যে ভাবে ফাঁস হয়েছিল রাবির সেই নিয়োগ বাণিজ্যের অডিও ক্লিপ
বিশেষ সংবাদদাতা, ঢাকা : রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) উপাচার্য অধ্যাপক এম আব্দুস সোবহান ও উপ-উপাচার্য চৌধুরী মোহাম্মদ জাকারিয়ার বিরুদ্ধে শিক্ষক নিয়োগে অনিয়ম ও বিভিন্ন দুর্নীতির প্রমাণ পেয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন। কমিশনের তদন্ত প্রতিবেদন ইতিমধ্যে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়সহ সংশ্লিষ্ট দপ্তরে জমা দেওয়া হয়েছে।
প্রতিবেদনে তদন্ত কমিটি ২৩টি পর্যবেক্ষণ উল্লেখ করেছেন। সেই পর্যবেক্ষণের ১৯ নম্বর পর্যবেক্ষণে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য চৌধুরী মোহাম্মদ জাকারিয়ার সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয় আইন বিভাগের শিক্ষক নিয়োগে নুরুল হুদা নামের এক প্রার্থীর স্ত্রীর সঙ্গে নিয়োগ বাণিজ্যের দর-কষাকষির একটি অডিও ক্লিপ কিভাবে ফাঁস হয়েছিল এবং এ সংক্রান্ত প্রমাণাদি উপস্থাপন করা হয়।
সম্প্রতি বাংলাদেশ প্রতিদিনের হাতে আসা তদন্ত কমিটির এই পর্যবেক্ষণে বলা হয়, কিভাবে দর-কষাকষির অডিও অনলাইনে বা সংবাদমাধ্যমে ভাইরাল হলো এ প্রশ্নের জবাবে নুরুল হুদা বলেছেন, ‘আমার স্ত্রীর ফোন থেকে অডিও সংগ্রহ করে সহকারী প্রক্টর আইন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক শিবলী ইসলাম স্যারের নিকট প্রদান করে। উদ্দেশ্য ছিল উপাচার্যকে সিন্ডিকেটের আগের ঘটনাটি অবগত করা এবং উপ-উপাচার্যের বিচার হওয়া। এরপর কিভাবে ভাইরাল হলো সে বিষয়ে আমি জানি না। আর আইন বিভাগের সভাপতি প্রফেসর মো. আব্দুল হান্নান স্যারের সাথে কথোপকথন রেকর্ড করার জন্য উপ-উপাচার্য স্যার আমাকে বলেন। আমি রেকর্ড করে সরল উদ্দেশ্যেই তা সহকারী প্রক্টর গাজী তৌহিদুর রহমানকে দেই। আমি মনে করেছিলাম সিন্ডিকেটে আমার বিষয়ে আলোচনা হবে। কিন্তু হয়নি।’
প্রসঙ্গত, গত বছর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য অধ্যাপক চৌধুরী মো. জাকারিয়া এক চাকরিপ্রত্যাশীকে চাকরি দিতে তার স্ত্রীর কাছে টাকা চেয়েছিলেন, এমন কথোপকথনের একটি অডিও রেকর্ড সামাজিক যোগাযোগের বিভিন্ন মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে।
অডিওতে রাবির আইন বিভাগের সাবেক শিক্ষার্থী ও চাকরিপ্রত্যাশী নুরুল হুদার স্ত্রী সাদিয়ার কাছে ফোনে অধ্যাপক জাকারিয়া জিজ্ঞেস করেন তারা কত টাকা দিতে প্রস্তুত আছেন। উপ-উপাচার্য এমনো আশ্বাস দেন ‘উপরে আল্লাহ তায়ালা, নিচে আমি’।
তবে অভিযোগের বিষয়ে তখন উপ-উপাচার্য অন্য একটি অডিও ক্লিপ প্রকাশ করেন। সেখানে চাকরি প্রার্থী নুরুল হুদা ও আইন বিভাগের সভাপতি প্রফেসর আব্দুল হানান্নের মধ্যে দুই লাখ টাকার বিষয়ে কথা বলতে শোনা যায়। এ বিষয়েও তদন্ত করে ইউজিসি।
তদন্ত প্রতিবেদনে ইউজিসি বলছে, অভিযুক্ত ও অভিযোগকারীর লিখিত বক্তব্য ও বিভিন্ন উৎস থেকে প্রাপ্ত তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায় যে, ভাইভা পরীক্ষার আগে আইন বিভাগের সভাপতি প্রফেসর মো. আব্দুল হান্নান নিয়োগ বোর্ডের সদস্য নিয়োগপ্রত্যাশী প্রার্থী নুরুল হুদার নিকট থেকে ইসলামী ব্যাংক লিমিটেড নীলফামারী সৈয়দপুর শাখা ৪/১১/২০১৮ তারিখে ৮০০০৭৩৯ ক্রমিকের একটি ব্যাংক জমা স্লিপের মাধ্যমে ২ লাখ টাকা গ্রহণ করেন।
অনুসন্ধান করে দেখা যায় যে, নুরুল হুদার শ্বশুর বাড়ি সৈয়দপুর ইসলামী ব্যাংকের সৈয়দপুর শাখা থেকে রাজশাহীর আলুপট্টি অ্যাকাউন্টে ২ লাখ টাকা জমা হয়েছে ট্রেডার্সের মালিক প্রফেসর মো. আব্দুল হান্নানের অ্যাকাউন্টে। নিয়োগের উদ্দেশ্যেই শ্বশুরবাড়ি থেকে এই টাকা লেনদেন করা হয়।
উপাচার্যকে এ বিষয়ে লিখিত বক্তব্যের জন্য পত্র দেওয়া হলে তিনি যে বক্তব্য দিয়েছেন, তার সঙ্গে একটি অডিও প্রেরণ করেন। উক্ত অডিওতে প্রফেসর মো. আব্দুল হান্নান ও নুরুল হুদার কণ্ঠ রয়েছে। নুরুল হুদা আব্দুল হান্নানের নিকট টাকা ফেরত চেয়েছেন। প্রফেসর আব্দুল হান্নান তার লিখিত বক্তব্যে জানান, মো. নুরুল হুদার সাথে আমার লেনদেনের বিষয়টি একান্ত ব্যক্তিগত সম্পর্কের ভিত্তিতেই সংঘটিত হয়েছিল। এর সাথে নিয়োগের কোনো সম্পর্ক নেই এবং কোনো সম্পর্ক ছিল না।
অবশ্য গত ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২০ তারিখে কমিশনে অনুষ্ঠিত সাক্ষাৎকারে কমিটির সম্মুখে নুরুল হুদা বলেন, প্রফেসর আব্দুল হান্নান তার প্রধানকৃত টাকা পরিশোধ করেছেন এবং এটা চাকরির উদ্দেশ্যে প্রদান করা হয়নি।
তবে নুরুল হুদার স্ত্রী সাদিয়া বলেন, জাকারিয়া স্যারের সাথে সৌজন্য সাক্ষাৎকারের সময় কিংবা ফোনে আলাপচারিতার সময় আমার স্বামীর নিকট আইন বিভাগের চেয়ারম্যান প্রফেসর আব্দুল হান্নানের টাকা ধার নেওয়ার বিষয়টি নিয়ে একবারের জন্যেও আলোচনা হয়নি। চৌধুরী জাকারিয়া একান্তই তার ব্যক্তিগত লেনদেন নিয়ে আমার সাথে আলোচনা করেছেন। তিনি তার ভাগনা গাজী তোহিদুর রহমানের সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলেন এবং ভাগনার ফোন নম্বর দেন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় চাকরির নিয়োগের টাকা লেনদেন একটি ওপেন সিক্রেট বিষয়।
তদন্ত প্রতিবেদন বলছে, নুরুল হুদা একজন দরিদ্র মেধাবী শিক্ষার্থী যিনি অর্থনৈতিক টানাপোড়নের মাধ্যমে লেখাপড়ার সমাপ্ত করেছেন। তিনি ভাইবা পরীক্ষার আগে নিয়োগ বোর্ডের সদস্যকে শ্বশুরবাড়ি থেকে এনে ২ লাখ টাকা ধার দেন। তার নিয়োগ নিশ্চিত করতে না পারায় প্রফেসর আব্দুল হান্নান উক্ত টাকা ফেরত দেন। আগে কখনো প্রফেসর আব্দুল হান্নানকে টাকা ধার দিয়েছিলেন কি না, জানতে চাইলে নুরুল হুদা বলেছেন, প্রফেসর আব্দুল হান্নানকে আগে কখনো টাকা ধার দেয়নি।
ইউজিসির প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, সিলেকশন বোর্ডের সদস্য নিয়োগ প্রার্থীর ছাত্রের নিকট থেকে টাকা ধার করার বিষয়টি নিয়োগের উদ্যেশ্যই। এতে ধরে নেওয়া যায়, এতে তার নৈতিক স্খলন প্রমাণ করে যে চাকরিবিধি মোতাবেক তা শাস্তিযোগ্য।
অন্যদিকে, উপ-উপাচার্য চৌধুরী মোহাম্মদ জাকারিয়া ও চাকরি প্রার্থী নুরুল হুদার স্ত্রীর কথোপকথন রেকর্ডের ২ লাখ টাকা ধার প্রদানের বিষয়টি ভাইভার আগের দিন জানানোর পরও উপাচার্য আইন বিভাগের সিলেকশন কমিটি বাতিলের সুপারিশ করেননি এবং ঘটনাটি কেন তদন্তের ব্যবস্থা হয়নি এই বিষয়টি প্রশ্নবিদ্ধ।