মহররম মাস প্রেরণার বাতিঘর
।। জাফর আহমাদ।।
আরবী বর্ষ পরিক্রমার প্রথম ও সম্মানিত মাস মহররম। এটি ‘আশহারুল হুরুম’ বা হারামকৃত মাস চারটির একটি। মহররম মানে সম্মানিত। নামের মাধ্যমেই সম্মানিত ও মর্যাদা পরিস্ফুট হয়েছে। আল্লাহ তা’আলা বলেন, যখন হতে আল্লাহ তা’আলা আসমান ও জমিন সৃষ্টি করেছেন, তখন হতেই তাঁর নিকট মাসগুলির সংখ্যা লিপিবদ্ধ রয়েছে বারটি। এর মধ্যে চারটি মাস সম্মানিত। ইহা নির্ভুল ব্যবস্থা। সুতরাং তোমরা এ মাস সমুহে নিজেদের ওপর জুলুম করো না। (সুরা তওবা: ৩৬) হযরত আবু বাকারাহ রা: নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে বর্ণনা করেন, “ বছর হলো বারটি মাসের সমষ্টি, তার মধ্যে চারটি হেেলা অতি সম্মানিত। তিনটি হলো পরপর লাগোয়া জিলক্বদ, জিলহজ্জ ও মহররম আর জমাদুস সানি ও শাবানের মধ্যবর্তী রজব। (বুখারী:২৯৫৮)
ইসলামী ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ ও বহুল আলোচিত ঘটনাসমুহ এ মাসেই সংঘটিত হয়েছে। এ মাসেরই একটি গুরুত্বপূর্ণ দিন হলো ১০ই মহররম, যা আশুরা নামে অধিক পরিচিত। ইতিহাসের নানা ঘটনায় ভরপুর এ দিনটি। এদিন আল্লাহ তা’আলা মুসা আ: ও তাঁর কওমকে রক্ষা করেছেন এবং ফেরাউন ও তার সম্প্রদায়কে পানিতে ডুবিয়ে মেরেছেন। হযরত ইবনে আব্বাস রা: থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, নবী করিম স: মদীনায় আগমন করে দেখতে পেলেন ইহুদীরা আশুরার দিন রোযা পালন করছে। নবীজি বললেন, এটি কি? তারা বললো, এটি একটি ভালো দিন। এ দিনে আল্ল¬াহ তা’আলা বনি ইসরাইলকে তাদের দুশমনের কবল থেকে বাঁচিয়েছেন। তাই মুসা আ: রোজা পালন করেছেন। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, মুসাকে অনুসরণের ব্যাপারে আমি তোমাদের চেয়ে অধিক হকদার। অতপর তিনি রোজা রেখেছেন এবং রোজা রাখার নির্দেশ দিয়েছেন। (বুখারী:১৮৬৫) ইমাম আহমাদ র: বর্ণনা করেছেন,“এটি সেই দিন যাতে নুহ আ:-এর কিশতি জুদি পাহাড়ে স্থির হয়েছিল, তাই নুহ আ: আল্ল¬াহর শুকরিয়া আদায় স্বরূপ রোযা রেখেছিলেন।
আশুরার দিন রোযা রাখার ব্যাপারে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অনেকগুলো হাদীস সহীহ গ্রন্থে বর্ণিত হয়েছে। তার মধ্যে একটি হাদীসের বর্ণনা ছিল এ রকম যে, রাসুলুল্ল¬াহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,“আশুরার দিনের রোযার ব্যাপারে আমি আল্লাহর কাছে আশা করি, তিনি পূর্ববর্তি এক বছরের গুণাহ মাফ করে দিবেন।(মুসলিম) এ দিনটিকে আহলে কিতাব তথা ইহুদী খৃষ্টানরাও বড় সম্মান করে। তাদের থেকে বৈচিত্র আনার জন্য আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নবম দিনেও রোযা রাখতে বলেছেন। এদিনে কি হয়েছে এ দিনে কি হবে তা বর্ণনা করা আমাদের উদ্দেশ্য নয় বরং এ মাসে এ দিনে প্রেরণার একটি বাতিঘর রয়েছে, যেটিকে পাশ্চাত্য ও দেশীয় ইসলাম বিদ্বেষী গোষ্ঠী ভেঙ্গে তথায় একটি রঙিন বাতিঘর স্থাপন করেছে। যাতে মুসলমানগণ কোন দিন সে প্রেরণায় উজ্জিবীত হতে না পারে। মুসলমান ষড়যন্ত্রমূলক রঙিন সেই বাতিঘরের ধাঁ ধাঁ পড়ে ইমামের প্রতি সস্তা ভালবাসা প্রকাশে মাতম করে করে শুধু বুকই পাঠিয়েছে। কিন্তু সঠিক প্রেরণার ইতিহাস তারা জানতে পারেনি এবং নিজেদেরকে উজ্জীবিত করতে পারেনি।
আশুরায় দিনে সংঘটিত অসংখ্য ঘটনাবলীর মধ্যে সবচেয়ে বড় ট্রাজেটি হলো কারবালার মরু প্রান্তরে তৎকালীন রাষ্ট্র কর্তৃক ইমাম হোসাইন রা: ও তার পরিবারের হত্যাকান্ড। এটি নিছক একটি হত্যাকান্ডই ছিল না, বরং এ হত্যাকান্ডের মাধ্যমে ইসলামের ইতিহাস তার সঠিক পথ থেকে বিচ্যুত হয়ে অন্যদিকে মোড় নিয়েছিল। এ হত্যাকান্ড যতটুকু বেদনাদায়ক তার চেয়েও বেদনাদায়ক হলো ইসলাম ও ইসলামী জীবন ব্যবস্থা রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কর্তৃক প্রদর্শিত যেই রাস্তা বেয়ে পথ চলছিল, সেটি ইমামের হত্যার মাধ্যমে বাঁকা পথে মোড় নেয়। ইমাম পূর্ব থেকেই বুঝতে পেরেছিলেন যে, বাঁকা পথে আরোহনকারী ইসলাম নামক ট্রেনটির ড্রাইভার ট্রেনটিকে বাঁকা পথে নিয়ে যাচ্ছে। খুব সহসাই এর যাত্রীদের গোমরাহীতে নিমজ্জিত করবে। তাই তিনি পথভ্রষ্ট ড্রাইভারটিকে নামিয়ে ট্রেনটিকে সঠিক পথে তথা রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রদর্শিত পথে নিয়ে যাওয়ার চেষ্ঠা করেছিলেন। কিন্তু বাতিল রাষ্ট্রদন্ডের ক্ষমতাবলে তাঁকে এগুতে দেয়নি। বরং রাস্তার এ বিশাল বাঁধাটিকে চিরতরে শেষ করে দেয়ার জন্য তাঁকে সপরিবারে শহীদ করে দেয়। ইসলামী রাষ্ট্রকে অন্ধকার পথে নিয়ে যাওয়ার আর কোন বাঁধা-বিপত্তি রইল না।
পৃথিবী তার বিশাল বুকে যতগুলো দুঃখ আর বেদনাকে ধারণ করে এখনো ঠিকে আছে এবং যতগুলো মর্মান্তিক ঘটনা বা দুর্ঘটনা ইতিহাসকে বার বার কাঁদায়, তন্মোধ্য শাহাদাতে কারবালা সর্বোচ্চ আসনকে সিক্ত করেছে। প্রতিটি মুসলমান পুরুষ ও নারী হযরত ইমাম হোসাইনের রাঃ শাহাদাতের ঘটনায় আন্তরিক দুঃখ ও বেদনা প্রকাশ করে থাকে। নিঃসন্দেহে এটি আল্লাহ ও তাঁর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রতি ঈমানের স্বাভাবিক প্রতিফলন এবং মানবতার প্রতি ভালবাসার বহিঃপ্রকাশ।
কিন্তু সেই সাথে হৃদয় আরো দুঃখ-ভারাক্রান্ত হয়ে উঠে যখন এমনটি হতে দেখা যায় যে, বিশ্ব মুসলিম ইমাম হোসাইন রাঃ এর শাহাদাতের মুল উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যকে ভূলে গিয়ে বেহুদা সব কাজে লিপ্ত হয়। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর অক্লান্ত পরিশ্রমে ইসলামের যে গাছটি পরিপূর্ণ মহিরূপে রেখে গেছেন তার প্রথম থেকে শেষ অবদি চাক্ষুস স্বাাক্ষী ছিলেন অত্যন্ত প্রিয়ভাজন হযরত হোসাইন রাঃ। সেই আদর্শিক গাছটির ডাল-পালা ইতিমধ্যে কেটে দেয়া হলো। কিন্তু যখন তার মূল কর্তন ও নতুন একটি বিষবৃক্ষ রোপণ করতে এগোয়, তখন তিনি এর গতি প্রতিরোধে সর্বশক্তি নিয়োগ করেছিলেন। আর এ জন্যই ইতিহাসের এ মর্মান্তিক অধ্যায়ের সৃষ্টি হয়েছে।
আমরা যদি ইমাম হেসাইন রা: এর মূল চেতনাকে উপলব্ধি না করি, তবে তাঁর প্রতি ভালবাসার পরিবর্তে সুস্পষ্ট জুলুম করা হবে। কিয়ামাতের দিন ইমাম যদি তাঁর রক্তমাখা জামা আর ছোট্র শিশু বাচ্চাদের নিয়ে আল¬াহর দরবারে হাজির হয় এবং আমাদের কাছে প্রশ্ন করে বসেন যে, আমি কি আমার ব্যক্তিগত কোন উদ্দেশ্যকে চরিতার্থ করার জন্য শহীদ হয়েছিলাম? তখন আমাদের কি কোন জবাব থাকবে ? সুতরাং আমাদেরকে সঠিক ইতিহাস এবং মহররমের সঠিক শিক্ষা জানতে হবে এবং সে অনুযায়ী আমাদের কর্মপন্থা গ্রহণ করতে হবে। ইমাম যেই চেতনার কারণে তৎকালীন স্বৈশশাসক ও জালিমশাহীর সামনে দাঁড়িয়েছিলেন তা নিম্নরূপ:
নেতৃত্বের পালাবদলে ভূল : ইসলামী সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থার মুল কথা হলো যে সমাজ ও রাষ্ট্রের কোন পর্যায়ে পদ দাবী করার বা চেয়ে নেয়া যাবে না, আবার দায়িত্ব এলে তা শরয়ী ওজর ব্যতিত অস্বীকার করার কোন সুযোগ নেই। হযরত আব্দুর রহমান ইবনে সামুরাহ রাঃ হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাকে বলেছেন ঃ “তুমি নের্তৃত্ব চেয়ে নিবে না। কেননা তুমি যদি চেয়ে নের্তৃত্ব লাভ কর তাহলে তোমাকে উক্ত পদের হাওয়ালা হবে। (সে অবস্থায় তুমি আল্ল¬াহর কোন সাহায্য পাবে না।) আর যদি কোন রকম প্রার্থনা করা ব্যতিত তুমি নেতৃত্ব লাভ করো, তাহলে আল্ল¬াহর তরফ হতে তোমাকে দায়িত্ব পালনে সাহায্য করা হবে।”(বুখারী-মুসলিম) দ্বিতীয়তঃ এটি কেবলমাত্র পুরুষানুক্রমিক বা বংশ পরস্পরায় গদিনশিন হওয়া বা মনোনীত করারও কোন বিষয় নয়। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেনঃ “মুসলিম জনগনের সাথে পরামর্শ না করে কেউ কাউকে নেতা হিসেবে বায়’আত করলে, সে বায়আত গ্রহণযোগ্য হবে না।”(মুসনাদে আহমাদ) এ ধরনের গুরুত্বপূর্ন দায়িত্বের জন্য ইসলাম যে সমস্ত বিষয়কে সামনে রাখার বা বিবেচনা করার ওপর গুরুত্বারূপ করা হয়েছে তা হলো:- নের্তৃত্বের দায়িত্বভার অর্পনের প্রাক্কালে ব্যক্তির আল্ল¬াহ ভীতি, আল্লাহর প্রতি আনুগত্য, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রতি আনুগত্য, দ্বীনি ইলম, প্রজ্ঞা, আমানতদারী, নের্তৃত্বের গুণাবলী, দূরদৃষ্টি, সুন্দর ব্যবহার ও মেজাজের ভারসাম্যের প্রতি বিশেষ গুরুত্ব প্রদান করতে হবে। আল্ল¬াহ তা’আলা বলেনঃ- ”নিশ্চয়ই আল্ল¬াহর নিকট তোমাদের মধ্যে সেই ব্যক্তি অধিক সম্মানিত, তোমাদের মধ্যে যে আল্লাহকে সবচেয়ে বেশী ভয় করে। নিঃসন্দেহে আল্ল¬াহ সব কিছু জানেন ও খবর রাখেন।”(সুরা আল হুজরাত-১৩) আল্ল¬াহর কাছে যেই ব্যক্তি অধিক সম্মানিত, তিনিই নের্তৃত্ব পাওয়ার অধিক হকদার বলে মনে করি। আল-কুরআনে আল্ল¬াহ তা’আলা এ ধরনের তাক্ওয়া সম্পন্ন সমাজের উন্নতির দুয়ার খোলে দেয়ার ওয়াদাও করেছেন। ইসলাম নেতৃত্ব পরিবর্তন বা নেতৃত্ব বাচাই করার যে নিয়ম বা পন্থা বলে দিয়েছে, এটিই অত্যন্ত সুষম পন্থা। এর মাধ্যমে ইসলামী রাষ্ট্র সকল প্রকার বিকৃতি থেকে রক্ষা পায়। কিন্তু এ পন্থা বাদ দিলে সেখানে বিভিন্ন ধরনের বিকৃতি ও স্বেচ্ছাচারিতা বাসা বাধেঁ। ফলে রাষ্ট্র ব্যবস্থার সকল স্তরে অশান্তি আর অস্থিরতা প্রবল আকার ধারণ করে। বিদ্বেষ, পেশীশক্তি, সংকীর্ণ গোত্র বা বংশ মর্যাদা এবং কুৎসীত ঘরোয়া প্রতিদ্বন্ধীতা ও সংঘর্ষ দানা বেধেঁ উঠে। নেতৃত্বের পালাবদলের যে নিয়ম ইসলাম অনুমোদন দেয়নি, তৎকালীন নেতৃত্ব সেই নিয়মের দিকে অগ্রসরমান দেখে হযরত হোসাইন রাঃ শঙ্কিত হয়ে পড়েন। যেহেতু ঈমাম ছিলেন একজন বিচক্ষণ, শরীয়তের অর্ন্তদৃষ্টি সম্পন্ন ব্যক্তি। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম, হযরত আলী রাঃ ও হযরত ফাতিমা রাঃ যাকে কোল-পিঠে করে আদর্শ মানুষ হিসাবে গড়ে তুলেছিলেন। যার শৈশব থেকে বার্ধক্য দীর্ঘ সময় অতিবাহিত হয়েছে সাহাবায়ে কেরামের উন্নত পরিবেশে। যিনি রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও আমিরুল মু’মিনিন হযরত আবু বকর থেকে হযরত আলী রাঃ পর্যন্ত রাষ্ট্র ব্যবস্থার মৌলিক বিশেষত্ব নিজ চক্ষে অবলোকন করেছেন। যিনি ভালো করে জেনেছেন এবং দেখেছেন ইসলামী রাষ্ট্রের নের্তৃত্বের পালাবদলের নিয়মতান্ত্রিক রূপরেখা। তিনি তৎকালিন শাসকবর্গের ইসলামী রাষ্ট্রের মৌলিক দিক পরিবর্তনের ব্যাপারটি সহসাই বুঝতে পারেন এবং নিজের প্রজ্ঞা দিয়ে এর করুন পরিণতির চিন্তা করেন। তাই তিনি দ্রুতগতিসম্পন্ন দিকবিভ্রান্ত গাড়ী থামিয়ে তার সঠিক লাইনে পরিচালিত করার জন্য নিজের জান কোরবান করে দেন।
২. জুলুম ও স্বৈরশাসকের প্রতিরোধ:
অবৈধভাবে নেতৃত্বের পালাবদলের কারণে তৎকালীন নেতৃত্ব জুলুমতন্ত্র কায়েম করে। ইসলামী রাষ্ট্রের সকল স্তরে বিভিন্ন ধরনের বিকৃতি, স্বেচ্ছাচারিতা, অশান্তি আর অস্থিরতা প্রবল আকার ধারণ করে। বিদ্বেষ, পেশীশক্তি, সংকীর্ণ গোত্র বা বংশ মর্যাদা এবং কুৎসীত ঘরোয়া প্রতিদ্বন্ধীতা ও সংঘর্ষ দানা বেধেঁ উঠে। স্বৈরতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় সাধারণ মানুষ চরমভাবে অসহায়, মানবিক অধিকার বঞ্চিত দাসানুদাসে পরিণত হতে থাকে। রাজতান্ত্রিক শাসনের ফলে জনগণের ওপর মর্মস্পশী স্বৈরচারী শাসন পরিচালনা হতে থাকে এবং আল্লহর বিধি-বিধানকে বিভিন্নভাবে অবহেলিত হতে থাকে। যেসব প্রতিষ্ঠানে আল্লহর নাম উচ্চরিত হয়, সেগুলো গুরুত্বহীন প্রতিষ্ঠানে পরিণত করার জন্য সর্বাত্বক প্রচেষ্টা চালানো হয়। রাষ্ট্র যখন বলে দিয়েছে, তখন আর সে বিষয়ে জনগণের কিছু বলবার সুযোগ থাকে না। তার কথাই হবে আইন, জনগণ তা অকুণ্ঠিত মনে ও নির্বাক চিত্তে মেনে নিতে হবে। তার শাসনের যাঁতাকলে জনগণ নির্বোধ বনে যাচ্ছে। কেউ তার স্বাধীন বিমুক্ত চিন্তা-বিবেচনা শক্তিও প্রয়োগ করতে পারছে না। ফলে হযরত হোসাইন রাঃ শঙ্কিত হয়ে পড়েন এবং নিজের সর্বশক্তি প্রয়োগ করে স্বৈরশাসকের গতিরোধ করতে গিয়ে শহীদ হন।
৩. বর্তমানের স্বৈরতন্ত্র :
আন্তর্জাতিক স্বৈরাচারঃ একটি হলো আন্তর্জাতিক ন্বৈরাচার। সে দূর্দণ্ড প্রতাপ নিয়ে বিভিন্ন অজুহাত তথা ‘গণতন্ত্র পুণরুদ্ধার’ ‘সন্ত্রাস দমন’ ইত্যাদি সৃষ্টির মাধ্যমে দেশে দেশে যেখানে যেটি প্রযোজ্য সেটি ব্যবহার করে মূলতঃ তারাই সন্ত্রাস করে যাচ্ছে এবং জোর পূর্ব্ক নিজেদের স্বৈরতান্ত্রিক ও জুলুমতান্ত্রিক চিন্তাধারা অন্যদের ওপর চাপিয়ে দেয়ার কোশেশ করছে। অন্যদিকে মুসলমানদেরকে সন্ত্রাসী আখ্যা দিয়ে গায়ের জোরে পৃথিবীর মানবতার সাথে পাশবিক আচরণ করছে। এরা দেশের সীমানা প্রাচীর অতিক্রম করে মরণান্ত্র নিয়ে অন্যের প্রাচীরের ভেতর প্রবেশ করার জন্য কোন লাইসেন্সের প্রয়োজন হয় না। অন্যের ভৌগোলিক সার্বভৌমত্বকে যে কোন সময় তছনছ করে প্রবেশ করার অধিকার তার রয়েছে। কারো নিন্দা জ্ঞাপণ বা আন্তর্জাতিক নিয়ম-কানুনকে সে পরোয়া করে না। এরা পৃথিবীর দেশে দেশে বহু দালাল ও লোভী শ্রেনীর স্বৈরাচার সৃষ্টি করেছে। তাদের সহযোগীতা নিয়ে বর্তমানে দেশে দেশে নিরীহ মানবতার রক্তের হোলী খেলায় মেতে উঠেছে।
দেশীয় স্বৈরাচারঃ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বাঁকা পথে ক্ষমতারোহী কিছু শাসক রয়েছে যারা স্বৈরাচারী কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। এরা সাধারণত আন্তর্জাতিক স্বৈরাচারের দোসর অথবা দালাল অথবা উচ্ছিষ্টভোগী হয়ে থাকে। কোন কোন দেশের শাসক পার্শ্ববর্তি দেশের সমর্থন ও সহগোগীতা নিয়ে জনগণের ওপর শাসণ চালায়। দেশের সম্মানিত লোকদের অপমানিত করে। পরবর্তি ক্ষমতারোহনের পথে যারা হুমকী, তাদের জেল-জরিমানা, জুলুম-নির্যাতন এমনকি দুনিয়া থেকে বিদায় করে দেয়ার পদক্ষেপ গ্রহণ করে। ক্ষমতাকে অব্যাহত রাখার জন্য বা স্বৈরতন্ত্রকে পাকাপোক্ত করার জন্য এরাই আন্তর্জাতিক স্বৈরাচারকে নিজ দেশে ডেকে আনে এবং জনগণের ওপর অত্যাচার চালায়।
এ উভয় শ্রেনী একটি বৈশিষ্ট্যে গভীর মিল রয়েছে, তাহলো ইসলামের সাথে বৈরীতা পোষণ করা। ইসলামকে খুবই ভয় পায়। কারণ অন্যান্য শ্রেনী-গোষ্ঠীর লোক হয়ত এক সময় স্বৈরতন্ত্রের সাথে মিশে যেতে পারে। কিন্তু ইসলাম, ইসলামী প্রতিষ্ঠান ও এর সাথে সংশিষ্ট জনগোষ্ঠী কখনো স্বৈরতন্ত্রের সাথে হাত মিলাতে পারে না। বরং ইসলাম স্বৈরতন্ত্রকে উৎখাত করে সেখানে ন্যায়-ইনসাফ ও মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা করে। এ জন্য স্বৈরাচারদের পথে প্রথম ও প্রধান বাধা হলো ইসলাম। তাই তারা প্রথমে ইসলামকে উৎখাত করার চেষ্টা চালায়। নানা অজুহাত সৃষ্টি করে এদের ওপর অত্যাচারের ষ্ঠীমরোলার চালায়।
৪. আমাদের করণীয়: ইমাম হোসাইন রা: শাহাদাত আমাদের জন্য প্রেরণার বাতিঘর। আমাদেরকে ঈমামের শাহাদাতের মুল উদ্দেশ্য ভালো করে উপলব্ধি করতে হবে। ইসলামী রাষ্ট্রের বুনিয়াদী নীতি সংরক্ষণের জন্য ইমামের শাহাদাত ছিল এক ঐতিহাসিক নযরানা। আমাদেরকে প্রথমতঃ ইসলামী সমাজ বিনির্মানের পথে এগিয়ে আসতে হবে। তবেই ইমামের প্রতি ভালবাসার যর্থার্থতা প্রকাশ পাবে। মনে রাখতে হবে এ পথে বাঁধ সাজবে পৃথিবীর তাবত তাগুতী শক্তি ও কায়েমী স্বার্থবাদী গোষ্ঠী। ইমাম হোসাইন রা:-এর মতো দৃঢ ঈমান নিয়ে আমাদেরকে এ সকল শক্তির মোকাবেলায় এগিয়ে যেতে হবে।