হিংসা-বিদ্বেষ ও ক্রোধ দূর করুন: সুস্থ থাকুন
।। জাফর আহমাদ।।
আনাস রা: বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “তোমরা কি আবু দামদামের মতো হতে পারো না? সাহাবীগণ প্রশ্ন করলেন, আবু দামদাম কে? তিনি বলেন, “তোমাদের পূর্বের যুগের একজন মানুষ। তিনি প্রতিদিন সকালে (নীচের দু’আটি) বাক্যটি বলতেন। অন্য বর্ণনায়, “তিনি বলতেন, আমাকে যে গালি দেয় আমি আমার সম্মান তাকে দান করলাম।” হাদীসটির সনদ সহীহ। (আবু দাউদ, কিতাবুল আদাব, বাব মা জাআ ফির রাজুলি)
রাগ-ক্রোধ, হিংসা-বিদ্বেষ মন-মননকে কুলষিত করে, চরিত্রকে করে কালিমাযুক্ত, শরীর অসুস্থ হয়। আমরা যদি নিজেদেরকে এগুলো থেকে মুক্ত করতে পারি তাহলে নিজেই বেশী উপকৃত হবো। অন্তর হিংসার কঠিণ ভার থেকে মুক্ত হবে। দেহ-মন সুস্থ থাকবে। সার্বিক প্রশান্তি লাভ করবো। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ ব্যাপারে বিশেষ তাগিদ প্রদান করেছেন এবং একটি দু’আও শিক্ষা দিয়েছেন। কারো প্রতি রাগ সৃষ্টি হলে বা কারো প্রতি বিদ্বেষ দাঁনা বেধে উঠলে এই দু’আ পড়তে হবে,“ আল্লাহুম্মা ইন্নি ক্বাদ তাসাদ্দাকতু বি’ইরদী আ’লা ইবাদিকা।” অর্থাৎ “হে আল্লাহ! আমি আমার মর্যাদা-সম্মান আপনার বান্দাগণের জন্য দান করলাম।”
চলুন, আমরা সকলেই আবু দামদামের মতো হওয়ার চেষ্টা করি। যারা আমাদের গিবত করেছেন, নিন্দা করছেন, গালি দিচ্ছেন তাদের সবাইকে ক্ষমা করে দেই। কি লাভ এগুলোর প্রতিশোধ নিয়ে? বরং লাভের পরিবর্তে এগুলো আপনার আমার দেহ-মনকে ভারাক্রান্ত করে তুলে। বাংলা সাহিত্যের একজন পরিশীলিত সাহিত্যিক বলেছেন,“ভুলে যাওয়াটাও আল্লাহর এক বিশেষ রহমত।” তিনি বলেছেন, প্রতিদিন আমরা নানা প্রকৃতির লোকের সাথে যোগাযোগ করে থাকি। এদের অনেকে মনে কষ্ট দেয়, গালি দেয়, কটু কথা বলে, দূর্ব্যবহার করে এগুলো যদি মানুষ নিজের মধ্যে জমা করে রাখতো তাহলে আমাদের প্রাত্যহিক জীবন ব্যবস্থা অচল হয়ে পড়তো। সামাজিক যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতো। কিন্তু এগুলো আমরা ভুলে যাই বলে সমাজ ও সভ্যতা এখনোও টিকে আছে। অন্যথায় সামাজিক বিপর্যয় সৃষ্টি হতো।
আমরা ক্ষমা করি। মহান আল্লাহ তা’আলাও ক্ষমা করতে বলেছেন। তাহলে আমরাও মহান প্রভুর ক্ষমা পাবো। আল্লাহ তা’আলা কুরআনে মুসলমানদেরকে একটি গুরুত্বপূর্ণ নৈতিক শিক্ষা দিয়েছেন। “হে আমাদের রব! আপনি আমাদের ক্ষমা করুন এবং আমাদের পূর্বে যারা ঈমানের সাথে বিদায় হয়েছেন তাদেরকেও ক্ষমা করুন। আর মু’মিনগণের বিরুদ্ধে আমাদের হৃদয়ে হিংসা,বিদ্বেষ রাখবেন না। হে আমাদের রব! নিশ্চয় আপনি মহা করুণাময়, পরম দয়ার্দ।” (সুরা হাশর:১০)
এ আয়াতের দাবী হলো, কোন মুসলমান অন্য কোন মুসলমানদের বিরুদ্ধে ঘৃনা-বিদ্বেষ ও শত্রুতা থাকা উচিত নয়। মুসলমানদের সঠিক জীবনাচার হলো, তাদের পূর্ববর্তী মুসলমান ভাইদের লানত বা অভিশাপ দেবে না কিংবা তাদের সাথে সম্পর্কহীনতার কথা বলবে না। বরং তাদের মাগফিরাতের জন্য দু’আ করতে থাকবে। যে বন্ধন মুসলমানদের পরস্পর সম্পর্কিত করেছে তাহলো ঈমানের বন্ধন। কোন ব্যক্তির অন্তরে অন্য সব জিনিসের চেয়ে ঈমানের গুরুত্ব যদি অধিক হয় তাহলে ঈমানের বন্ধনের ভিত্তিতে তার ভাই, সে অনিবার্যভাবেই তাদের কল্যাণকামী হবে। তাদের জন্য অকল্যাণ, হিংসা-বিদ্বেষ এবং ঘৃণা কেবল তখনই তার অন্তরে স্থান পেতে পারে যখন ঈমানের মূল্য ও মর্যাদা তার দৃষ্টিতে কমে যাবে এবং অন্য কোন জিনিসকে তার চেয়ে বেশী গুরুত্ব দিতে শুরু করবে। তাই ঈমানের সরাসরি দাবী, একজন মু’মিনের অন্তরে অন্য কোন মু’মিনের বিরুদ্ধে ঘৃণা ও হিংসা-বিদ্বেষ থাকবে না।
আনাস রা: থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, এক সময় রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মজলিসে একাধারে তিন দিন একটি ঘটনা ঘটতে থাকলো। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলতেন: এখন তোমাদের সামনে এমন এক ব্যক্তির আগমন হবে যে জান্নাতের অধিবাসী। আর প্রত্যেকবারই একজন আনসারদের কোন একজন হতেন সেই আগন্তুক। এতে আব্দুল্লাহ ইবনে আসের মধ্যে কৌতুহল দেখা দিল যে, তিনি এমন কি কাজ করেন যার ভিত্তিতে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর সম্পর্কে বারবার এই সুসংবাদ দান করলেন। সুতরাং তার ইবাদাতের অবস্থা দেখার জন্য একটা উপলক্ষ সৃষ্টি করে তিনি পরপর তিনদিন তাঁর বাড়ীতে গিয়ে রাত কাটাতে থাকলেন। কিন্তু রাতের বেলা তিনি কোন প্রকার অস্বাভাবিক কাজ-কর্ম দেখতে পেলেন না। বাধ্য হয়ে তিনি তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন: ভাই আপনি এমন কি কাজ করেন, যে কারণে আমরা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মুখে আপনার সম্পর্কে বিরাট সুসংবাদ শুনেছি। তিনি বললেন: আমার ইবাদাত-বন্দেগীর অবস্থা তো আপনি দেখেছেন। তবে একটি বিষয় হয়তো এর কারণ হতে পারে। আর তাহলো,“আমি আমার মনে মধ্যে কোন মুসলমানদের জন্য বিদ্বেষ পোষণ করি না এবং মহান আল্লাহ তাকে যে কল্যাণ দান করেছেন সে জন্য তাকে হিংসাও করি না।” (নাসাঈ)
তবে এর মানে এই নয় যে, কোন মুসলমান অন্য কোন মুসলমানের কথ ও কাজে যদি কোন ত্রুটি দেখতে পান তাহলে তাকে তিনি ত্রুটি বলবেন না। কোন ঈমানদার ভুল করলেও সেটাকে ভুল না বলে শুদ্ধ বলতে হবে কিংবা ভ্রান্ত বলা যাবে না ঈমানের দাবী কখনো তা নয়। কিন্তু কোন জিনিসকে প্রমাণের ভিত্তিতে ভুল বলা এবং ভদ্রতা রক্ষা করে তা প্রকাশ করা এক কথা আর শত্রুতা ও হিংসা-বিদ্বেষ পোষণ করা নিন্দাবাদ ও কুৎসা রটনা করা এবং গালমন্দ করা আরেক কথা। সমসাময়িক জীবিত লোকদের বেলায়ও এরূপ আচরণ করা হলে তা একটি বড় অন্যায়। কিন্তু পূর্বের মৃত লোকদের সাথে এরূপ আচরণ করলে তা আরো বড় অন্যায়। কারণ এরূপ মন ও মানসিকতা এমনই নোংরা যে, তা মৃতদেরও ক্ষমা করতে প্রস্তুত নয়।
হৃদয়কে হিংসা, বিদ্বেষ ও অন্যের অকল্যাণ চিন্তা থেকে পবিত্র রাখার অভাবনীয় সওয়াবের কথা আমরা জানতে পারলাম। আমরা দেখেছি যে, এভাবে হৃদয়কে বিদ্বেষ, হিংসা ও ঘৃণামুক্ত রাখা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অন্যতম সুন্নাহ যা তিনি বিশেষভাবে পালন করার নির্দেশ দিয়েছেন। একটু চেষ্টা করলে আল্লাহর রহমতে আমরাও এ গুণ অর্জন করতে পারবো। গালি শুনে, গীবতের কথা শুনে বা অন্য কোন কারণে কারো বিরুদ্ধে মনের মধ্যে ক্রোধ, হিংসা, বা বিদ্বেষ সঞ্চিত হলে বেশী বেশী আল্লাহর যিক্রের মাধ্যমে মনকে যথাশীঘ্র শান্ত করার চেষ্টা করতে হবে। কিছুটা শান্ত হলে নিজের জন্য এবং ঐ ব্যক্তির জন্য আল্লাহর কাছে দু’আ করতে হবে। যেন আল্লাহ আমাকে ও তাকে মাফ করে দেন এবং উভয়কে যেন আল্লাহ তাঁর সন্তুষ্টির পথে চলার তাওফিক দেন।