জীবনের জন্য ইতিবাচক মনোভাব

Published: 23 July 2021

।। জাফর আহমাদ ।।


সুস্থ জীবনের জন্য ইতিবাচক মনোভাব একান্ত প্রয়োজন। সমাজ সভ্যতায়ও এর প্রয়োজনীয়তা অত্যাবাশ্যক। নেতিবাচক মনোভাব সমাজ সভ্যতাকে মানুষকে বিচ্ছিন্ন। ফলে একা হয়ে যায় এবং সে অসুস্থ হয়ে পড়ে। তাই ইসলাম নেতিবাচক মনোভাব থেকে ইতিবাচক মনোভাবকেই বেশী অগ্রাধিকার দেয়। আমরা গভীরভাবে যদি লক্ষ করি তাহলে দেখতে পাবো, আমাদের জীবন চলার পথে হারাম তথা নেতিবাচক একেবারেই নগন্য এবং নির্ধারিত। পক্ষান্তরে হালাল তথা ইতিবাচক অসংখ্য ও অনির্ধারিত। এই নির্দিষ্ট কতিপয় হারাম বাদ দিলে মানুষের জীবন ইতিবাচকতায় ভরপুর। সুতরাং একজন মুসলমানের মন ও মননে সদা ইতিবাচক চিন্তা ঘোরপাক খাবে এটিই কাম্য। তাদের কথা-বার্তা, চাল-চলন ও আচার-আচরণে সদা-সর্বদা ইতিবাচকতারই বহি:প্রকাশ ঘটবে। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জীবন চরিতে এই গুণটি প্রবালাকারে পরিলক্ষিত হয়। পাহাড়সম সমস্যার সমাধানে তিনি কখনো নেতিবাচক পন্থার আশ্রয় নিয়েছেন, এমনটি কদাচিৎ পরিলক্ষিত হয়। অন্যথায় ইতিবাচক চিন্তা-চেতনা দিয়েই তিনি সব কিছু সমাধান করেছেন।
মক্কার কঠিণ পাথুরে হৃদয়গুলো মানবতার চরম বিপর্যয়ের মুখোমুখ দাঁড়িয়েছিল, হানাহানিতে সামাজিক ধ্বংসের দ্বার প্রান্তে পৌঁছে গিয়েছিল, দয়া-মায়া অনেক আগেই বিদায় নিয়েছিল, পিতা তার সন্তানকে জীবন্ত কবর দিতে ছিল-এ অবস্থা যুগ যুগ ও কাল কাল ধরে চলে আসছিল-এহেন পরিস্থিতি থেকে মাত্র ২৩ বৎসরের ব্যবধানে একটি জাতিকে মানবতার সর্বোচ্চ শিখরে নিয়ে যাওয়া কি যাই-তাই ব্যাপার? কিন্তু রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জন্য সহজই হয়েছিল ইতিবাচক কর্মপদ্ধতি ও কর্মপন্থার জন্য। তিনি তৎকালীন অধঃপতিত সমাজকে ধ্বংসের প্রান্ত সীমানা থেকে উদ্ধারের নিমিত্তে ইতিবাচক দিক তথা ন্যায়নীতি বিকাশের উপর অত্যধিক গুরুত্ব দিয়েছিলেন। এ জন্য সর্বপ্রথম তিনি মানুষের মন-মননে ‘আল্ল¬¬াহ ও আখিরাতের ভয়’ জাগ্রত করার কাজে মনোনিবেশ করেছিলেন। এ জন্য তিনি নেতিবাচক তথা উদ্যতভাব, খরগহস্ত ও কর্কষভাষী হননি। বরং তাঁর মনের সবটুকু দরদ ঢেলে দিয়ে, একান্ত অকৃত্রিম হিতাকাংঙী সেজে ও অত্যন্ত কোমলভাবে মানুষকে বুঝিয়েছেন। যার স্বীকৃতি স্বয়ং আল্লাহ তা’আলা এভাবে দিয়েছেনঃ “আপনি যে কোমল হৃদয় হতে পেরেছেন, সে আল্লাহ তা’আলার অনুগ্রহেরই ফল। কিন্তু আপনি যদি কঠিন হৃদয় ও কর্কশভাষী হতেন তাহলে তারা সকলে আপনাকে ছেড়ে চলে যেতো।”(সুরা ইমরানঃ১৬) আল্লাহর পক্ষ থেকেও এ কৌশলই অবলম্বন করা হয়েছিল। তাঁর প্রিয় রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ওপর অবতীর্ণ প্রথম প্রথম আসমানী ফরমানগুলোর অধিকাংশই ছিল ‘আল্ল¬¬াহ ও আখিরাতের ভয়’ সম্বলিত। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মক্কী জীবনের আয়াতগুলো তার বাস্তব প্রমাণ। এ সমস্ত ফরমানের আলোকে তিনি বিশ্ববাসীকে নৈতিকতা ও মানবতার চতুঃসীমার মধ্যে আবদ্ধ করার চেষ্ঠা করেন। আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ“হে নবী, ভালো ও মন্দ কখনো সমান হতে পারে না। মন্দকে ভালো পন্থায় প্রতিরোধ করো। তখন দেখবে, তোমার সাথে যার শুত্রুতা, সে তোমার অন্তরঙ্গ বন্ধুতে পরিণত হয়েছে। (সুরা হা-মীম আস সেজদা-১৮)
এ আয়াতের মন্দকে ভালো পন্থায় তথা ইতিবাচক পন্থায় সমাধানের কথা বলা হয়েছে। নেতিবাচককে নেতিবাচক পন্থায় সমাধানের কথা বলা হয়নি। তাই রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মানুষদেরকে প্রথমত তাওহীদ, রেসালাত ও আখিরাতের প্রতি বিশ্বাস স্থাপনের আহবান জানাতেন। আল কুরআনে অঙ্কিত আখিরাতের ভয়াবহ দৃশ্য উপস্থাপণ করতেন। পাশাপাশি চুরি, ব্যাভিচার, সন্তান হত্যা. মিথ্যা বলা, রাহাজানি করা, আল্লাহর পথ থেকে মানুষকে ফিরানো প্রভৃতি কাজ থেকে বিরত রাখা ও তাদের মনে ঘৃণা জন্মানোর চেষ্টা করেন। তার লক্ষ্য ছিল আত্মার পবিত্রতা সাধন, মন মানসে মলিনতা, শোষণ এবং জৈবিক ও পাশবিক পংকিলতা সমুহ প্রক্ষালন করে মানুষের শ্রেষ্টত্বের মর্যাদাকে পুনরুদ্ধার করা। এ লক্ষ অর্জনে প্রথমেই তিনি তরবারীর কাছে নয় বরং হেদায়াতের আলোর প্রয়োজনীয়তাকেই অগ্রাধিকার দিয়েছেন। হাত, পা ও মাথাকে নত করার আগে মানুষের মনের ব্যকুলতার প্রয়োজনীয়তার অনুভব করেছেন। শারীরিক বশ্যতার আগে আত্মার আনুগত্যশীলতাকে উজ্জীবিত করেছেন। কারণ আল্লাহর ভয় যার মনকে বিচলিত করে না, মানুষের ভয় তাকে কিভাবে বিচলিত করবে ?
ইতিবাচক ও নেতিবাচক দূ’টি মনোভাব মানুষের সার্বিক জীবনকে বিশেষভাবে প্রভাবিত করে। ইতিবাচক মনোভাব মানুষের ব্যক্তিগত জীবন থেকে শুরু করে আন্তর্জাতিক জীবনের সকল স্তরে ইতিবাচক ফল দিতে থাকে। এটি এমন একটি দূর্লভ গুণ, যেটির প্রভাবে ব্যক্তির চরিত্রে আরো কতগুলো সুন্দর ও বিরল গুণ ও বৈশিষ্ট্যের সমাহার ঘটে। যেমন যিনি ইতিবাচক মনোভাবের অধিকারী তিনি অব্যশই কোমল হৃদয়ের অধিকারী। তিনি নম্র-ভদ্র, মিষ্টভাষী, সুন্দর ব্যবহার, মানবিক আচরণ, পরশ্রীপরায়ণ, কল্যাণকামী, সহানুভূতিশীল, দয়ার্দ্র, নির্লোভী, নিরহংকারী ও নি:স্বার্থবাদী স্বভাবের হয়ে থাকেন। এ ধরনের ব্যক্তিকে সমাজ ও রাষ্ট্রের যেখানেই বসানো হবে, সেখানকার পরিবেশ যেমন বদলে যাবে, তেমনি সার্বিক উন্নতি প্রসার লাভ করবে।
পক্ষান্তরে নেতিবাচক মনোভাবাপন্ন চরিত্র ব্যক্তিকে সবশেষে ধ্বংসের দ্বার প্রান্তে নিয়ে য়ায়। তার ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও সামাজিক জীবন হুমকীর সস্মুখীন হয়ে পড়ে। বেশী বেশী নেতিবাচক মনোভাব প্রকাশ করার কারণে এক সময় সে চরম ইতিবাচককেও নেতিবাচক মনে করে। এ ধরণের ব্যক্তির চরিত্র সহসাই চরমপন্থার রূপ ধারণ করে। একই কারণে তার চরিত্রে আরো কতগুলো বদগুণ এসে বাসা বাঁধে। সবচেয়ে মারাত্মক যেই রোগটি এ ব্যক্তিকে নাস্তানাবুদ করে তুলে তাহলো, হতাশা ও নিরাশা। হতাশা ও নিরাশা হলো নেতিবাচকের পরিস্পুরক একটি বদগুণ। হতাশা বা নিরাশা নেতিবাচক মনোভাবের মতোই মানুষের সকল প্রকার যোগ্যতাকে সমূলে বিনষ্ট করে দেয়। মানুষের শারীরিক, মানসিক ও নৈতিক শক্তিকে এমনভাবে দূর্বল করে দেয় যে, সকলক্ষেত্রে সে একজন অযোগ্য ও অকর্মণ্য ব্যক্তিতে পরিণত হয়। হতাশাগ্রস্থ ব্যক্তিটি পরিবারের শান্তিপূর্ণ পরিবেশকে যেমনভাবে বিনষ্ট করে, তেমনি সমাজ ও পেশাগত জীবনে একজন অযোগ্য,অকর্মণ্য দায় হিসাবে চিহ্নিত হয়। হতাশা এমনভাবে ঘিরে ধরে যে ঢিলেমী তাকে সামনে চলার সকল পথকে রুদ্ধ করে দেয়। হতাশাগ্রস্থ ব্যক্তি সকল কাজে নেতিবাচক মনোভাব প্রকাশ করে। নেতিবাচক অভিব্যক্তি তার অভ্যাসে পরিণত হয়। ইতিবাচকতা তার আজন্মের শুত্রুতে পরিণত হয়। এ ধরণের ব্যক্তিরা নেতিবাচক মনোভাব প্রচ্ছন্ন ও অপ্রচ্ছন্ন দুভাবে প্রকাশ করে। একটি ভাল কাজের প্রতি সকলেই ইতিবাচক সাড়া দিয়েছে, কিন্তু ঐ ব্যক্তি যে নেতিবাচক রোগে আক্রান্ত, সে তার মনোভাব এমনভাবে প্রকাশ করবে, প্রাথমিকভাবে বুঝা যাবে না সে নেতিবাচক না কি ইতিবাচক। কিন্তু একটু ভালভাবে লক্ষ্য দেখা যাবে যে, প্রচ্ছন্নভাবে সে নেতিবাচক মনোভাবই প্রকাশ করেছে। এ ধরণের ব্যক্তিরা নিজেরা তো সফলতার মুখ দেখতে পা-ই না, অধিকন্ত তারা অন্যের সফলতাকেও সহ্য করতে পারে না।
সুতরাং ইতিবাচক হোন, নেতিবাচককে যথাসম্ভব পরিহার করুন।

লেখক : ম্যানেজার, ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লি:, জিন্দাবাজার শাখা, সিলেট।