাবে চিহ্নিত করা হয়। এটি সামাজিক বা গোষ্ঠীগত দায়বদ্ধতা থেকে উৎসারিত এবং চূড়ান্ত পর্যায়ে তা জনকল্যাণে নিবেদিত। এর সঙ্গে হৃদয় উৎসারিত আবেগ জড়িত, এটি একটি আবেগমিশ্রিত যৌগিক বিষয়।’ এর সঙ্গে অর্থ, বিত্ত-বৈভব এবং ব্যবসার কোনো সম্পর্ক নেই।

মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা এবং দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক উন্নয়নকে বর্তমান ক্ষমতাসীন দল তাদের ‘ক্যাশ কাউ’ হিসাবে ব্যবহার করলেও বর্তমান সংকটগুলোও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস, আমাদের মুক্তির সংগ্রামের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট ও জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অবদান নতুন প্রজন্মের কাছে বারবার তুলে ধরতে হবে, যাতে তারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে প্রবীণদের নিয়ে। ‘স্মৃতি এমনিতেই মিথ্যাবাদী। আর যত সময় যায় যে-কোন ব্যক্তির স্মৃতিতেই মিথ্যার ভারে সত্য চাপা পড়ে যেতে পারে।… স্মৃতি তো একটা আর্কাইভ। সরকারি বেসরকারি সব নথিখানার মতোই স্মৃতির আর্কাইভও বিশেষ বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গি ও প্রবণতা অনুযায়ী বাছাই করার দলিল ভর্তি থাকে’ (রণজিৎ গুহ, রচনা সমগ্র, ইতিহাস-সমাজ-রাজনীতি; পৃষ্ঠা-১৩৩)। মুক্তিযুদ্ধ, রাস্তাঘাট, সেতু ও অন্যান্য অবকাঠামোগত উন্নয়ন দেখিয়ে যারা রাজনৈতিক সমর্থন নিতে বেশি আগ্রহী, তাদের জন্য ২০০২ সালের অর্থনীতিতে নোবেল বিজয়ী মনোবিজ্ঞানী ড্যানিয়েল ক্যায়েনম্যানের একটি উক্তি স্মরণ করিয়ে দিতে চাই-‘মানুষ ঝুঁকি নিতে চায় না।

লাভের চেয়ে ক্ষতিকে অনেক বেশি ঘৃণা করে, উপকারের চেয়ে অপকারকে বেশি গুরুত্ব দেয়। মানুষ পুরোনো অতীত ভুলে যায়, বর্তমানের প্রতি বেশি সংবেদনশীল।’ মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস, মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের লোকদের জন্য বড় একটি মূলধন; এটা বলতেই হবে। তবে এটা দিয়ে রাজনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন কঠিন হবে।

সমাজ ও রাজনীতির দৃশ্যমানতা, অন্যায্যতা, করোনা সৃষ্ট অর্থনৈতিক মন্দা, বেকারত্ব, পণ্যের উচ্চমূল্য ও দুর্নীতি এগুলো বর্তমানের বাস্তবতা। ছোটখাটো কারণেও যখন আমজনতা হিংসাশ্রয়ী হয়ে জ্বালাও-পোড়াও, ভাঙচুর করে-এগুলোকে দেখতে হবে স্থানান্তরিত ক্রোধ হিসাবে।

যেমনটা বলেছিলেন আলজেরিয়ান বিপ্লবী ও তাত্ত্বিক Franty Fanon তার ‘Black Skin White Mask’ (১৯৫২) শীর্ষক বইয়ে-‘দীর্ঘ চাপ, অবদমন, অসম্মান, নির্যাতনের মধ্যে থাকলে সমাজে হিংসা বেড়ে যায়। মানুষ যখন মূল কারণে হাত দিতে পারে না বা খুঁজে পায় না, তখন সে চারপাশের ওপর আক্রোশ বোধ করে।’ এটাকে বলা হয় স্থানান্তরিত ক্রোধ (transferred aggression), আর স্থানান্তরিত ক্রোধের লক্ষ্যবস্তু সবসময়ই হয় নিরীহ ও দুর্বল ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান (নারী, শিশু, সংখ্যালঘু এবং সংখ্যালঘুদের উপাসনালয়)। ধর্মাশ্রয়ী রাজনীতিক ও সাম্প্রদায়িক শক্তিগুলো আমজনতার ক্রোধকে স্থানান্তরিত করে ওইসব দুর্বল জায়গায় পাঠিয়ে দেয়। আক্রান্ত হয় মন্দির, পূজামণ্ডপ ও জেলেপাড়া। যদিও মানবিক মূল্যবোধের এবং অসাম্প্র্রদায়িক শক্তির প্রতিক্রিয়া (বিলম্বিত) আমাকে আশাবাদী করে। যেমনটা রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন তার ‘সভ্যতার দৈববাণী’ প্রবন্ধে-‘মনুষ্যত্বের অন্তহীন প্রতিকারহীন পরাভবকে চরম বলে বিশ্বাস করাকে আমি অপরাধ মনে করি… আশা করব, মহাপ্রলয়ের পরে নৈরাশ্যের মেঘমুক্ত আকাশে ইতিহাসের একটি নির্মম আত্মপ্রকাশ হয়তো আরম্ভ হবে এই পূর্বাচলের সূর্যোদয়ের দিগন্ত থেকে।’

যারা দেশে বিদ্যমান গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে ‘নিয়ন্ত্রিত গণতন্ত্র’ হিসাবে অবহিত করতে চান, তাদের জন্য রবার্ট কেগন তার ‘Is Democracy in Decline’ বইয়ে বলেছেন, ‘গণতন্ত্র একটি নাজুক ফুল, সবসময় এর পরিচর্যা, যত্ন-আত্তি লাগে। নিয়মিত আগাছা পরিষ্কার করতে হয়। এ ফুল রক্ষা করতে বেড়া লাগে। ভেতর-বাইরের দুই দিকের বিপদ থেকেই একে বাঁচাতে হয়?। বেড়া পাকাপোক্ত না হলে এবং আগাছা নিয়মিত সাফ করা না হলে জঙ্গল ও আগাছা ফিরে এসে তা ভূখণ্ড দখল করবেই।’

শাসনব্যবস্থার কঠোরতা নেতৃত্বের গুণ হিসাবে কেউ কেউ মনে করেন (নিকোলাস ম্যাকিয়াভ্যালি, ‘দ্য প্রিন্স’, ১৫১৫)। তবে বিরোধী মতকে কঠোর শাস্তি দিয়ে মোকাবিলা ব্যবস্থাপনার গুণ নয়। ‘রাজতন্ত্রেই কী আর শিক্ষাতন্ত্রেই কী, কঠোর শাসন-নীতি শাসয়িতারই অযোগ্যতার প্রমাণ’ (রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ‘আশ্রমের রূপ ও বিকাশ’, ১৩৪০)। লন্ডনের কিংস কলেজের অধ্যাপক Antonio Giustozzi যেমনটি বলেছেন, ‘the greatest skill is to keep all of this together despite constant friction and constant argument.’ আরেকটা কথা মনে রাখতে হবে, ‘রাষ্ট্রের সুরে সুর না মেলালেই মানুষ রাষ্ট্রদ্রোহী হয় না, হয় না রাষ্ট্রের দুশমন বা সমাজের শত্রু’ (হ্যারল্ড জোসেফ লাস্কি, ১৮৩৯-১৯৫০)।

লাস্কি ১৯৪৫-৪৬ সময়ে ব্রিটিশ লেবার পার্টি চেয়ারম্যান ছিলেন। ১৯২৬ থেকে ১৯৫০ সাল পর্যন্ত লন্ডন স্কুল অফ ইকোনমিকসের অধ্যাপক ছিলেন। আমাদের জাতীয় অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাকের অসমাপ্ত পিএইচডি থিসিসের তত্ত্বাবধায়ক ছিলেন।

অধ্যাপক রাজ্জাকের থিসিসের কাজ চলাকালীন অকস্মাৎ লাস্কির মৃত্যু হয়। তারপর রাজ্জাক স্যার দেশে ফিরে আসেন। কথিত আছে, স্যারের নাকি মনে হয়েছিল তার থিসিস তত্ত্বাবধান করার জন্য ব্রিটেনে কোনো অধ্যাপক জীবিত নেই।

ভিন্নমত, ভিন্নপথ থাকবেই; তারপরও সবাইকে নিয়ে পথ চলাই ‘এগিয়ে যাওয়া’।

ড. মীজানুর রহমান : অধ্যাপক, মার্কেটিং বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়; সাবেক উপাচার্য, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়