দ্বিভাষিক হতে বাধা কোথায়?

Published: 28 January 2022

বাহার উদ্দিন

আসামে দীর্ঘমেয়াদি একটা গল্প চালু আছে। পূর্ববঙ্গের, বিশেষ করে বৃহত্তর সিলেট, ময়মনসিংহ আর রংপুর থেকে আগত কৃষকদের বন্যা, ঝড়, বন্যপ্রাণী, বিষাক্ত পোকামাকড়ের বিরুদ্ধে লাগাতার লড়াই করে আসামকে কৃষিযোগ্য করে তুলেছে। এদের ত্যাগ অসামান্য। রক্তক্ষরণ তুলনাহীন। ১৯৪১ থেকে ১৯৫০ এদের ভাষান্তর ঘটে, আজও ঘটছে অচেনা প্রেমের হঠাৎ সান্নিধ্যে যেমন হয়, মাঝবয়সে, ঠিক তেমনি স্তম্ভিত, বিভোর হয়ে আছি। তোলপাড় চলছে, ভেতরে-বাইরে। এরকম কুয়াশামগ্ন মুহূর্তে লেখার কথা, হরদম নিজের সঙ্গে আলাপ করা, অশেষ চেষ্টা করেও এ রকম হয়ে উঠছে না। কী এমন ঘটল? তর্কপ্রবণ, তরজামুখর কলকাতায় ফিরে আসার পরেও ঘোর কাটছে না। আসামের ব্রহ্মপুত্রের উত্তরপারের বিস্তৃত জনপদ, সরষে ফুলের ময়দান, বহুজাতির গ্রাম ও শহরবিন্যাস, নতুন ভাষা সন্ধানের প্রশ্নমুখর কসরত এবং মুক্তচিন্তার, হৃদয়ের মুক্তিযুদ্ধের অদৃশ্য লড়াই নিরন্তর তাড়া করছে। তাহলে কি এরকম এক প্রস্তুতিপর্বের সাক্ষী থাকার জন্য তৈরি হচ্ছিল আমার চিন্তা?

বিষয়টি একটু খুলে বলা প্রয়োজন। গুয়াহাটি বিমানবন্দর থেকে বেরিয়েই শীতের সকাল পেরিয়ে উত্তর দিকে, শরাইঘাট ব্রিজের দিকে এগোচ্ছি। ব্রিজ পেরোলেই আমিনগাঁও হয়ে বড়পেটাগামি সোজা রাস্তা। হাজোর পোয়ামক্কার পাশ কেটে গাড়ি ছুটছে। রাস্তার দুপাশে লোকালয় আর দূরে-অদূরে গ্রাম ছাড়া মাঠে হলুদ ফুলের ছাউনি। দুজন যুবক, বাহার-উল ইসলাম ও আরফান আলি আমার সঙ্গী। একজনের আদিবাড়ি পাবনায়। আরেক জনের টাঙ্গাইল। ১৮৭৪ সালের দিকে তাদের পূর্বপুরুষ ব্রহ্ম উপত্যকায় এসেছিলেন, বাপ-ঠাকুরদার জন্মাঞ্চলে আর ফিরে যাননি। আদি পুরুষের ভাষা, আদি পুরুষদের সংস্কৃতি, খাদ্যাভ্যাস, গৃহবিন্যাস অক্ষুণ্ন রেখেও একসময় অসমিয়ায় ভাষান্তরিত হয়ে বংশানুক্রমে কখনো চর এলাকায়, কখনো বনাঞ্চলে বসবাস গড়ে তুললেন। বন্যা, খরা যে কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ, দেশত্যাগী করে দেওয়ার হুমকি তাদের গৃহচ্যুত করতে পারেনি। আত্মপরিচয়ের শিকড় আবার পুরোপুরি গা ঢাকা দেয়নি। দুই যুবক বলছিলেন, আমরা বাঙালি মুসলিম। সেনসাসে অসমিয়া লিখিয়েও রেহাই নেই। একশ্রেণির মানুষ আমাদের কথায় কথায় বাংলাদেশি, মিঞা, চরুয়া, নঅসমিয়া বলে ব্যঙ্গাত্মক সম্বোধনে অভ্যস্ত। আমরাও নাছোড়বান্দা। মাতৃভাষা ত্যাগ করে, বারবার গোষ্ঠীবিদ্বেষের শিকার হয়ে, সংকটের মুহূর্তে অসমিয়া ভাষা, আসামের সাংস্কৃতিকে বরণ করেছি।

আমি চুপচাপ শুনছি। গাড়ি ছুটছে। লোকালয় পেছনে পড়ে থাকছে। গোষ্ঠীবদ্ধ গ্রাম, কোথাও অসমিয়া, কোথাও অসমিয়া মুসলিম, অসমিয়া হিন্দু অসীমের ছাদের তলায় নির্বিরোধে বাস করছে। বড় অংশই কৃষক। হেমন্তে সরষে, শাকসবজি আর বর্ষায় এক ফসলি ধান চাষ এদের প্রধান জীবিকা।

এই এলাকায় এটাই প্রথম সফর নয় আমার। ছাত্রবেলায় একবার এসেছি। ভোটের সময় বার কয়েক। বেঙ্গলি টাইগার্স নামের ভুঁইফোঁড় জঙ্গি সংগঠনের উত্থানকে ঘিরে হত্যাকাণ্ডের খবর করতে আরেকবার। কিন্তু কখনো চোখ খুলে দেখিনি। প্রশ্ন জাগেনি, অসমিয়া এলাকায় সরষেখেতের বিস্তার, অপেক্ষাকৃত উঁচু এলাকায় বাঙালি কৃষকের বসবাস। এবং এদের জমিতেই মৌসুমি শাকসবজির ছড়াছড়ি।

আসামে দীর্ঘমেয়াদি একটা গল্প চালু আছে। পূর্ববঙ্গের, বিশেষ করে বৃহত্তর সিলেট, ময়মনসিংহ আর রংপুর থেকে আগত কৃষকদের বন্যা, ঝড়, বন্যপ্রাণী, বিষাক্ত পোকামাকড়ের বিরুদ্ধে লাগাতার লড়াই করে আসামকে কৃষিযোগ্য করে তুলেছে। এদের ত্যাগ অসামান্য। রক্তক্ষরণ তুলনাহীন। ১৯৪১ থেকে ১৯৫০ এদের ভাষান্তর ঘটে, আজও ঘটছে।

আমি বিষয়টিকে অন্যভাবে দেখছি। এক দেশ, কিংবা এক অঞ্চল আরেক অঞ্চল ছেড়ে, বা কোনো কোনো জনগোষ্ঠীর ভিন্ন কোনো অঞ্চলে যখন বসবাস শুরু হয়, তখন প্রাকৃতিক নিয়মেই মানুষ নতুন পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে নেয়। নবীন অভ্যাসকে অন্তঃস্রোতা নদীর গতিবিধির মতো গ্রহণ ও বরণ করে নেয়। স্থানান্তরিত মানবপ্রকৃতিকে শুনতে হয় না, তোমাকে ভাষান্তরিত হতেই হবে। মানুষ নিজের তাগিদেই পরভাষাকে, পরবাসকে আপন করে নেয়। এই উপমহাদেশে, বাঙালি আত্মবিসর্জন দিয়ে একবার নিজভাষা, আরেকবার যে-ভাষা তার নিজের নয়, দুটিকেই রক্ষা করেছে। প্রায় একই সময়ে। ’৫২ সালে, বাংলাদেশে। দেশভাগের পর থেকে, ৫০-এর দশক জুড়ে আসামের ব্রহ্মপুত্রের দুপাড় জোড়া বিস্তীর্ণ এলাকা। কৃষিজীবী বাঙালির রাজনৈতিক নেতৃত্ব, বিপন্ন অসমিয়া ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলের প্রধান ভাষার পাশে দাঁড়িয়েছে। লক্ষ লক্ষ কৃষক তাদের আহ্বানে সাড়া দিয়ে, অসমিয়ায় ভাষান্তরিত হয়ে অসমিয়া জনগোষ্ঠীর ‘ম্যাজিকাল গ্রোথকে’ প্রতিষ্ঠিত করেছেন। লামডিং থেকে মধ্য আসামের কামরূপ, ভাটি অঞ্চলের নলবাড়ী, রঙ্গিয়া, বরপেটা, কলগাছিয়া, স্বরভোগ থেকে ধুবড়ি পর্যন্ত সমতলের বাঙালি কৃষকের আত্মবিসর্জনে বৃহত্তর অসমিয়া জাতিগঠন প্রক্রিয়া রীতিমতো ধনী হয়েছে। শাখাপ্রশাখাও ছড়িয়েছে। ১২২ থেকে ১২৩ বছর আগে, নিজের দেশেরই আরেক অঞ্চলে পেটের ভাত জোগাড় করতে, অন্যদের জোগান দিতে তারা আসামে এসেছিলেন। অসমিয়া ভাষা ও সংস্কৃতিকে—মানসিক প্রতিক্রিয়া যা-ই হোক না কেন, মাতৃপ্রেমে গ্রহণ করতে দ্বিধা করেননি। তবু স্থানীয় রাজনীতির বৈমাতৃসুলভ আচরণে আজও তারা অবরুদ্ধ। আজও অসমিয়া বৌদ্ধিক সমাজের প্রবহমান দূরত্ব থেকে তাদের রুদ্ধ করে রেখেছে। কথায় কথায় বাংলাদেশি বলে তুচ্ছ সম্বোধন, ঘুসপেটিয়া—অনুপ্রেবশকারী বলে হেয়জ্ঞান আর হয়রানি থেকে মুক্তি নেই। জমি আছে। জমির কাগজপত্র আছে, তবু এরা ‘বিদেশি, বাংলাদেশি’। উদ্বাস্তু নন, চোরাপথে আসামে ঢোকেননি, তবু অনুপ্রবেশকারীর অদৃশ্য দাগ তাদের সঙ্গ ছাড়ছে না।

আশপাশের তৃণভূমি, জলাভূমি, সবজিখেত দেখতে দেখতে ছুটছি। ছুটতে ছুটতে বঙ্গভাষী মুসলিম কৃষকদের, দেশভাগের শিকার দরিদ্র হিন্দুদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া অবরোধ আমাকে অপরাধী বানিয়ে দেয়। সদ্যপরিচিত দুই সঙ্গীর সঙ্গে কখনো কথা বলছি। কখনো ফিসফিস করছি যে, বৃহত্তর অসমিয়া সমাজ আর কতকাল ক্ষমতায় ভাষা, রাজনৈতিক পীড়ন ও বিভ্রান্তির কবলে পড়ে থাকবে? আত্মোপলব্ধির স্পর্শে শস্যশ্যামলা হয়ে উঠবে না অসমিয়া জনজাতির স্রোতধর ঐতিহ্য? যে বিশাল জনপদ আপারও লোয়ার আসাম জুড়ে ছড়িয়ে আছে, যাদের সংখ্যা অন্তত ১ কোটি, মোট জনসমষ্টির প্রায় এক-তৃতীয়াংশ, সজ্ঞানে তাদের অবজ্ঞা করে, জন্মগত অধিকার ছিনিয়ে নিয়ে অসমিয়া, বড়ো-কাছারি, কোচ, আহোম, ডিমাসা, মিরি-মিছিংসহ বহুজাতির আসামে মুক্তচিন্তার, মুক্তসংস্কৃতির, বিমুক্ত কর্মসংস্থান ও বাণিজ্যের বিকাশ কি সম্ভব? সাম্প্রদায়িকতা কিংবা জাতিবিদ্বেষ মানুষকে অন্ধ করে রাখে। রাষ্ট্রের ভুল, বিভাজন-কৌশল এক অংশকে তোষণ, আরেক অংশকে মানসিক জুলুম করে মুষ্টিমেয় ভাগ্যবানের সুবিধাকে সহজলভ্য করে দেয়। দুর্নীতিকেও প্রশ্রয় দেয়। কিন্তু যে বৃহৎ জনতাকে নিয়ে দেশ আর রাষ্ট্র কালের অনন্ত আর ইতিহাসের নির্দেশিত গন্তব্যের পথে হাঁটতে থাকে, সে পথকে আটকে দেয় সংকীর্ণের রাজনীতি। গ্রিসের জাতিরাষ্ট্রের উত্থান ও পতন থেকে এ পর্যন্ত নানা দেশে, নানা স্তরে বিকারের সাক্ষী হয়ে আছে মানবসভ্যতা। আসামও এরকম নিয়তির ভাগ্যহত শিকার। আসামের বাঙালি মুসলিম কৃষকদের বিড়ম্বিত ভাগ্যের রাজনীতিকে আরোপিত অনুশাসনের বিরুদ্ধে দশকের পর দশক জুড়ে লড়তে হচ্ছে। স্বাধীনতা আর দেশভাগ তাদের একধরনের স্বদেশহীন আখ্যা দিয়েছে। ভাষান্তরিত হয়ে সংঘর্ষ, আঘাত, অপমান থেকে রেহাই দেয়নি। আঘাতের ভার যত বাড়ছে, এসব বহুমাত্রিক কৃষকের জেদ আর সংকল্প সংশয়হীন বিস্তৃতির পথে হাঁটছে। এরকমই এক বিস্ময়কর সমারোহে যোগ দিতে, আমি ব্রহ্মপুত্রের উত্তর পাড়ে কলগাছিয়া বইমেলার দিকে ছুটছি। পরদিন এখানেই দেখতে পাব জনস্রোত হয়ে উঠছে। এখানেই কয়েক শত প্রাণচঞ্চল, অভিজ্ঞতাঋদ্ধ এবং সব শ্রেণির উদ্যোগে আয়োজিত গ্রন্থমেলার শেষ অনুষ্ঠানে, কালিক বার্তাবাহকের মতো বাগ্মী ভারতীয় সাংসদ আব্দুল খালেক বলবেন, তোমরা পড়ো। পড়ো। পড়তে পড়তে আত্মশক্তির বিকাশ ঘটাও। মানসিক স্বাধীনতা আর স্বাভিমানকে প্রশস্ত করো। সামনে হাজার হাজার জনতা। স্তব্ধ। মন্ত্রমুগ্ধ। যারা দ্বিভাষিক। বাড়িতে জারিত অভ্যাসে বাঙালি। বাইরে পঠন-পাঠনে, দৈনন্দিন যোগাযোগে ভাষান্তরিত অসমিয়া। দ্বিভাষিক হতে, হয়ে উঠতে যাদের দ্বিধা নেই। ভাষিক অপমান, ‘বাংলাদেশি’ বলে অসংগত, তির্যক অপবাদ সহ্য করেই যারা বৃহত্তর অসমিয়া জাতিগঠন প্রক্রিয়ার প্রশ্নহীন শরিক অঙ্গীকারবদ্ধ। তুখোড় সাংসদ, কৃষক সমাজের যুক্তিনিষ্ঠ সন্তান সাংসদ আব্দুল খালেকের স্বতঃস্ফূর্ত, সুচিন্তিত ভাষণ শুনতে শুনতে আমারও প্রশ্ন জাগবে, ব্রিটেনে, অস্ট্রেলিয়ায় আমরা বাড়িতে, স্বজনবৃত্তে মাতৃভাষায় কথা বলি—আর বাইরে যে দেশে থাকি, সে দেশের ভাষা—তাহলে অসমিয়া ও বাংলা শব্দ, বাক্যগঠন, শব্দধ্বনি, খাদ্যাভ্যাস ও পোশাক-আশাকের এতো নৈকট্য সত্ত্বেও এখানকার বাঙালির দ্বিভাষিক হতে বাধা কোথায়? কৃষিজীবীরা যেখানে স্বচ্ছন্দ ও সক্ষম, সেখানে অহমিকায় রুদ্ধ কেন মধ্যবিত্তের মন ও মনন? দ্বিতীয়ত, যারা স্বেচ্ছায় ভাষান্তরিত হয়ে পরভাষাকেও মাতৃভাষার মান্যতা দিয়েছেন, তাদের জন্য অবাধ প্রেমের উষ্ণতার এত অভাব কেন? কেন অনুপ্রবেশের অভিযোগ তুলে উদ্দাম বুট গুলিবিদ্ধ মৃতের বুকে নাচবে?

লেখক: ভারতীয় সাংবাদিক, সম্পাদক, আরম্ভ পত্রিকা।