মকসুদ ভাইয়ের সেই পদত্যাগপত্রটি

Published: 27 February 2021

।। মহিউদ্দিন আহমদ ।।

করোনার কারণে ঘরবদ্ধ হয়ে একটি কাজ করার চেষ্টা করছি কয়েক মাস ধরে। পত্রপত্রিকার গুরুত্বপূর্ণ খবর, সম্পাদকীয়, উপসম্পাদকীয়র ক্লিপিং করা আমার অনেক বছরের অভ্যাস। পনেরো বছর আগেও গুগল, ইন্টারনেট, ফেসবুক-এসবের এমন ব্যবহার ছিল না যে, গুরুত্বপূর্ণ খবর এবং জাতীয় আইটেমগুলো ‘বুকমার্কে’ সংরক্ষণ করি। তাই ক্লিপিং করার অভ্যাস এবং প্রয়োজনমতো সংশ্লিষ্ট ক্লিপিংটি খুঁজে বের করে আমার লেখালেখিতে ব্যবহার করাকে আমি গুরুত্ব দিয়েছি।

কয়েক বছর ধরেই নিয়মিত লেখালেখি করছি না। আমার লেখালেখি কেন বন্ধ, জানতে চেয়ে নিজ থেকে ছয় মাস আগে টেলিফোন করেছিলেন দুদিন আগে প্রয়াত খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ। আমার লেখালেখিতে যে তার এমন আগ্রহ ছিল, সেদিনই প্রথম জানলাম। তার প্রশ্নের জবাবে বলেছিলাম: সত্যনিষ্ঠ, বস্তুনিষ্ঠ লেখালেখির পরিবেশ দেশে অনেক বছর ধরে অনুপস্থিত।

আর আমি যেমন খোলামেলাভাবে লিখি, তা কোনো পত্রিকা কর্তৃপক্ষ এখন ছাপাতে চায় না। কোনো রকমের ‘রিস্ক’ও তারা নিতে চায় না। আর লিখেই বা কী হবে। নীতিনির্ধারকদের মধ্যে কজন পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত সম্পাদকীয়-উপসম্পাদকীয়গুলো পড়ে দেখেন? তবে তারা আলবৎ তাদের বন্দনাকারীদের কথাগুলো গিলে খেয়ে থাকেন।

খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদকে উদাহরণ দিয়ে বললাম, প্রেসিডেন্ট কেনেডি সেই ৬০ বছর আগে ‘টাইম’ ম্যাগাজিন সম্পর্কে বলেছিলেন, আমি পত্রিকাটিকে ‘ডিজলাইক’ করি; কিন্তু তারপরও প্রকৃত তথ্য এবং নির্মোহ সুপারিশ জানতে আমাকে এ ‘ড্যাম’ পত্রিকাটি নিয়মিতই পড়তে হয়। ‘টাইম’ ম্যাগাজিন সম্পর্কে প্রেসিডেন্ট কেনেডির বহুল উদ্ধৃত সেই মন্তব্য: ‘I Read that Damn Magazine.’ খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদকে জিজ্ঞেস করলাম এমন বাস্তবধর্মী দৃষ্টিভঙ্গির একজন নেতা-নেত্রীও কি এখন আমাদের আছেন?

খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ আমার যুক্তি শুনলেন এবং বুঝলেন। তাকে চুপ থাকতে দেখে আমি বললাম, আপনি কিন্তু ভিন্ন প্রজাতির মানুষ বর্তমানকালের এই বাংলাদেশে। বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতকে আপনি যেমন নিয়মিতভাবেই ‘মনিটর’ করেন, আপনার পর্যবেক্ষণ এবং মন্তব্যগুলোকে আমাদের নিয়ন্ত্রিত গণমাধ্যমগুলোও যেমন গুরুত্ব দিয়ে প্রকাশ করে তাতেই আপনার সাহস, দলনিরপেক্ষতা ও বস্তুনিষ্ঠতার পরিচয় পাওয়া যায়। আপনি দয়া করে আপনার এ দেশপ্রেমিকের ভূমিকাটি অব্যাহত রাখুন।

দুই.

লিখছিলাম আমার ক্লিপিং সংগ্রহ, সংরক্ষণ ও ব্যবহারের কথা। সিদ্ধান্ত নিলাম পুরোনো এবং অপ্রয়োজনীয় ক্লিপিংগুলো ফেলে দিয়ে বাসাটিকে একটু হালকা করব। দেখলাম এ বাছাইপর্বে কিছু মণি-মুক্তা জাতের ক্লিপিংও হাতে পড়ছে। এমন একটি কাগজ হচ্ছে, সৈয়দ আবু মকসুদ-মকসুদ ভাইয়ের বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার উপপ্রধান বার্তা সম্পাদকের পদ থেকে ইস্তফাদানপত্র।

২০০৪ সালের ৩ মার্চ তারিখ বিশিষ্ট এ পদত্যাগপত্রটি তিনি দিয়েছিলেন যতটুকু মনে পড়ে, গাজীউল হাসান খানকে। মকসুদ ভাই তার স্বভাব-চরিত্রমাফিক এ চিঠিতে ‘বাসস’-এর ম্যানেজিং ডিরেক্টর এবং প্রধান সম্পাদকের নাম উল্লেখ করেননি। কিন্তু আমি প্রায় নিশ্চিত, গাজীউল হাসান খানই মকসুদ ভাইয়ের লেখালেখির ওপর নিয়ন্ত্রণ চাপিয়ে দেওয়ার অপচেষ্টা করেছিলেন।

মকসুদ ভাই এবং আমি সেই ’৯০-এর দশকের মাঝামাঝি সময় থেকে খুব ঘনিষ্ঠ। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আমিও দু-হাত দিয়ে লিখে চলেছি। তখন এমন দিনও গেছে, একদিনেই আমার চার-চারটি কলাম চারটি পত্রিকায় ছাপা হয়েছে। মকসুদ ভাইও তেমনই করছেন। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে বিভিন্ন সভা-সমিতিতে তিনিও থাকছেন; আমিও।

এর মধ্যে একবার আমরা দুজন যশোর-বেনাপোল-বনগাঁও-শিয়ালদহ-কলকাতা গেলাম ১৯৯৬-তে। কলকাতায় যোগ দিলেন কবি বেলাল মোহাম্মদ। কলকাতা-শান্তিনিকেতনে আমাদের তিনজনের সব কর্মকাণ্ড দেখভাল করতেন। কলকাতায় আমাদের ‘হোস্ট’ মোহাম্মদ আবু তৈয়ব এবং তার স্ত্রী রেশমা। তৈয়ব তখন কলকাতায় আমাদের ডেপুটি হাইকমিশনে প্রেস কাউন্সিলর। তৈয়ব এখন বসুন্ধরা গ্রুপের প্রধান শাহ আলমের মিডিয়া অ্যাডভাইজার।

আমরা তিনজন তৈয়বের বাসায় এক কামরায় থাকলাম কয়েকদিন। থাকি এক বড় খাটে দুজন, একজন ফ্লোরে! তিন প্রবীণ ব্যক্তি মজাই পাচ্ছিলাম তখন। মকসুদ ভাই তৈয়ব-রেশমা দম্পতির প্রশংসায় যথার্থই উচ্চকণ্ঠ। তৈয়বের বাসায় আমাদের তিনজনের থাকা-খাওয়ার কথা যখন ভাবি-লজ্জা হয়, আনন্দও পাই। তৈয়ব তার স্ত্রী রেশমা এবং তাদের কিশোরী মেয়ে তাসনীম কী করে তখন আমাদের তিনজনকে সামাল দিল!

আমাদের এই অভিজ্ঞতাগুলো নিয়ে আলাদা একটি লেখা হতে পারে। তবে এখন মকসুদ ভাইয়ের পদত্যাগপত্রটি।

তিন.

বরাবর

ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান সম্পাদক

বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা

ঢাকা,

বিষয় : পদত্যাগপত্র

মহোদয়,

সবিনয় নিবেদন এই যে, ঘটনাক্রমে আপনি বাসস-এ যোগদানের পর ঘণ্টাদু’য়ের মধ্যে প্রথম বৈঠকটি আমার সঙ্গে করেন, আমার ওই দিন (১ মার্চ) প্রথম আলোতে প্রকাশিত ‘হুমায়ুন আজাদের ওপর আঘাত-ফ্যাসিবাদের নগ্নরূপ’ শীর্ষক লেখাটি সম্পর্কে। লেখাটি থেকে ‘আপত্তিকর’ অংশ পড়েও শোনান। চিফ রিপোর্টার ও জেনারেল ম্যানেজারের উপস্থিতিতে আমার সঙ্গে ওই বৈঠকটির জন্য ব্যক্তিগতভাবে আপনার প্রতি আমার বিন্দুমাত্র অনুযোগ নেই। আপনি নিজেও বলেছেন যে, আপনি আপনার চেয়ারের দায়িত্ব পালন করছেন মাত্র এবং ‘উপরের’ নির্দেশেই তা করছেন।

আমি আমাদের প্রতিষ্ঠানের অথবা রাষ্ট্রের সঙ্গে কখনো সজ্ঞানে তাদের স্বার্থবিরোধী কোনো কাজ করিনি। আমার ৩২ বছরের চাকরিজীবনে সংস্থায় যে দায়িত্ব যখন আমাকে দেওয়া হয়েছে, তা একজন বিশ্বস্ত ভৃত্যের মতোই সাধ্যমতো পালন করেছি। তবে অফিসের বাইরে একজন স্বাধীন নাগরিক হিসেবে সভা-সমাবেশে ও লেখালেখিতে আমি আমার নিজের মতামত ব্যক্ত করে থাকি। আমার সমালোচনামূলক বক্তব্য কখনো ব্যক্তিবিশেষ, দল বা গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে যেতে পারে, যদিও নীতিগত পার্থক্য সত্ত্বেও ব্যক্তিগতভাবে আমি কোনো ব্যক্তি বা নেতার প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করি না। সরকারেরও আমি কল্যাণই কামনা করি। তবে দেশ ও জাতি এবং সরকারকে আমি এক করে দেখি না। দেশ ও জনগণের স্বার্থে সরকারের কোনো কোনো কাজের সমালোচনা করা আমার গণতান্ত্রিক ও সাংবিধানিক অধিকার।

আপনার সঙ্গে আলোচনার পরে আমাকে সিদ্ধান্ত নিতে হচ্ছে আমি স্বাধীন মত প্রকাশ করব নাকি আদেশমতো লেখালেখি বন্ধ রেখে শুধু জীবিকার জন্য নীরবে চাকরি করে যাব। ভেবেচিন্তে প্রথম পথটিই বেছে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আমার চাকরির বিনিময়ে, আমার পরিবার-পরিজনের সুখ স্বাচ্ছন্দ্যের বিনিময়ে যদি আজ আমি কোনো অন্যায়-অবিচারের প্রতিবাদ না করি, তা হবে জাতি ও দেশের কোটি কোটি নিপীড়িত, শোষিত ও দুঃখিত মানুষের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা। আমার ৪২ বছরের লেখকজীবনে আমি জ্ঞাতসারে আমার বিবেকের সঙ্গে প্রতারণা করিনি।

পাকিস্তান আমলের পূর্ব বাংলার শোষিত মানুষের জনগণতান্ত্রিক আন্দোলনে একজন ক্ষুদ্র কর্মী হিসেবে আমার নগণ্য ভূমিকার কথা সেকালের ছাত্রনেতা ও রাজনীতিকগণ অবগত। স্বাধীনতার পর থেকে দুবার আওয়ামী লীগ, দুবার বিএনপি, এমনকি জেনারেল এরশাদের আমলেও এখনকার মতোই একই রকম মতামত আমি প্রকাশ করেছি। সরকার বা বাসস কর্তৃপক্ষ বাধা দেয়নি বা চাপ সৃষ্টি করেনি। বাংলাদেশে আজ যখন বহুদলীয় গণতন্ত্র বিকাশের উজ্জ্বল সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে, সেই মুহূর্তে মত প্রকাশের ওপর এ-জাতীয় বিধিনিষেধ আরোপ বেদনাদায়ক। সেজন্যে চাকরিক্ষেত্রে আরও কোনো সমস্যা দেখা দেওয়ার আগেই আমি চাকরি থেকে ইস্তফা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।

আজ প্রতিষ্ঠান ত্যাগ করার মুহূর্তে আমার দীর্ঘদিনের সহোদরপ্রতিম সহকর্মীদের কথা মনে পড়ছে। তাদের কেউ কেউ আজ পরলোকে। কেউ প্রতিষ্ঠান ছেড়ে স্বেচ্ছায় চলে গেছেন। অনেকে দলীয়করণের কারণে নির্মমভাবে চাকরিচ্যুত হয়েছেন। লোকান্তরিতদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা এবং চাকরিচ্যুতদের প্রতি গভীর সমবেদনা জানাচ্ছি। এবং সাংবাদিক, অসাংবাদিক সহকর্মীদের এবং বাসস জেলা প্রতিনিধিদের প্রতি তাদের ভালোবাসার জন্য আমি আপনার মাধ্যমে আমার শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছি।

এই পত্র আমার পদত্যাগপত্র হিসেবে গ্রহণ করতে বিনীত অনুরোধ জানাচ্ছি। অবিলম্বে আমার পদত্যাগপত্র গ্রহণ এবং বিধি মোতাবেক আমার গ্র্যাচুইটি প্রভৃতি পাওনা পরিশোধ করে বাধিত করুন।

আপনার সঙ্গে কাজ করার সুযোগ না পেলেও কামনা করি বাসস-এ আপনার কর্মজীবন সফল ও সুন্দর হোক। বিদায়ের মুহূর্তে বাসস-এর উত্তরোত্তর উন্নতি ও সমৃদ্ধি কামনা করি।

তারিখ : ঢাকা

৩ মার্চ ২০০৪

আপনার বিশ্বস্ত

(সৈয়দ আবুল মকসুদ)

উপ-প্রধান বার্তা সম্পাদক

চার.

মকসুদ ভাই তার পদত্যাগপত্রের মূল কপিটি আমাকে কেন দিয়েছিলেন তা আমার এখন স্পষ্ট মনে নেই। হতে পারে তিনি ক্লিপিং করার আমার অভ্যাস এবং এগুলোর সংরক্ষণে আমার নিষ্ঠার কথা অবগত ছিলেন বলে তিনি ভেবেছিলেন আমার কাছে থাকলে এটি নিরাপদ থাকবে। ষোলো-সতেরো বছর পর মনে হচ্ছে, তার এমন ধারণা থেকে থাকলে, আমি তাকে হতাশ করিনি। তার এ পদত্যাগপত্রটি সংরক্ষণ করেছি এত বছর এবং তার মৃত্যুর কয়েকদিন আগে খুঁজেও পেলাম।

আমার মনে পড়ছে বাসস থেকে তার পদত্যাগের তিন-চার দিন পর তিনি আমার উত্তরার বাসায় এসেছিলেন। আমরা কয়েক ঘণ্টা গল্পও করলাম তখন। সেদিনের আলোচনার একটি বিষয় ছিল ‘বাংলাদেশের সাংবাদিকতার দুরবস্থা’। মনে পড়ে, তখন ‘মোহতারেমা’ খালেদা জিয়ার সরকারের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ এবং সিভিল সোসাইটির তীব্র সমালোচনার জবাব দিতে এবং তার সরকারের ‘উন্নয়ন’-এর গল্পগাথা তুলে ধরতে ‘মিডিয়া সিন্ডিকেট’ গঠিত হয়েছিল কয়েকজন অনুগত সাংবাদিক দিয়ে। দ্রুতই এই ‘মিডিয়া সিন্ডিকেট’ নাম নিল ‘ম্যাডামস সিন্ডিকেট’ হিসাবে!!

নীতির প্রশ্নে মকসুদ ভাইয়ের যে অনড় অবস্থান, তিনি তার এ চিঠিতে তুলে ধরেছেন, আমাদের নবীন সাংবাদিকদের কাছে তিনি একজন ‘রোল মডেল’ হিসাবে নন্দিত হতে পারেন। নীতি-আদর্শে বিশ্বাসী সাংবাদিক হিসাবে অনুসরণীয় উদাহরণ হিসাবে উল্লিখিত হতে পারেন। আমাদের দেশের সাংবাদিকতার ক্লাসগুলোয় তার এই চিঠিটি উদ্ধৃতও হতে পারে।

দেশের এবং আমাদের সাংবাদিকতার এই দুঃসময়ে আমাদের কি এমন আর একজন সৈয়দ আবুল মকসুদ আছেন?

‘শিউলীতলা’, উত্তরা

মহিউদ্দিন আহমদ : সাবেক সচিব, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়