আল্লাহর নিদর্শন দেখতে বাইতুল্লাহ-এ আসুন

Published: 27 August 2021

।। জাফর আহমাদ ।।


আল্লাহর ঘর বাইতুল্লাহ পৃথিবীর প্রথম ইবাদাত গৃহ। আল্লাহ বলেন,“নি:সন্দেহে মানুষের জন্য সর্বপ্রথম যে ইবাদাত গৃহটি নির্মিত হয় সেটি মক্কায় অবস্থিত। তাকে কল্যাণ ও বরকত দান করা হয়েছিল এবং সমগ্র বিশ^বাসীর জন্য হিদায়াতের কেন্দ্রে পরিণত করা হয়েছিল। তার মধ্যে রয়েছে সুষ্পষ্ট নিদর্শনসমূহ এবং মাকামে ইবরাহিম বা ইবরাহিমের ইবাদাতের স্থান। আর তার অবস্থা হচ্ছে এই যে, যে তার মধ্যে প্রবেশ করেছে, সে নিরাপত্তা লাভ করেছে। মানুষের মধ্য থেকে যারা সেখানে পৌঁছার সামর্থ রাখে, তারা যেন এই গৃহের হজ্জ সম্পন্ন করে, এটি তাদের ওপর আল্লাহর অধিকার। আর যে ব্যক্তি এ নির্দেশ মেনে চলতে অস্বীকার করে তার জেনে রাখা উচিত, আল্লাহ বিশ্বাবসীর মুখাপেক্ষী নন।(আল ইমরান:৯৬,৯৭)

পৃথিবীর দেশে দেশে আকাশছোঁয়া ভবন দেখেছেন, শৈল্পিক কারুকার্য সম্বলিত বিখ্যাত কতসব ভবন আপনার নযর কেড়েছে, আপনি আসুন পাহাড়ে ঘেরা সেই ওয়াদিল মুকাদ্দাসে যেখানে আল্লাহর ঘর অবস্থিত। গভীর মনোনিবেশ সহকারে আপনি প্রত্যক্ষ করবেন, আল্লাহর এই ঘরের চেয়ে উঁচু ভবন পৃথিবীতে আর কোনটি আপনার মনে হবে না। কালো গিলাফে ঢাকা ঘরটির সৌন্দর্য ও আভিজাত্য আপনার দৃষ্টিকে বার বার মোহিত করবে। সমুদ্রের বিশালতা যেভাবে আপনার মন-মানসে বিশেষ পরিবর্তন সৃষ্টি করে আল্লাহর এ ঘরটিও আপনার মন-মানসকে বিশালতার দিকে নিয়ে যাবে। কাবার এই মহানত্ব সম্পর্কে বাংলা সাহিত্যের একজন প্রখ্যাত সাহিত্যিক সৈয়দ আলী আহসান লিখেছেন, “স্থাপত্যের কৌশলের দিক থেকে কাবা গৃহ নির্মল, নিশ্চিন্ত, পরিচ্ছন্ন এবং অফুরন্ত বিনয় ও প্রেমের উৎস। এই বিনয় এবং প্রেমের সমর্থনে কাবা গৃহ মর্যাদাবান এবং ইসলামী উম্মাহর সকল প্রেরণার কেন্দ্রভ’মি। হারাম শরীফের আলোকিত বিপুল চত্বরের মাঝখানে পবিত্র কাবার অবস্থিতি গৃহটিকে আলৌকিক আকর্ষণে মন্ডিত করেছে। হারাম শরীফের বিপুল চত্বরের উন্মুক্ততা কাবা গৃহটিকে এমনভাবে বেষ্ঠন করে রেখেছে যে, সহজেই এই উন্মুক্ত এলাকার সঙ্গে কাবা গৃহের একটি স্থাপত্যগত একটি সম্পর্ক নির্ধারিত হয়। কাবা গৃহের অভ্যন্তরভাগ উন্মুক্ত নয়। কিন্তু চতুর্দিকের উন্মুক্ততা এবং উর্ধ্বাকাশের উন্মুক্ততা কাবা গৃহকে একটি বিপুল উন্মুক্ততার অংশভাগী করেছে। এককভাবে গৃহটি কোনো বিশেষ পার্থিব শিল্পকুশলতা বহন করে না, কিন্তু হারাম শরীফের বিপুল চত্বরের মাঝখানে গৃহটিকে একটি আলৌকিক অবস্থিতি বলে বিশ্বাস জন্মে।”

সারা পৃথিবীর মানুষের কাছে অত্যন্ত আকাংখার বন্তু এই ঘর। যার কারণে পৃথিবীর প্রতিটি অঞ্চল, প্রতিটি জনপদের লোকেরা এই ঘরের প্রতি প্রবল আকর্ষণ ও আবেগ অনভুতি নিয়ে চলে আসে। খরত্বাপ রোদ্র, আগুনে তাপমাত্রা, ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা ও অস্থির এক পরিবেশের মাঝে কালো গিলাফে ঢাকা এ ঘর সর্বদা শান্তির প্রলেপ বুলিয়ে যায়। দুর দিগন্তের ক্লান্ত-শ্রান্ত মুসাফির সাত সমুদ্রের ধকল নিয়ে যখন এ ঘরের কাছে আসে এবং তার প্রতি দৃষ্টি নিক্ষেপ করে, সকল প্রকার দু:খ-কষ্ট মহুর্তের মধ্যে দূরীভুত হয়ে যায়। ধূ ধূ মরভূমির দেশে কঠিণ পাথরে পর্বতমালায় ঘেরা পাহাড়ী উপত্যকায় অবস্থিত এ যেন এক প্রবন, যা নীরস শুস্ক কঠিণ হৃদয়ের মরুভুমিকে আবহমানকাল ধরে সিক্ত করে চলেছে।

কালো গিলাফে ঢাকা আল্লাহর ঘর যাকে কেন্দ্র করে পৃথিবীর সবকিছু ঘুরছে, যাকে ঘিরে মানুষের সামগ্রীক জীবন ব্যবস্থা আবর্তিত হয়। মানুষের ব্যক্তিগত জীবন থেকে শুরু করে তার পারিবারিক, সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক জীবন ব্যবস্থা এ ঘরের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। হজ্ব মৌসুমসহ প্রায় সার উল্লেখিত দু’টি আয়াতের অংশ বিশেষের প্রতি “এবং সমগ্র বিশ^বাসীর জন্য হিদায়াতের কেন্দ্রে পরিণত করা হয়েছিল” সম্মানিত পাঠকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই। বাইতুল্লাহ নিছক শুধূ কোন ইবাদাত গৃহই নয় বরং বিশ^বাসীর জন্য হিদায়াতের প্রাণ কেন্দ্র। অর্থাৎ মানুষের সামগ্রীক জীবন ব্যবস্থা এই ঘরের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। মানুষের ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ, অর্থনীতি, রাজনীতি, সংস্কৃতি, আইন ও আদালত এই ঘরকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠবে এটিই এই আয়াতের দাবী। যদি এই ঘরকে কেন্দ্র করে মানুষের সামগ্রীক জীবন ব্যবস্থাকে ঘরে তোলা হয় হয়, তবে এ আয়াতের আরো অঙ্গীকার হলো, মানুষের সামগ্রীক জীবন ব্যবস্থায় কল্যাণ ও বরকত নেমে আসবে এবং তাদের মধ্যে এমন শান্তি নেমে আসবে যে, তারা সর্বদা চিন্তা ও ভয় মুক্ত থাকবে এবং শারীরিক কি মানসিক, সামাজিক কি অর্থনৈতিক সকল অবস্থায় পূর্ণ নিরাপত্তা লাভ করবে।

এই নিয়ামাত তথা কল্যাণ ও বরকত প্রত্যক্ষভাবে অনুভব ও অবলোকন করার জন্য পৃথিবীর সামর্থবান লোকদেরকে যিয়ারতের উদ্দেশ্যে সেখানে ডেকে পাঠানো হয়। যার নাম হজ্জ। সম্মনিত সামর্থবান হজ্জযাত্রীগণ! একটি বিষয়ে আপনাদের মনোযোগ আকর্ষণ করছি, আমরা আমাদের নামাযসমূহে আল্লাহর এই ঘরকে কেবলা নির্ধারণ করি। কিন্তু নামাযের বাইরে আমাদের বিশাল জীবনের কেবলা কোন দিকে তা কি একটু খতিয়ে দেখবেন? বিশেষত: রাজনীতির কেবলা, অর্থনীতির কেবলা, আইন-আদালতের কেবলা ইত্যাদি কোন দিকে একটু ভালো ভাবে দেখবেন। সত্যিকার অর্থে এগুলোর কেবলা কা’বামুখী নয়। বরং এ গুলোর জন্য মানুষের মস্তিস্ক প্রসূত বিভিন্ন মতবাদকে কেবলা বানানো হয়েছে।

সম্মানিত মু’মিন-মুসলমান ভাই ও বন্ধুগণ! পবিত্র কা’বার প্রতি যদি সত্যিকারের ভালবাসা আপনার অন্তরে থেকে থাকে, তবে আপনার সামগ্রীক জীবন ব্যবস্থাকে পবিত্র কা’বার দিকে রুজু করুন। হযরত ইবরাহিম আ: তৎকালিন রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজনীতিসহ তাঁর সামগ্রীক জীবনকে আল্লাহর দিকে রুজু করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ইন্নি ওয়াজজাহাতু ওয়াজহিয়া লিল্লাজি ফাতারাস সামাওয়াতি ওয়াল আরধা হানিফাও ওমা আনামিনাল মুশরিকিন। অর্থাৎ ‘আমি সেই সত্তার প্রতি মুখ ফিরালাম যিনি আসমান ও জমিন সৃষ্টি করেছেন। আমি মুশরিকদের অন্তর্ভূক্ত নই।”

আমরা নামাযের শুরুতে দিনে বেশ কয়েকবার এই কথাগুলো বলে থাকি। কিন্তু নামাযের বাইরে এসে কার আইন মানি, কার অর্থনীতি অনুসরণ করি, রাজনীতিতে কার পিছনে দৌঁড়াই? আপনি ঐ বক্তিকে কি বলবেন, যিনি কথা বলেন এক ধরণের, কিন্তু কাজ করে তার বিপরীত ধরণের’। ইবরাহিম আ: বলেছিলেন, ‘আমি মুশরিকদের অন্তর্ভূক্ত নই’ এর দ্ধারা তিনি তাঁর পিতার ধর্মনীতি, সমাজনীতি ও রাজনীতি সকল প্রকার আচার-আচরণ থেকে মুখ ফিরিয়ে কেবলই আল্লাহমুখী হয়েছিলেন। শুধু যদি ধর্মনীতি থেকে মুখ ফিরিয়ে অন্যান্য নীতি যদি তাদের হাতে ছেড়ে দিতেন, তাহলে তাঁকে অগ্নীপরীক্ষার সম্মুখীন হতে হতো না। তিনি কোন কিছুতেই আল্লাহর সাথে অংশীদারিত্ব মেনে নেননি। সুতরাং জীবনের সবকিছুর কেবলা বাইতুল্লাহর রবের দিকে ফিরাতে হবে। আল্লাহ বলেন,“কাজেই এ্ই ঘরের রবের ইবাদাত করা উচিত।”(সুরা কুরাইশ:৩)