“নৈতিকতা” সকল উন্নয়নের মূল চাবিকাঠি
।। জাফর আহমাদ ।।
নৈতিকতা খুবই রসহীন একটি শব্দ। এই নিয়ে কেউ কথা বললে তার প্রতি আগ্রহী লোকের সংখ্যা খুবই নগন্য পাবেন। এই যে প্্রবন্ধটি উপস্থাপন করা হচ্ছে তার পাঠক সংখ্যা কয়জন হবে আল্লাহ মালুম। আগেই বলে রাখি “নৈতিকতা” বলতে আমি তাকওয়াকে বুঝাচ্ছি। যেই তাকওয়া মানুষের চরিত্রকে সুন্দর করে, সমাজ ও সভ্যতাকে সুন্দর করে।
পৃথিবীর জীবনে সকল প্রকার উন্নয়নের জন্য নৈতিকতা একটি মৌলিক বিষয়। এটি এমন একটি উপাদান, এটিকে যেখানেই প্রয়োগ করবেন সেখানটায় উন্নয়নের স্রোতধারা প্রবলবেগে বহতে থাকবে। ব্যক্তি জীবনে প্রয়োগ করুন, ব্যক্তি সোনার মানুষে পরিণত হবে। পরিবারে প্রয়োগ করুন, আদর্শ পরিবার গড়ে উঠবে। যেই সমাজ ও রাষ্ট্রে প্রয়োগ করবেন, সেই সমাজ ও রাষ্ট্র সোনালী দিনের সমাজ ও রাষ্ট্রে রূপ নিবে। এমনিভাবে শিক্ষা-দীক্ষা, ব্যবসা-বাণিজ্য, ব্যাংক-বীমা, আইন-আদালতসহ মানুষের সামগ্রীক জীবনের যেখানটায় প্রয়োগ করবেন সেখানটায় একটা বৈপ্লবিক পরিবর্তন দেখবেন।
নৈতিকতার অনুপস্থিতির কারণে পৃথিবী দিন দিন ধ্বংসের দিকে দ্রুত গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে। বিশ্ব নেতৃবৃন্দ ও সমাজ-সভ্যতার তথাকথিত গ্রেড থিন্কাররা বিশ্ব শান্তির জন্য দিন-রাত মাড়িয়ে চলেছেন অনেকটা অন্তহীন মরুভুমির দিকভ্রান্ত পথিকের মত। দুঃখের বিষয় হলো, একান্ত হাতের কাছে,খুবই সহজপ্রাপ্য ও অত্যন্ত কার্যকরী নৈতিকতার প্রশ্নটি তাদের নযরে আসে না বা উর্বর মাথা দিয়ে তাদের চিন্তায় স্থান করে নিতে পারেন না। তবে খুব নিকট ইতিহাস থেকে জানা যায় যে, একেবারেই শেষ প্রান্তে এসে যখন ধ্বংস অনিবার্য হয়ে উঠে তখন অনুন্যপায় হয়ে ‘নৈতিকতা’ এর দ্বারস্থ হয়। আমরা এখানে আপাতত মরণব্যাধী এইডস ও ইয়াবাকে উদাহরণ হিসাবে পেশ করতে পারি। সারা পৃথিবীর চিকিৎসা বিজ্ঞানী, সমাজ বিজ্ঞানী, বুদ্ধিজীবিসহ প্রায় সকল চিন্তাবিদ অনেক পথ মাড়িয়ে এসে শেষাবধি তাদের উপলব্ধি হলো যে, মরণব্যাধি এইডস্ থেকে বাঁচতে হলে ‘ধর্মীয় অনুশাসন মানতে হবে’ ‘বা ধর্মীয় জীবন-যাপন করতে হবে’। তারা নর-নারীর অবাধ মেলামেশা, উদ্দাম, উশৃংখল ও বিকৃত যৌনাচার এইডসের প্রধান কারণ হিসাবে উল্লেখ করেছেন। আর এর পরিণাম হলো নিশ্চিত মৃত্যু।
আমাদের কথা হলো, শুধূমাত্র মরণব্যাধি এইডস্ কেন? জীবনের সামগ্রীক কল্যাণ ও মুক্তির জন্য অবশ্যই নৈতিকতা তথা ধর্মীয় অনুশাসন মানতে হবে। চারদিকে শুধু অবক্ষয় আর অবক্ষয়। মানুষের ব্যক্তি ও জাতীয় চরিত্রের চরম অধঃপতন, পারিবারিক ও সামাজিক সুশৃংখল কাঠামোর ভাঙ্গন এবং রাষ্ট্রীয় নির্যাতন ও সন্ত্রাসসহ পৃথিবীতে আজ বিশাল এক ধ্বংসযজ্ঞ চলছে। দুর্নীতি , দুষ্কর্ম ও দুঃশাসন পৃথিবীকে গ্রাস করছে। দুনিয়া জুড়ে মানুষ মানুষের রক্তের হোলী খেলায় মেতে উঠেছে। ভোগের রাজ্যে চলছে অত্যাধিক মাতলামী। মোটকথা মানুষের ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র ও আন্তর্জাতিক জীবন আজ মরনব্যাধী এইডস্-এ আক্রান্ত। জীবনের সার্বিক সুস্থতার জন্য নৈতিকতাই এর একমাত্র প্রতিষেধক। আর নৈতিকতা বলতে ধর্মীয় অনুশাসনকে বলা হয়। আর ধর্মীয় অনুশাসন বলতে আল-কুরআনের শাসনকেই বুঝায়। তাই সামগ্রীক ধ্বংস থেকে মুক্তি পেতে হলে এবং সুন্দর এক পৃথিবীর সোনালী প্রভাত অবলোকন করার জন্য আল-কুরআনের কাছে অবশ্যই ফিরে আসতে হবে।
প্রকৃতপক্ষে মানুষ যখন আল্লাহর হুকুম অমান্য করে কোন প্রকৃতি বিরোধী কাজে লিপ্ত হয়, তখন আল্লাহর কঠিণ নিয়মে বাঁধা প্রকৃতি তাদের বিরুদ্ধে চলে যায়। ফলে বিভিন্ন অভিশাপ মানুষের ওপর নেমে আসে। পরম সত্তার দেয়া জীবন বিধান থেকে দুরে সরে গিয়ে যখন মানুষ নীতি-নৈতিকতা বিবর্জিত কাজে লিপ্ত হয় তখন আল্লাহ তা’আলা বিচ্যুত জাতির পরবর্তি প্রজন্মের সচেতনতার জন্য বিভিন্ন ধরণের ভয়ংকর নজির স্থাপন করেন। অতিতের ধ্বংসপ্রাপ্ত জাতিগুলোর ওপর নেমে আসা প্লাবন, মহামারি, পাথরবৃষ্টি, রক্তবৃষ্টি, পতঙ্গবৃষ্টি ও অতিবৃষ্টি-অনাবৃষ্টি, প্লেগ ও সুনামীর মত দুর্যোগগুলো ছিল তাদেরই হাতের কামাই। সাম্প্রতিক কোভিট-১৯ এর ব্যতিক্রম কিছু নয়। বরং তারই ধারাবাহিকতা।
আসলে নৈতিকতা এমন একটি উপাদান বা এমন একটি বিষয় যা সর্বাবস্থায় মনুষ্য জীবের সাথে থাকা জরুরী। অন্যথায় মানুষ ও অন্যান্য প্রাণীকুল মধ্যে পার্থক্য রেখা টানার মতো নৈতিক কোন উপায় থাকে না। মানুষ নৈতিক জীব এ জন্যই তো সে মানুষ। তার আছে মনুষত্য, মানবিক মূল্যবোধ, প্রেম, প্রীতি ও ভালবাসা। তার আছে উন্নত পর্যায়ের চিন্তা, উপলব্ধি জ্ঞান, বিবেক-বুদ্ধি ও উন্নত চরিত্র যা অন্য কোন প্রাণীদের নাই। যেমন আল্লাহ তা’আলা বলছেনঃ“আমি মানুষকে উন্নত কাঠামোয় তৈরী করেছি।”(সুরা ত্বিন) কিন্তু এ মানুষই যখন মনুষত্য তথা নৈতিকতা ও মানবিক মূল্যবোধকে বিসর্জন দেয় তখন সে হিংস্র পশুদেরকেও ছাড়িয়ে যায় এবং সে ভয়ংকর এক আজিব প্রানীতে পরিণত হয়। কারণ হিংস্র প্রাণীরা কেবলমাত্র নিজের ক্ষুধার খাদ্য যোগাড় করার জন্য অন্য পশুদের শিকার করে। কোন পশু নিজের জিঘাংসা বা পাশবিকতা চরিতার্থ করার জন্য অন্য প্রাণীর ওপর হামলে পড়ে না।
মানুষের কর্মজীবনে নৈতিক স্বচ্ছতা এমন একটি উপাদান যা মানুষকে সকল প্রকার দূর্নীতি, দুস্কর্ম ও দূরাচারের উর্ধ্বে উঠে যাবতীয় নৈতিকতার কষ্টি পাথরে যাচাই করে ষ্ফটিকের মত স্বচ্ছভাবে কাজ করার জন্য প্রেরণা যোগায়। ইসলাম এমন এক জীবন ব্যবস্থা যা তার অনুসারীদের প্রতিনিয়ত এ ধরণের নৈতিক স্বচ্ছতার প্রতি দিক-নির্দেশ করে থাকে। ইসলাম এমন কতগুলো কর্মসূচী (ইবাদাত) দিয়েছে যা দৈনন্দিন আমাদের প্রতিটি কাজকে সুসংহত করে। আমরা যাতে নৈতিক স্বচ্ছতা বজায় রেখে আমাদের সকল কাজকর্ম সম্পাদন করতে পারি সেই অভ্যাস আমাদের মাঝে গড়ে তুলে। এ ধরণের নৈতিকমান সম্পন্ন ব্যক্তি-গোষ্ঠীকে যেখানেই স্থাপন করা হবে, সেখানেই উন্নয়নের ফল্গোধারা প্রবাহিত হবে। সেটি সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক বা অন্যান্য যে কোন প্রতিষ্ঠানেই হোক, সেটি খুব দ্রুত উন্নতি লাভ করবে। আমাদের চোখের সামনে ইতিবাচক ও নেতিবাচক উভয় উদাহরণ রয়েছে। আমাদের দেশের বিভিন্ন শিল্প-কলকারখানা ও অনেক জাতীয় প্রতিষ্ঠান লে-অফ ঘোষনার পিছনে যে কারণ দেখা যায় তাহলো অনৈতিক কার্যাবলী তথা দূর্নীতি, দুস্কর্ম ও দূরাচার। পক্ষান্তরে অত্যন্ত লাভজনক প্রতিষ্ঠান, তাদের উন্নয়নের জন্য এক দল আমানতদার, কর্মনিষ্ঠা ও নৈতিক স্বচ্ছতা সম্পন্ন কর্মীবাহিনীর অবদান।
আল্লাহ মানুষকে ভাল মন্দ যাচাই করার ক্ষমতা সম্পন্ন একটি বিবেক দান করেছেন। আর এ বিবেকের সামনে পেশ কেরেছেন হেদায়াত। প্রথম মানব হযরত আদমকে আঃ দুনিয়ায় প্রেরণ করে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলে দিলেন“ হয়ত আমার পক্ষ থেকে তোমাদের জন্য হিদায়াত আসতে পারে, যারা আমার এ হিদায়াতের অনুসরণ করবে তাদের কোন ভয় নেই এবং দুঃখ, চিন্তা থাকবেনা। (সুরা বাকারা ঃ৩৮) মানুষ যদি তার সুস্থ বিবেকের সাহায্যে আল্লাহর দেয়া হিদায়াত তথা ইসলামী জীবন ব্যবস্থার কাছে আত্মসমর্পন করে, তবে অবশ্যই মনুষ্য জগতে শান্তি আর শৃংখলা প্রতিষ্ঠা হতে বাধ্য। আমরা ইসলামের প্রতিটি ইবাদাতের দিকে গভীর মনযোগ নিবিষ্ট করলে বুঝতে পারি যে, মানুষের বিবেককে শক্তিশালী ও জাগ্রত করে অন্যান্য জগতের ন্যায় পরিপূর্ণ মুসলিম হিসাবে গড়ে তোলার জন্য মহান আল্লাহ এক কার্যকরী কর্মসূচী প্রনয়ন করে দিয়েছেন। আর এ কর্মসূচী বাস্তবায়নের পিছনে আল-কুরআন ষবধফরহম বা নের্তৃত্ব দিয়ে যাচ্ছে। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন“ আলিফ-লাম-রা। ইহা একখানি কিতাব যা তোমার প্রতি অবতীর্ণ করা হয়েছে। যাতে তুমি লোকদেরকে তাদের রবের অনুমতিক্রমে জমাট বাঁধা অন্ধকারসমুহ থেকে সেই আলোর পথে নিয়ে আসতে পার-যে পথটি এমন এক সত্বার যিনি পরাক্রমশালী এবং নিজেই প্রসংশিত।”(সুরা ইব্রাহিম ঃ ১-২) অর্থাৎ মানুষদেরকে টহফবৎ ডড়ৎষফ তথা অন্ধকার জগতের নাগপাশ থেকে মুক্ত করে একটি সুস্থ সমাজের অদিবাসী বানাতে পারে।
প্রকৃতপক্ষে নৈতিকতা এমন একটা শক্তি, এমন একটা গুণ, যার ওপর ভিত্বি করে মানুষ হক ও বাতিল, ভুল ও সঠিক, ন্যায় ও অন্যায়ের মধ্যে পার্থক্য করতে পারে। যে কাজ বা প্রথা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে আরো অসংখ্য ক্ষতির সৃষ্টি করে, যে সকল কাজে আল্লাহ অসন্তুষ্ট হন, সেটিই মানুষের জন্য ক্ষতিকারক। এ ধরনের ক্ষতিকারক কাজ থেকে আত্মরক্ষা করা খুবই জরুরী। আর আত্মরক্ষার জন্য জ্ঞানের প্রয়োজন। জ্ঞানের চাহিদা মিটাবে আল-কুরআন। কারণ আল কুরআন আল্লাহর নাযিল করা। আত্মরক্ষার জন্য আত্মাকে নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে। আত্মাকে নিয়ন্ত্রেণে আনার জন্য দরকার নৈতিক গুণ। এ ধরণের নৈতিকতা সম্পন্ন জাতি-গোষ্ঠী ও সমাজের জন্য আল্লাহ তাঁর আকাশ ও জমিনের সমস্ত সম্পদ উন্মুক্ত করে দেন।