বাবা-মায়ের ভালবাসা

Published: 28 June 2021

।। জাফর আহমাদ ।।

আমাদের এই জগৎ সংসারে অনেক এমন বাবা রয়েছেন, যাদের সন্তানের প্রতি অগাধ ভালবাসাটুকু তাঁদের সন্তানেরা তাৎক্ষণিকভাবে উপলব্ধি করতে পারে না।

কিন্তু বয়স বাড়ার সাথে সাথে বা বয়সের পরিপূর্ণতায় উপনিত হওয়ার পর বাবার সেই ভালবাসাকে তাঁর সন্তানেরা দারুনভাবে উপভোগ করে। এবং বাবার সেই কঠিণ শাসণকে অত্যন্ত তৃপ্তি সহকারে স্মরণ করে পুলকিত হয়। সত্যি অনেক এমন বাবা রয়েছেন, যাঁরা বাহ্যিকভাবে শক্ত ও কঠিন হৃদয়ের অধিকারী বলে মনে হয়। কিন্তু অত্যন্ত গভীরভাবে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে যে, বাবার সেই কঠিণ পাথুরে হৃদয়ের অভ্যন্তরে ভালবাসার একটি বিশাল নদী খলখল রবে সদায় প্রবাহিত হচ্ছে। সন্তানের অনাগত ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে বাবার ভেতরকার সেই ভালবাসার নদীটি কখনো উপচে (ঙাবৎ ঋষড়) যায় না। ফলে অনেক সন্তানেরা বাবার ভালবাসাকে তাৎক্ষণিকভাবে উপলব্ধি করতে পারে না।

আর তাই চলাফেরার পথে আমরা বলে থাকে ‘আমার বাবা খুব কড়া ও কঠিন মানুষ ছিলেন’। অবশ্য কোন সন্তানের এই উক্তি বাবার প্রতি কোন অভিযোগ বা অনুযোগ নয় বা কোন বিরক্তির অভিব্যক্তিও নয়। বরং বাবার প্রতি কৃতজ্ঞতার বহি:প্রকাশ। বাবার কঠিন বাঁধন আর শাসনের কারণেই তো আজ সে এখানে এ পর্যায়ে পেঁৗঁছেছে।

আমাদের শ্বাসত পারিবারিক জীবনে বাবা যে শুধুই কঠিন তা নয়। আমরা অনেক বাবাকে সন্তানদের বন্ধু হিসেবেও দেখতে পাই। এই বাবারা সাধারণত তাঁদের সন্তানদের সাথে অত্যন্ত খোলামেলা পরিবেশে থাকতে ভালবাসেন বা এটা আধুনিক সমাজের একটি কৌশল। তবে এখানে ব্যতিক্রমর্ধী একটি বিষয় নযরে পড়ে, সেটি হলো, যেই সংসারে বাবা সন্তানদের সাথে বন্ধু ভাবাপন্ন, উদার ও খোলমেলা, সেই সংসারে মা সাধারণত খুবই কঠিন ও শক্ত মনোভাবের হয়ে থাকেন। তবে এই নরম গরম পারস্পরিক পরিস্পুরক এবং একটি ভারসাম্য পারিবারিক পরিবেশ সৃষ্টির জন্য ও সন্তানদের উন্নত জীবন গঠণের প্রয়োজনীয়তায় এটি অনস্বীকার্য। তবে কোনটি ভালো, বাবা উদার হবে না কি মা, সেই বিতর্ক এখানে উপস্থাপন করার প্রয়োজন পড়ে না। কারণ আমরা ইচ্ছা করলেই মা বাবার জন্মগত স্বভাবকে পরিবর্তন করে দিতে পারবো না। মা গরম হলে পিতা নরম, বাবা গরম হলে মা নরম দুটিই ভালো। তবে পৃথিবীর সন্তানেরা শুনো! একান্তই ব্যতিক্রম ছাড়া কোন বাবা-মা এমনটি পাওয়া দুস্কর যে, নিজের জিঘাংসা চরিতার্থ করার জন্য সন্তানদের ওপর নিজের রাগ প্রয়োগ করেন। সকল বাবা মার কাছে সন্তান হলো তাঁদের কলিজার টুকরা। পৃথিবীর যে কোন মূল্যবান জিনিস থেকে বাবা-মা তাঁর সন্তানকে অধিক আরো অধিক ভালবাসেন। তাঁদের ঘাম ঝড়ানো পরিশ্রম সন্তানের ভবিষ্যত সুখ শান্তির জন্য।

কালো ধলা যা-ই হোক, পৃথিবীর সকল সৌন্দর্য ও যে কোন সুন্দর থেকে অধিক আরো অধিক সুন্দর আমার মায়ের মুখ। আল্লাহর অসংখ্য শ্রেষ্ট নিয়ামতগুলোর মধ্যে মা-বাবা শ্রেষ্টতর নিয়ামত। কি যে মায়া, কি যে মমতা, কি যে ভালবাসায় জড়ানো সেই মুখ, সেই অবয়ব। পৃথিবীর সকল সুখ-শান্তি, আরাম আয়েশ ও নিরাপত্তার কেন্দ্রস্থল হলো আমার মায়ের মুখ। পরম করুনাময় পৃথিবীর সকল সুখের পরশ ও মখমলের বিছানার আয়েশ থেকেও অধিক ও অবারিত সুখ-শান্তি ঢেলে দিয়েছেন আমার মায়ের কোলে। যেমনটি করে ছোট্র ছোট্র কচি মুরগীর বাচ্চাগুলো আকাশে বাজপাখির আবাস পেলে, দ্রুত মা মুরগীর দুটি পাখার ছায়াতলে নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যায়। যদিও মা-এর সাথে পৃথিবীর কোন কিছুর তুলনা চলে না। মা-এর উদাহরণ মা নিজেই।

জীবন চলার পথে কত না মুখ চোখে পড়ে, কিন্তু আমার মায়ের সেই প্রিয় মুখ তো কখনো নযরে পড়ে না। প্রায়ই মায়ের বয়সের কোন মাকে আমার মায়ের মতো আবিস্কার করার ব্যর্থ প্রচেষ্টা চালাই। সত্যিই আল্লাহর সৃষ্টি কৌশল তুলনাহীন। করুণাময় মহান সৃষ্টি কূশলী কি যে মায়া ঢেলে দিয়েছেন আমার মায়ের মুখে। যেই চাঁদ মুখের দিকে একবার তাকালে পৃথিবীর সকল দু:খ-বেদনা-যাতনা মহুুর্তের জন্য দূরীভূত হয়ে যায়।

অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়, আমাদের সমাজ ব্যবস্থায় এমন কিছু কপাল পুরা মানুষ রয়েছে, যারা পিতা-মাতার সাথে দূর্ব্যবহার করেন। যেই মাতা কষ্ট করে তাঁকে পেটে ধারণ করেছে, পিতা মাথার ঘাম পায়ে ফেলে কোলে পিটে করে বড় করে তুলেছে, সেই পিতা-মাতার সাথে দূর্ব্যবহার সত্যিই দূর্ভাগ্যজনক। আল্লাহ বলেন,“ আর প্রকৃতপক্ষে আমি মানুষকে তার পিতা-মাতার হক চিনে নেবার জন্য নিজেই তাকিদ করেছি। তার মা দুর্বলতা সহ্য করে তাকে নিজের গর্ভে ধারণ করে এবং দু’বছর লাগে তার দুধ ছাড়াতে। এ জন্য আমি তাকে উপদেশ দিয়েছি আমার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করো এবং পিতা-মাতার প্রতিও, আমার দিকেই তোমাকে ফিরে আসতে হবে।”(লুকমান:১৪) আল কুরআনের আরো কয়েক জায়গায় অত্যন্ত মর্মস্পর্শী ভাষায় কথা বলা হয়েছে। মানবতার মহান বন্ধু মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামও অত্যন্ত হৃদয়স্পর্শী ভাষায় বাবা-মায়ের কথা উল্লেখ করেছেন।

গভীর অন্ধকার থেকে টেনে এনে যেই পিতা-মাতা আলোর পথের দিশা দিলেন, আধো আধো মুখে যাঁরা প্রথমেই অর্থবহ শব্দ তুলে দিয়েছেন, কেবলমাত্র পৃথিবীর কোন নিকৃষ্ট কীটই তাঁদের সাথে দূর্ব্যবহার করতে পারে। সুস্থ মস্তিস্ক ও সুস্থ বিবেক সম্পন্ন ব্যক্তি কোনদিন এ কাজ করতে পারে না। পৃথিবীর সকল সন্তানদের অনুরোধ মাতা-পিতাকে ভালবাসুন। দুনিয়া ও আখিরাত আপনার কল্যাণের দ্বার খুলে যাবে।

হে বিশাল আরশের মালিক! অনন্ত মায়া, মমতা ও ভালবাসার অধিকারী আমার প্রভু ও মালিক! পরম করুণাময় রব! তুমিই তো সন্তানের জন্য মায়ের অন্তরে এই অনন্ত ভালবাসা আর মায়া ঢেলে দিয়েছো। যে ভালবাসা ও মায়ার তুলনা পৃথিবীর কোন কিছুুর সাথে চলে না। কি যে কৃতজ্ঞতা তোমার আদায় করি প্রভু হে তোমার! আমার দু:খিনী মা-বাবা দু;জনই এখন হিজল বনে ঘুমিয়ে আছে। তুমি তাঁকে সেইভাবে রহম করো, যেভাবে ছোট্র বেলায় আমাকে তাঁরা রহম করেছেন। তাঁকে তুমি সেভাবে ভালবাস, যেভাবে তিনি আমাকে ভালবাসতেন। হে রব! তুমি আমার মায়ের রূপালী চাঁদ মুখটাকে কুলষিত করো না। তুমি তো জানো মা আমার কত দু:খ কষ্ট সয়েছে, কনকনে শীতের রাত্রে মাকে শত যন্ত্রণা পোহাতে হয়েছে। তুমি দয়াময়, তুমি আমার মাকে কষ্ট দিও না। তাঁর সকল ত্রুটি-বিচ্যুতি ক্ষমা করো। আমি তাঁর সন্তান, সন্তান হিসাবে আমি তোমার কাছে আকুতি-মিনতি করছি। হে প্রভু! আমার পিতাকেও মাফ করে দাও। পৃথিবীর সকল বাবা-মাকে তুমি রহম করো।