বঙ্গবন্ধু-উত্তর বাংলাদেশে অপশক্তির পুনরুত্থান

Published: 13 August 2021

।। হারুন হাবীব।।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ডটি ঘাতক গোষ্ঠীর নিছক হঠকারিতার ফসল ছিল না—ছিল নবপ্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশ রাষ্ট্রবিরোধী জাতীয় ও আন্তর্জাতিক চক্রান্তের ফসল। সেদিনের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, কমিউনিস্ট চীন এবং প্রভাবশালী মুসলিমপ্রধান দেশগুলো পাকিস্তানের বিভক্তি সমর্থন করেনি। তারা প্রায় সবাই পাকিস্তান সেনাবাহিনী ও তাদের স্থানীয় দোসরদের হাতে নির্বিচারে বাঙালি গণহত্যা, ধ্বংসযজ্ঞ ও নারী নির্যাতন সমর্থন করেছে, তথাকথিত ‘রাষ্ট্রকৌকল’ বা ধর্মরক্ষার নামে! অতএব দেশি-বিদেশি চক্রান্তের ফসল হিসেবে বিশ্বাসঘাতক কিছু সপক্ষীয় রাজনীতিকের যোগসাজশে, সেনাবাহিনীর একদল বিপথগামী সদস্যের নির্মম বুলেটে নিহত হন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জনক।

সর্বাত্মক মুক্তিযুদ্ধের পর চরম এক বিপর্যয়কর অবস্থার মধ্য দিয়ে নতুন রাষ্ট্রের যাত্রা শুরু করেন বঙ্গবন্ধু। দেশের গুদামে খাবার ছিল না—২৭৮টি রেল ব্রিজ, ২৭০টি সড়ক ব্রিজ ধ্বংসপ্রাপ্ত। পাকিস্তানি সেনারা বন্দরগুলোতে মাইন বসিয়ে রেখেছিল। ব্যাংকের টাকা-পয়সা জ্বালিয়ে দিয়েছিল। কলকারখানাগুলো বন্ধ ছিল। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, ল্যাবরেটরি ধ্বংস করা হয়েছিল। এমনকি গ্রামীণ জনপদের স্কুলগুলোর ফার্নিচার জ্বালিয়ে পাকিস্তানি সেনা ও তাদের দেশীয় অনুচররা রুটি বানিয়ে খেয়েছে। অতএব দেশে চলতে থাকে খাদ্যশস্যের সংকট। আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেল ও খাদ্য সংকটের পাশাপাশি মূল্যস্ফীতির চ্যালেঞ্জও মোকাবেলা করতে হয় বঙ্গবন্ধুর সরকারকে। কিন্তু তার পরও বঙ্গবন্ধুর অসামান্য নেতৃত্বে যুদ্ধবিধ্বস্ত অবকাঠামো এবং অর্থনীতি দ্রুত ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করে।

জাতির পিতার স্বপ্ন ছিল শোষণহীন সাম্যের বাংলাদেশ। তাঁর প্রথম মে দিবসের ভাষণে তিনি বলেছিলেন : ‘অতীতে আমরা একটি মর্মান্তিক পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থার নিগড়ে বাঁধা পড়ে গিয়েছিলাম। গুটিকয়েক সুবিধাবাদী ব্যক্তি ও গোষ্ঠী জাতীয় সম্পদ ও শ্রমজীবী মানুষের উৎপাদন নিজেদের কুক্ষিগত করে রেখেছিল। দেশ আজ স্বাধীন। সম্পদের মালিক জনগণ। তাই কোনো শ্রেণিবিশেষের ভোগ লালসার জন্য এবং লোভ চরিতার্থ করার নিমিত্তে এই সম্পদকে অপচয় করতে দেওয়া যাবে না।’

জাতির পিতা ছিলেন দৃঢ়চিত্ত। তিনি প্রায়ই বলতেন, বাংলাদেশ এসেছে, বাংলাদেশ থাকবে, কেউ তাকে ধ্বংস করতে পারবে না। কারণ ৩০ লাখ মানুষের আত্মত্যাগ বৃথা যেতে পারে না। লাখো নারীর সম্ভ্রম বৃথা যেতে পারে না। লাখো মুক্তিযোদ্ধার আত্মত্যাগ বৃথা যেতে পারে না। কিন্তু বঙ্গবন্ধু কি কখনো ভাবতে পেরেছিলেন কেউ তাঁকে হত্যা করতে পারে তাঁরই সৃষ্ট বাংলাদেশে? তিনি কি কখনো ভাবতে পেরেছিলেন তাঁর মৃত্যুর পর এই বাংলাদেশে আবারও সামাজিক ও রাজনৈতিক অপশক্তি জেঁকে বসবে এবং মুক্তিযুদ্ধে অর্জিত সাফল্যগুলো বিপন্ন করবে?

অতএব বাস্তবতা হচ্ছে এই, যারা বাংলাদেশ চায়নি, সাম্যের সমাজ চায়নি, মুসলমানপ্রধান এই জনপদে জনগণতান্ত্রিক রাষ্ট্র চায়নি, তারা ১৯৭১-এ পরাজিত হলেও নতুন করে বাংলাদেশকে ধ্বংস করতে তৎপর হয়েছিল।

স্মরণযোগ্য, পাকিস্তানি সাম্প্রদায়িক ও লুটেরা রাষ্ট্রকাঠামো এবং সামরিকতন্ত্রের বিরুদ্ধে শেখ মুজিবুর রহমান একটি সফল এবং ঐতিহাসিক জনবিপ্লব সম্পন্ন করেছিলেন—পত্তন ঘটিয়েছিলেন একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্রের। সেই গণবিদ্রোহ এতটাই সার্থক ছিল যে একদিকে তা শোষণ-বঞ্চনাপিষ্ট স্বৈরতন্ত্রী পাকিস্তানি রাষ্ট্রকাঠামোকে ভেঙেছে, অন্যদিকে ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের ভিত্তি দান করেছে। ভুললে চলবে না, মুক্তিযুদ্ধের মাত্র ৯ মাসের মাথায় বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়নের কাজটি শুধু সময়ের দিক থেকেই বিস্ময়কর ছিল না, তা ছিল বিশ্বের গোটা মুসলিমপ্রধান জনপদের মধ্যে একমাত্র আধুনিক জনগণতান্ত্রিক সংবিধান। আর সেই দুঃসাহসী কাজটি সম্পন্ন হয়েছিল শুধু জাতির পিতার নেতৃত্বে।

বঙ্গবন্ধু যথার্থই উপলব্ধি করেছিলেন ধর্ম ব্যক্তির বড় অবলম্বন; কিন্তু রাষ্ট্র ধর্ম-বর্ণ-ছোট-বড়-নির্বিশেষ সবার সমান অধিকার সংরক্ষণের ক্ষেত্র। রাষ্ট্রপিতা এটিও উপলব্ধি করেছিলেন—ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্রনীতি ধর্মের ঔদার্যকেই শুধু খর্ব করে না, রাষ্ট্রকেও সংকুচিত করে, বিনাশ করে। কাজেই একজন খাঁটি মুসলমান হয়েও তিনি ধর্মীয় রাজনীতি সমর্থনের কারণ খুঁজে পাননি। সে কারণেই পাকিস্তানের বন্দিদশা থেকে স্বদেশে ফিরে ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি তিনি উচ্চারণ করেছিলেন, ‘আমি স্পষ্ট ভাষায় বলে দিতে চাই যে বাংলাদেশ একটি আদর্শ রাষ্ট্র হবে। আর তার ভিত্তি বিশেষ কোনো ধর্মীয়ভিত্তিক হবে না। রাষ্ট্রের ভিত্তি হবে গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা। এ দেশের কৃষক-শ্রমিক-হিন্দু-মুসলমান সুখে থাকবে, শান্তিতে থাকবে।’ এই ঘোষণা বাস্তবায়নের পথে তিনি যখন মনোনিবেশ করেছিলেন, যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশকে গড়ে তুলতে আরেক যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছিলেন, ঠিক তখনই তাঁকে হত্যা করা হয়েছে।

আরো একটি বিষয়ের অনুধাবন সংগত হবে। মুক্তিযুদ্ধে পরাজয়ের পরও দ্বিজাতিতত্ত্বের অনুসারীরা বাঙালির অসাম্প্রদায়িক জাতিসত্তা গ্রহণ করেনি। বাঙালি যখনই অসাম্প্রদায়িক জাতীয় গৌরব নিয়ে সামনে এগিয়েছে, বিরোধীরা তখনই ‘ধর্ম গেল’, ‘ইসলাম গেল’ বলে চেঁচিয়েছে। তাদের শোরগোলে সাধারণ ধর্মপ্রাণ জনগোষ্ঠী বিভ্রান্ত হয়েছে। অথচ বাংলাদেশের পাঁচ দশকের অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, বাঙালি কখনো ধর্মচ্যুত হয়নি, বরং ধর্মের মর্যাদা রক্ষা করে সে তার অসাম্প্রদায়িক জাতিসত্তার গৌরবকে সুদৃঢ় করেছে।

মনে রাখা উচিত যে পাকিস্তানের জেল থেকে মুক্ত হয়ে ১৯৭২-এর ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু প্রত্যাবর্তন করলেও তাঁর এই প্রত্যাবর্তন তাঁর দলেরই কারো কারো মর্মবেদনার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। এই শ্রেণিটি শুধু ঈর্ষাকাতরই হয়নি, হিংস্রও হয়ে উঠেছিল। মোটকথা মুক্তিযুদ্ধকে যারা বিফল করতে চেয়ে বিফল হয়, তারাই সম্মিলিতভাবে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মধ্য দিয়ে পরাজিত পাকিস্তানের প্রেতাত্মাকে নতুন দেশের ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা সম্পন্ন করে। বঙ্গবন্ধু এই অপশক্তি সম্পর্কে সচেতন ছিলেন বটে; কিন্তু যে প্রবল প্রতিকূল পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় তাতে ষড়যন্ত্রকারীদের আঘাত হানার পথ প্রশস্ত হয়।

১৯৭৫-এর রক্তাক্ত পটপরিবর্তনের পর থেকেই হত্যাকারীদের মুখোশ উন্মোচন হতে থাকে। ধারাবাহিকভাবে চলতে থাকে জাতীয় রাজনীতির দুর্বৃত্তায়ন, ঘটানো হয় বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অস্তিত্ববিরোধী অপশক্তিগুলোর পরিকল্পিত বিকাশ। খুনি বাহিনীর নেতৃত্বে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে হত্যা করা হয় বঙ্গবন্ধুর চার ঘনিষ্ঠ সহযোগীকে—যাঁরা মুক্তিযুদ্ধের সশস্ত্রপর্বের নেতৃত্ব দিয়েছেন। এরপর সেনানিবাসের ক্ষমতালিপ্সুদের ধারাবাহিক ক্ষমতার লড়াইয়ের পর এক শ্রেণির পাকিস্তানফেরত এবং কিছু ক্ষমতালোভী মুক্তিযোদ্ধা অফিসারের সমর্থনে উচ্চাভিলাষী জেনারেল জিয়াউর রহমানের অধিষ্ঠান ঘটে ক্ষমতায়।

বলতে দ্বিধা নেই যে জেনারেল জিয়ার শাসনামলে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও চেতনাসিক্ত রাষ্ট্রীয় সংবিধানকে শুধু কাটছাঁটই করা হয়নি, রাষ্ট্রকে পরিকল্পিত পন্থায় নতুন করে সাম্প্রদায়িক বানানো হয়েছে। ক্রমান্বয়ে এলেন জেনারেল এরশাদ, খালেদা জিয়া। পূর্বসূরির পদাঙ্ক অনুসরণ করে এঁদের আমলেও গজিয়ে উঠল নব্য সুবিধাবাদী লুটেরা—লুম্পেনের দল, যারা রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় পূর্ণ দাপটে বিস্তৃত কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হলো। এই শ্রেণিতে অন্তর্ভুক্ত হলো যেমন মুক্তিযুদ্ধের প্রত্যক্ষ বিরোধী ব্যক্তিরা, অন্যদিকে যারা মুখে প্রগতিশীলতার কথা বললেও মূলত সামরিক শাসনের তল্পিবাহক হিসেবে নিজেদের সীমাবদ্ধ রাখল।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব তিনি রাজনীতিকে মধ্যযুগীয় সাম্প্রদায়িক আবর্ত থেকে উদ্ধার করে আধুনিক ধর্মনিরপেক্ষ ধারায় প্রবাহিত করেছিলেন। ১৯৭০-এর দশকে বাঙালি মানসে যে অভূতপূর্ব দেশপ্রেম, তা ছিল জাতি-ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষে সব সম্প্র্রদায়ের মানুষকে অভাবিত উজ্জীবিত করার; আগে যা সম্ভব হয়নি তা-ই সম্ভব হলো বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হাতে। বলা বাহুল্য, পঁচাত্তর-উত্তর কালে সেই উজ্জীবনকেই আঘাত করা হলো। প্রথম করলেন জেনারেল জিয়া, তাঁকে অনুসরণ করল তাঁর পরের শাসকরা। সরকারি পর্যায়ের প্রতিটি স্তরে বসানো হলো পরীক্ষিত স্বাধীনতাবিরোধীদের। অপসারণ করা হলো মুক্তিযোদ্ধাদের। পাঠ্যপুস্তক থেকে শুরু করে সরকার নিয়ন্ত্রিত প্রচারমাধ্যমে ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতার বীজ ছড়ানো হলো। মুক্তিযুদ্ধের ঘাতকদের প্রকাশ্যে পুনর্বাসিত করা হলো, অর্থনীতিতে তাদের জায়গা করে দেওয়া হলো।

মোটকথা বাঙালির অসাম্প্রদায়িক সংস্কৃতির ওপর পুনর্জাগরিত অপশক্তির এই আঘাত চলতে থাকে প্রায় দুই যুগ। বিকাশ ঘটে একটি লুম্পেন শ্রেণির, যাদের ধারাবাহিক আগ্রাসনে বাংলাদেশ রাষ্ট্র পথভ্রষ্ট হয়, বিভাজিত হয়, নতুন প্রজন্মের একটি বড় অংশ প্রতারিত হয়, জাতীয় মুক্তিযুদ্ধের গৌরবকে খণ্ডিত করা হয়। এই পথভ্রষ্টতা ছিল বঙ্গবন্ধু-উত্তর কালের একটি বড় বিজাতীয় অর্জন। যে ভারত মুক্তিযুদ্ধের প্রধানতম সহযোগী, সেই রাষ্ট্রকে মুক্তিযুদ্ধের পরপরই বাংলাদেশের স্বার্থবিরোধী বলে চালাবার চেষ্টা হয়। এসব প্রচারণা সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু জানতেন বটে; কিন্তু ষড়যন্ত্র ঠেকানো সম্ভব হয়নি। অনস্বীকার্য যে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের কাছে তার জনকের হত্যাকাণ্ডের বিচার সম্পন্ন হওয়ার বিষয়টি যেমন বড় জাতীয় দায়মুক্তির, তেমনি দায়মুক্তি মুক্তিযুদ্ধের সময় যারা পাকিস্তানি সেনাদের বর্বরতার দোসর হয়ে মানবতার বিরুদ্ধে ঘৃণ্যতম অপরাধ করেছে, নির্বিচারে গণহত্যা ও নারীর সম্ভ্রমহানি করেছে, ঘরবাড়ি জ্বালিয়েছে, অপহরণ ও ক্ষতিগ্রস্ত করেছে লাখো নিরস্ত্র মানুষকে, সেই শীর্ষ অপরাধীদের বিচার সম্পন্ন করা।

কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, এই বড় কাজ দুটির সম্পাদনই কি মুক্তিযুদ্ধের প্রত্যাশিত বাংলাদেশকে সুরক্ষা দান করবে?

আমার বিশ্বাস, না। এই দুই কাজের ওপর দাঁড়িয়ে বাংলাদেশ সামনে এগোবার সিঁড়ি ফিরে পেয়েছে মাত্র, যে সিঁড়ি সরিয়ে নেওয়া হয়েছিল। অতএব আত্মতুষ্টির সুযোগ কম। সে কারণেই বিশ্বাস করি, বাংলাদেশের মতো একটি রাষ্ট্রের যাত্রাপথ অবারিত করতে প্রয়োজন একটি রেনেসাঁ, একটি নবজাগৃতি, একটি সাংস্কৃতিক নবজাগরণ, যা সাম্প্রদায়িকতার গ্রাস থেকে জাতিকে মুক্ত করবে, মানবিক করবে, স্লোগানের রাজনীতির বাইরে বেরিয়ে যুবতারুণ্যকে মানুষ করবে—বাঙালি করবে।

ইতিহাসের এই সত্য অনুধাবন করা জরুরি যে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ, যা সব ধর্ম-বর্ণের মানুষকে একাত্ম করে জাতিকে স্বাধীনতার ময়দানে নামিয়েছিল, তা ছিল এই জনপদের এক নবজাগৃতি। যদিও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক নেতৃত্বের পথ ধরেই সে জাগৃতি ঘটেছিল, তথাপি তাকে নতুন মাত্রা দিয়েছিল বাংলার আবহমান সংস্কৃতি শক্তি—যার ভিত্তিমূলে ছিলেন লালন, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, জীবনানন্দ ও সুকান্ত।

১৯৭১ থেকে কয়েক দশকের ঘটনাপ্রবাহ দেখে আমার মনে হয়েছে, মুক্তিযুদ্ধের পুনরুদ্ধারকৃত চেতনার নবযাত্রাকে নিষ্কণ্টক করতে হলে রাজনীতির নতুন কুশীলবদের আদর্শিক বা সাংস্কৃতিকভাবে সশস্ত্র হতে হবে। অনুধাবন করতে হবে যে পাকিস্তান আমলের ২৩ বছরে যে শত্রু ছিল চিহ্নিত এবং দূরের, তারা আজ অচিহ্নিত এবং কাছের। অতএব অভিজ্ঞতার আলোকে নতুন যাত্রাপথ চিহ্নিত করতে হবে। আর সে কারণেই প্রয়োজন আদর্শিক ও ত্যাগী রাজনৈতিক কর্মী, যাঁরা বঙ্গবন্ধু ও জয় বাংলাকে শুধু কণ্ঠে নয়, আত্মায় ধারণ করার সামর্থ্য অর্জন করবেন।

মোদ্দাকথা, মুক্তিযুদ্ধের চেতনাধারী রাজনীতির ক্ষমতায় দীর্ঘকালীন অধিষ্ঠান সত্ত্বেও বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশের চ্যালেঞ্জ আগের চেয়ে কম নয়। কারণ স্বাধীনতার প্রতিপক্ষ এ রাষ্ট্রকে স্থিতিশীল দেখতে চাইবে না; গজিয়ে ওঠা ‘নব্য পাকিস্তানিরা’ লাখো শহীদের রক্তে গড়া বাংলাদেশকে ব্যর্থ করতে চাইবে; একাত্তরের পরাজয়ের শোধ নিতে চাইবে। কাজেই প্রয়োজন সতর্কতার; প্রয়োজন নবজাগৃতির। নতুন এই যুদ্ধকে শুধু রাজনীতিতে সীমাবদ্ধ রাখলে চলবে না। রাজনৈতিক যুদ্ধের পাশাপাশি সামাজিক ও সাংস্কৃতিক যুদ্ধকে এগিয়ে নিতে হবে; মুক্তিযুদ্ধের মৌল আদর্শকে ছড়িয়ে দিতে হবে; মনে রাখতে হবে যে ধর্মান্ধ দেশি বা বিদেশি অপশক্তির সঙ্গে আপস করার ভুল আত্মঘাতী হবে। আরো ভুললে চলবে না যে অসাম্প্রদায়িক জাতিসত্তার শত্রুরা প্রাথমিকভাবে পরাজিত হলেও দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধে নেমেছে। কাজেই আত্মতুষ্টির সুযোগ নেই। আজ ২০২১ সালে দাঁড়িয়েও বলা যায়, সতর্কতা বড় বেশি জরুরি।
লেখক : মুক্তিযোদ্ধা, লেখক ও মুক্তিযুদ্ধ গবেষক