আল-কোরআনে জীবন-মৃত্যুর স্বরূপ

Published: 14 July 2021

।। মো. আবদুল মজিদ মোল্লা ।।

পার্থিব জীবনের পর মানুষের জন্য অপেক্ষা করছে এক অন্তহীন জীবন। যে জীবন অন্তহীন, অনন্ত। পৃথিবীর প্রায় সব ধর্মে মৃত্যু-পরবর্তী এ জীবনের স্বীকৃতি আছে। একজন বিশ্বাসী মানুষ পার্থিব জীবনে পরকালীন সে জীবনের জন্য প্রস্তুত হয়। কেননা মৃত্যু অপরিহার্য এবং পরকালীন মুক্তিই সাফল্যের মাপকাঠি। ইরশাদ হয়েছে, ‘জীবমাত্রই মৃত্যুর স্বাদ আস্বাদন করবে। কিয়ামতের দিন তোমাদের কর্মফল তোমাদের পরিপূর্ণভাবে আদায় করা হবে। যাকে জাহান্নামের আগুন থেকে দূরে রাখা হয়েছে এবং জান্নাতে প্রবেশ করানো হবে, সে-ই সফলকাম। পার্থিব জীবন ছলনাময় ভোগ ছাড়া কিছুই না।’ (সুরা আলে ইমরান, আয়াত : ১৮৫)

‘রুহ’ এক মহাবিস্ময় : জীবের জীবন-মৃত্যুর ভিত্তি ধরা হয় ‘রুহ’ বা আত্মাকে। পবিত্র কোরআনে ‘রুহ’কে মহান স্রষ্টার অপার বিস্ময় হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। ইরশাদ হয়েছে, ‘তারা আপনাকে রুহ সম্পর্কে প্রশ্ন করে। বলুন! আল্লাহর পক্ষ থেকে এক আদেশ। তোমাদের সামান্য জ্ঞানই দেওয়া হয়েছে।’ (সুরা বনি ইসরাঈল, আয়াত : ৮৫)

আল্লামা ইবনে কাসির (রহ.) বলেন, ‘উল্লিখিত আয়াত দ্বারা প্রমাণিত হয়, রুহ বা আত্মা একান্ত আল্লাহর ইচ্ছাধীন এবং পৃথিবীর খুব সামান্যসংখ্যক মানুষ সে সম্পর্কে সামান্য জ্ঞান রাখে।’ (তাফসিরে ইবনে কাসির)

জীবন-মৃত্যু আল্লাহর ইচ্ছাধীন : জীবন ও মৃত্যুর সীমা মহান আল্লাহই নির্ধারণ করেন। ইরশাদ হয়েছে, ‘তিনি জীবন দান করেন এবং তিনিই মৃত্যু ঘটান। আল্লাহ ছাড়া তোমাদের কোনো অভিভাবক নেই, কোনো সাহায্যকারীও নেই।’ (সুরা তাওবা, আয়াত : ১১৬)

জীবনকাল নির্ধারিত : মানুষের জন্ম ও মৃত্যু আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত। ইরশাদ হয়েছে, ‘আমি তোমাদের মধ্যে মৃত্যু নির্ধারিত করেছি এবং আমি অক্ষম নই।’ (সুরা : ওয়াকিয়া, আয়াত : ৬০)

অন্য আয়াতে ইরশাদ হয়েছে ‘…নিশ্চয়ই আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত কাল উপস্থিত হলে তা বিলম্বিত হয় না। যদি তোমরা জানতে!’ (সুরা নুহ, আয়াত : ৪)

জীবন ও মৃত্যু পরীক্ষার জন্য : পার্থিব জীবনে মানুষের জীবন ও মৃত্যু নির্ধারণ করা হয়েছে তাকে পরীক্ষা করার জন্য। ইরশাদ হয়েছে, ‘যিনি সৃষ্টি করেছেন মৃত্যু ও জীবন তোমাদের পরীক্ষা করার জন্য—কে তোমাদের মধ্যে উত্তম কাজ করে? তিনি পরাক্রমশালী, ক্ষমাশীল।’ (সুরা : মুলক, আয়াত : ২)

জীবন-মৃত্যুর সেতুবন্ধ ঘুম : ঘুম জীবন ও মৃত্যুর সেতুবন্ধ বা মধ্যবর্তী এক অবস্থা। ইরশাদ হয়েছে, ‘আল্লাহই প্রাণ হরণ করেন জীবগুলোর—তাদের মৃত্যুর সময় এবং যাদের মৃত্যু আসেনি তাদের প্রাণও ঘুমের সময়। অতঃপর তিনি যার জন্য মৃত্যুর সিদ্ধান্ত নেন, তার প্রাণ রেখে দেন এবং অন্যগুলো ফিরিয়ে দেন এক নির্দিষ্ট সময়ের জন্য।…’ (সুরা জুমার, আয়াত : ৪২)

মৃত্যুই জীবনের সমাপ্তি নয় : মৃত্যু মানেই জীবনের সমাপ্তি নয়; বরং এর পরও আছে দীর্ঘ জীবন। ইরশাদ হয়েছে, ‘তোমরা কিভাবে আল্লাহকে অস্বীকার করো? অথচ তোমরা ছিলে প্রাণহীন, তিনি তোমাদের জীবন দান করেছেন। আবার তোমাদের মৃত্যু দেবেন ও পুনরায় জীবন দেবেন এবং চূড়ান্ত পরিণতিতে তোমরা তাঁর দিকেই ফিরে যাবে।’ (সুরা : বাকারা, আয়াত : ২৮)

মুমিনের মৃত্যু-ভাবনা : মৃত্যু অনিবার্য। তবে মুমিন কখনো মৃত্যু কামনা করবে না। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘তোমাদের কেউ যেন মৃত্যু কামনা না করে, মৃত্যু আসার আগে তার জন্য প্রার্থনা না করে। কেননা সে যখন মারা যায় তখন তার আমলের দরজা বন্ধ হয়ে যায়। আর আয়ু বৃদ্ধিতে মুমিনের কল্যাণই বৃদ্ধি পায়।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ২৬৮২)

অন্যত্র রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘তোমাদের কেউ যেন মৃত্যু কামনা না করে। কেননা সে যদি সৎ হয় তবে বেঁচে থাকলে হয়তো সে নেক কাজ বৃদ্ধি করবে। আর যদি পাপী হয়, তাহলে হয়তো সে তাওবা করবে।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৭২৩৫)

অবিশ্বাসীদের মৃত্যু-ভাবনা : পরকালে বিশ্বাসী নয়, তারা মৃত্যুকে ভয় করে এবং মৃত্যু থেকে পালিয়ে বেড়ায়। ইরশাদ হয়েছে, ‘কিন্তু তাদের হাত যা আগে প্রেরণ করেছে তার কারণে কখনো মৃত্যু কামনা করবে না। আল্লাহ অবিচারকারীদের সম্পর্কে সম্যক অবগত। বলুন! তোমরা যে মৃত্যু থেকে পলায়ন করো সে মৃত্যু তোমাদের সঙ্গে অবশ্যই সাক্ষাৎ করবে। অতঃপর তোমরা প্রত্যানীত হবে অদৃশ্য ও দৃশ্যের পরিজ্ঞাতা আল্লাহর কাছে এবং তোমাদের জানিয়ে দেওয়া হবে যা তোমরা করতে।’ (সুরা জুমা, আয়াত : ৭-৮)

পৃথিবীতে বিচরণ করেও যারা মৃত : জীবন ধারণ ও পৃথিবীতে বিচরণ করা মানেই জীবিত থাকা নয়; বরং সত্যিকারের জীবনের প্রকাশ ঘটে মানুষের বোধ, বিশ্বাস ও আচরণে। পবিত্র কোরআনে এমন বোধহীন মানুষকে মৃত বলা হয়েছে। ইরশাদ হয়েছে, ‘নিশ্চয়ই আপনি মৃতদের কথা শোনাতে পারবেন না।’ (সুরা নামল, আয়াত : ৮০)

অন্য আয়াতে আল্লাহ অবিশ্বাসীকে মৃত ব্যক্তির সঙ্গে তুলনা করে বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি মৃত ছিল যাকে আমি পরে জীবিত করেছি এবং মানুষের মধ্যে চলবার জন্য আলো দিয়েছি সে ব্যক্তি কি ওই ব্যক্তির মতো যে অন্ধকারে রয়েছে এবং সেই স্থান থেকে বাহির হওয়ার নয়?’ (সুরা আনআম, আয়াত : ১২২)

মৃত্যুর পরও জীবিত যারা : পৃথিবীতে বিচরণ করেও যেমন একদল মানুষ মৃত, তেমনি একদল মানুষ মৃত্যুর পরও জীবিত। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘যারা আল্লাহর রাস্তায় নিহত হয়েছে (শহীদ) তাদের তোমরা মৃত বলো না; বরং তারা জীবিত। কিন্তু তোমরা অনুভব করো না।’ (সুরা বাকারা, আয়াত : ১৫৪)

মুমিনের মৃত্যু-প্রস্তুতি : পরকালীন জীবনেই মুমিনের প্রধান লক্ষ্য। তাই সে মৃত্যু-পরবর্তী জীবনের জন্য প্রস্তুত হয়। ইরশাদ হয়েছে, ‘হে মুমিনরা, তোমরা আল্লাহকে যথাযথ ভয় করো। আর তোমরা মুমিন না হয়ে মৃত্যুবরণ করো না।’ (সুরা আলে ইমরান, আয়াত : ১০২)

মুমিনের জীবন-মৃত্যু আল্লাহর জন্য : একজন বিশ্বাসী মানুষ আল্লাহর জন্য বেঁচে থাকে এবং তাঁর জন্যই মৃত্যু বরণ করে। ইরশাদ হয়েছে, ‘বলুন! আমার নামাজ, আমার ইবাদত, আমার জীবন ও আমার মৃত্যুজগৎসমূহের প্রতিপালক আল্লাহর উদ্দেশ্যেই (নিবেদিত)।’ (সুরা আনআম, আয়াত : ১৬২)

পরকালের জীবন মৃত্যুহীন : পরকালের জীবন হবে মৃত্যুহীন। জান্নাতিরাও অনিন্দ্য সুখের মাঝে অন্তহীন জীবন লাভ করবে। অন্যদিকে জাহান্নামিরা শাস্তি থেকে বাঁচতে মৃত্যু কামনা করবে। কিন্তু তাদের মৃত্যু হবে না। ইরশাদ হয়েছে, ‘যখন তাদের শৃঙ্খলিত অবস্থায় জাহান্নামের কোনো সংকীর্ণ স্থানে নিক্ষেপ করা হবে, তখন তারা ধ্বংস (মৃত্যু) কামনা করবে। তাদের বলা হবে, আজ তোমরা একবারের জন্য ধ্বংস কামনা কোরো না; বরং বহুবার ধ্বংস হওয়ার কামনা করতে থাকো।’ (সুরা ফোরকান, আয়াত : ১৩-১৪)

লেখক : সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট, ঢাকা।