টিকা নিয়ে কোনো দ্বিধা নয়
।। আ ব ম ফারুক।।
ফাইজার-বায়োএনটেকের টিকা নেওয়ার পর নরওয়েতে ২৩ জনের মৃত্যুর ঘটনাটি ছিল গত কয়েক দিনের মিডিয়ার উল্লেখযোগ্য খবর। সেই সঙ্গে জানা গেল যে একই টিকা নিয়ে এর আগে পর্তুগালে একজন নার্সেরও মৃত্যু হয়েছে। ভারতের মধ্য প্রদেশেও নাকি টিকা নিয়ে একজন মারা গেছে। লোকমুখে প্রচার হয়েছে যে এটির কারণ ছিল অক্সফোর্ডের টিকা।
এখন পর্যন্ত যেসব টিকা বেরিয়েছে সেগুলো যারা নিতে পেরেছে তাদের আমরা সৌভাগ্যবান মনে করছি। আমাদের দেশে টিকা এসে গেছে। এখন আমরাও অধীর আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছি কবে টিকা নেওয়ার সুযোগ পাব। এ রকম অবস্থায় টিকা নেওয়ার পর তার কোনো বিরূপ প্রতিক্রিয়ার ঘটনা কিংবা মৃত্যুর খবর আমাদের প্রচণ্ড নাড়া দেয়। মনে হয় যেন এই হতাশাজনক নিষ্ঠুর প্রাণঘাতী অন্ধকার সুড়ঙ্গ থেকে বুঝি আমরা আর বেরোতে পারব না।
প্রখ্যাত চিকিৎসা সাময়িকী ব্রিটিশ মেডিক্যাল জার্নাল (বিএমজে) গত ৮ জানুয়ারি ২০২১ নরওয়েতে ফাইজার-বায়োএনটেকের টিকা নেওয়ার ফলে ৮০ বছরের বেশি বয়সী ২৩ জন বৃদ্ধ-বৃদ্ধার মৃত্যু সংবাদটি প্রকাশের পর সে দেশের সরকারের পক্ষ থেকে খুব বেশি বয়স্ক মানুষদের এই টিকা দেওয়ার আগে আরো সতর্ক হওয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে। মরদেহ ব্যবচ্ছেদ করার পর জানা গেছে, এই ২৩ জনের মধ্যে ১৩ জন শুরুতে টিকার স্বাভাবিক পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াতেই আক্রান্ত হয়েছিলেন, কিন্তু অত্যধিক বয়সের কারণে এগুলোই একসময় মারাত্মক আকার ধারণ করে বলে নিউ ইয়র্ক পোস্ট জানিয়েছে। নরওয়েজিয়ান মেডিসিন এজেন্সি (নোমা) বলেছে যে ফাইজার-বায়োএনটেক এবং মডার্নার দুটি টিকা ইউরোপে হাজার হাজার স্বেচ্ছাসেবকের ওপর পরীক্ষা করার পরই অনুমোদন দেওয়া হয়। এঁদের মধ্যে অনেকেরই বয়স ছিল ৮০-৯০-এর মতো, তবে গড়ে ৫০ বছর বয়সীরাই ছিলেন বেশি। সে সময় অতি বৃদ্ধদের শরীরে কোনো অস্বাভাবিক বা মারাত্মক প্রতিক্রিয়া দেখা যায়নি। প্রথম পর্যায়ে যাঁদের টিকা দেওয়া হয় তাঁদের মধ্যে অতি বয়স্কদের নার্সিং হোমগুলোও ছিল। কারণ এই হোমগুলোর অধিবাসীদের করোনাভাইরাস সহজেই কাবু করতে পারে। নরওয়েজিয়ান ইনস্টিটিউট অব পাবলিক হেলথের এ সম্পর্কিত বিবৃতি থেকে দেখা যায় যে টিকার সাধারণ প্রতিক্রিয়াগুলোই তাঁদের শরীরে এমন বড় হয়ে দেখা দিয়েছিল যে মাত্রাতিরিক্ত বয়সের কারণে তাঁরা তা সামাল দিতে পারেননি। তাঁদের শরীরের প্রতিরক্ষার ভঙ্গুর অবস্থাটা টিকাদানকারীরা বিবেচনায় নিতে পারেননি। এই ঘটনা টিকা প্রদানের সময় কী কী বিষয়ের দিকে লক্ষ রাখতে হবে তা আরেকবার দেখিয়ে দিল। ইউরোপিয়ান মেডিক্যাল এজেন্সির প্রধান এ ঘটনার পর বলেছেন যে টিকার নিরাপত্তার বিষয়গুলো আরো কড়াকড়িভাবে মেনে চলতে হবে, বিশেষ করে তা যদি নতুন প্রযুক্তি এম-আরএনএ ধরনের টিকা হয়।
এদিকে ১ জানুয়ারি ২০২১ তারিখে পর্তুগালে একজন নার্সের মৃত্যুর খবরও গণমাধ্যমে আসে। তিনি এর দুদিন আগে ফাইজার-বায়োএনটেকের টিকা নিয়েছিলেন। ৪১ বছর বয়সী এই ভদ্রমহিলার বাবা ডেইলি মেইল পত্রিকাকে বলেছেন যে তাঁর মেয়ে টিকা নেওয়ার পর একেবারেই সুস্থ ছিল। কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াও দেখা দেয়নি। তাকে কখনোই অসুস্থ বলে মনে হয়নি। পর্তুগালে টিকা পৌঁছে ডিসেম্বরের ২৮ তারিখে। তিনি পর্তুগালের একটি ক্যান্সার হাসপাতালের নার্স ছিলেন। ফ্রন্টলাইন যোদ্ধা হিসেবে তাঁকে ৩০ তারিখে টিকা দেওয়া হয় এবং টিকার পর তাঁর কোনো সমস্যা হয়নি। তাঁর মেয়ে জানিয়েছে যে কেমন লাগছে জিজ্ঞেস করায় ইঞ্জেকশনের জায়গায় সামান্য ব্যথার কথা তার মা জানিয়েছিলেন। এ ছাড়া আর কোনো সমস্যা ছিল না। টিকা নেওয়ার পরই মাস্ক পরিহিত কিছুটা স্থূলকায় এই নার্স ফেসবুকে লিখেছিলেন, ‘কভিড-১৯ ভেক্সিনেটেড’। তিনি পরিবারের সঙ্গেই থাকতেন। তবে নববর্ষের দিনে মারা যাওয়ার সময় তিনি তাঁর পার্টনারের বাড়িতে ছিলেন, নিজ বাড়িতে নয়। তাঁর হাসপাতাল জানিয়েছে, তারা অটোপসি করে মারা যাওয়ার কারণ জানার চেষ্টা করবে।
তবে বাংলাদেশে উপরোক্ত ঘটনা দুটির চেয়ে যেটি বেশি প্রচার পেয়েছে, তা হলো ভারতে সিরাম ইনস্টিটিউটের তৈরি অক্সফোর্ডের টিকা নেওয়ার পর একজন মারা গেছে। এটি সত্য নয়। যেটি জানা গেল, তা হলো ভারতের মধ্য প্রদেশের ভুপালের ৪২ বছর বয়সী একজন শ্রমিক, যাঁর নাম দীপক মারায়ী, গত ডিসেম্বরের ১২ তারিখে ভারত বায়োটেকের মানব শরীরে পরীক্ষাধীন ‘কোভ্যাক্সিন’ নামের টিকা নিয়েছিলেন। এটি অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়-অ্যাস্ট্রাজেনেকার আবিষ্কৃৃত ও ভারতের সিরাম ইনস্টিটিউটের তৈরি ‘কোভিশিল্ড’ নয়। সে সময় ভারত বায়োটেকের এই টিকার তৃতীয় পর্যায়ের ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল চলছিল এবং তিনি একজন নিবন্ধিত স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে টিকা নিয়েছিলেন। ভারতীয় বার্তা সংস্থা প্রেস ট্রাস্ট অব ইন্ডিয়া এবং দিল্লির ইংরেজি পত্রিকা ‘জাগরণ’ থেকে জানা যায় যে তিনি স্বেচ্ছায় সব নিয়ম-কানুন মেনেই এই ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে অংশ নিতে রাজি হয়েছিলেন, তাঁকে নিবন্ধনের সময় স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা হয়েছিল এবং সেদিন টিকা দেওয়ার আগে তাঁর সম্মতিও নেওয়া হয়েছিল।
তাঁর পরিবারের ভাষ্য অনুযায়ী, টিকা নেওয়ার পর তিনি অস্বস্তি বোধ করতে থাকেন এবং কিছু সমস্যার কথা বলেন। টিকা নেওয়ার পাঁচ দিন পর তিনি ঘাড়ে ব্যথা অনুভব করেন। তার দুদিন পর তাঁর মুখ থেকে ফেনা বের হয়। কিন্তু তিনি হাসপাতালে যেতে বা ডাক্তার দেখাতে রাজি হননি। তিনি পরিবারকে বলছিলেন যে এগুলো দু-এক দিনে ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু ২১ ডিসেম্বর অবস্থার অবনতি হলে তাঁকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার সময় তিনি পথে মারা যান।
মধ্য প্রদেশের মেডিকো-লিগ্যাল ইনস্টিটিউটের পরিচালক এ বিষয়ে বলেন, যাঁরা তাঁর পোস্টমর্টেম করেছেন, তাঁরা সন্দেহ করছেন যে বিষাক্ত কিছু খাওয়ার ফলে তাঁর মৃত্যু হয়েছে। তবে ভিসেরা পরীক্ষা করলে সত্যি কারণটা জানা যাবে বলে তা করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
যেকোনো মৃত্যুই আমাদের জন্য বেদনার। আমরা টিকা নেওয়ার পর মৃত্যুর তিনটি ঘটনার বিবরণ থেকে অনুমান করি যে নরওয়ের ২৩ জনের মৃত্যুর সঙ্গে টিকার সম্পর্ক রয়েছে। যেখানে অতি বৃদ্ধ, শিশু ও গর্ভবতী মায়েদের বর্তমানের টিকাটি দিতে বারণ করা হয়েছে, সেখানে একেবারে জবুথবু বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের এই টিকা দেওয়া উচিত হয়নি। ফাইজার-বায়োএনটেকের উচিত ছিল বিষয়টি আরো স্পষ্ট করে টিকার ব্যবহারবিধি ও নির্দেশনামায় বলা। আর টিকা প্রয়োগকারীদের উচিত ছিল টিকাগ্রহীতার শারীরিক অবস্থা দেখে তাদের শরীরের ইমিউনিটির সম্ভাব্য অবস্থা সম্পর্কে অনুমান করে তাদের টিকা না দেওয়া। কারণ এটি স্বতঃসিদ্ধ যে অতি বয়স্কদের ইমিউনিটি কম থাকে এবং তাঁরা দুর্বল স্বাস্থ্যের হলে তা আরো কম থাকে। কিংবা করোনায় আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা খুব বেশি থাকলে তাঁদের স্বাভাবিক মাত্রার অর্ধেক মাত্রা দেওয়া উচিত ছিল। অনেক ওষুধের বেলায়ই তা করা হয়ে থাকে।
দ্বিতীয় ঘটনাটি অর্থাৎ পর্তুগালের এই নার্সের টিকাজনিত কোনো সমস্যাই ছিল না। টিকা নেওয়ার পর কোনো সমস্যা হলে তা টিকা নেওয়ার আধাঘণ্টার মধ্যেই দেখা দেয়। তাঁর বেলায় সে রকম কোনো ঘটনা ঘটেনি, এমনকি ২৪ বা ৪৮ ঘণ্টা পরেও নয়। তাই সম্ভবত এই মৃত্যুর ঘটনাটি টিকা নেওয়ার সঙ্গে সম্পর্কিত নয়। তবে অটোপসি রিপোর্ট এলেই প্রকৃত কারণটি জানা যাবে।
তৃতীয় ঘটনাটি অর্থাৎ ভারত বায়োটেকের টিকা নেওয়ার ৯ দিন পর একজনের মারা যাওয়ার ঘটনাটি আপাতদৃষ্টিতে খাদ্য বা পানীয়ে বিষক্রিয়ার কারণে ঘটেছে বলেই মনে হয়। কারণ টিকা নেওয়ার সঙ্গে সাত দিন পর মুখ দিয়ে ফেনা বেরোনোর সামান্য যোগসূত্রও নেই। তা ছাড়া তিনি অসুস্থতা বোধ করা সত্ত্বেও ডাক্তারের কাছে বা হাসপাতালে যেতে না চাওয়াটা সন্দেহজনক। ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে নিবন্ধিত হওয়ার পর বা পরীক্ষাধীন টিকা নেওয়ার পর তাঁর যাবতীয় অসুস্থতার চিকিৎসা একেবারে বিনা মূল্যে করার দায়িত্ব নিবন্ধনকারী সংস্থার। এমনকি তিনি খারাপ কিছু হলে ক্ষতিপূরণও পেতেন। ক্লিনিক্যাল স্টাডির এটাই নিয়ম। কিন্তু তিনি ডাক্তারের কাছে যেতেই রাজি ছিলেন না। সম্ভবত গেলে তাঁর এমন কিছু কাজ প্রকাশ হয়ে যাবে, যা ক্লিনিক্যাল স্টাডির সময় তিনি করতে পারবেন না বলে অঙ্গীকারবদ্ধ ছিলেন, তাই যেতে চাননি।
কোনো টিকাই শতভাগ নিরাপত্তা দেয় না। তাই টিকা নিলেই সবাই করোনামুক্ত হবেন না। কিছু মৃত্যুর ঘটনা ঘটবে। এটা মেনে নিতে হবে। কিন্তু আশ্চর্য হই যে ভারতে একজন মারা যাওয়ার এই শেষোক্ত ঘটনাটিকে বিকৃত করে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় আবিষ্কৃৃত ও সিরাম ইন্ডিয়ার উৎপাদিত টিকার ঘাড়ে চাপিয়ে কারা কী ফায়দা নিতে চান? আমাদের দেশে এই টিকাটি চলে এসেছে। এটি বিতরণ ও প্রয়োগের জন্যও সব কিছু প্রস্তুত বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন। প্রতিদিনই করোনায় নতুন নতুন আক্রান্ত হওয়া ও মারা যাওয়ার দুঃসংবাদগুলো আমাদের শুনতে হচ্ছে। টিকা নিলে আমরা যেখানে বেশ কিছুটা নিরাপত্তা পাই, সেখানে ইন্টারনেটে যাঁরা এই টিকার বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালাচ্ছেন তাঁরা কারা? অন্য আরেকটি টিকা নেওয়ার পর মৃত্যুর ঘটনা এই টিকার নামে চালাচ্ছেন কি এটি বাংলাদেশে আনা হচ্ছে বলে? এতে তাঁরা কী অর্জন করতে চান? আরো বেশি আক্রান্ত হওয়া ও আরো বেশি মানুষ মারা যাওয়ার মতো অমানবিক ও নিষ্ঠুর প্রত্যাশাই কি তারা করছেন?
জনস্বাস্থ্য রক্ষার স্বার্থে এসব অসত্য প্রচার ইন্টারনেট থেকে দ্রুত সরানোর জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন জানাচ্ছি।
লেখক : অধ্যাপক ও পরিচালক, বায়োমেডিক্যাল রিসার্চ সেন্টার; সাবেক ডিন ফার্মেসি অনুষদ; ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়