ফেব্রুয়ারি শোকের মাস নয়

Published: 21 February 2022

।। ড. শফিক আশরাফ ।।


আমরা অনেকেই ফেব্রুয়ারিকে শোকের মাস বলে অভিহিত করতে চাই কিংবা একুশে ফেব্রুয়ারিতে শহীদ মিনারমুখী পদযাত্রাকে শোকযাত্রা বলে ভাবতে পছন্দ করি। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনকেন্দ্রিক ঘটনায় রফিক, শফিক, জব্বারের রক্তের ওপর দাঁড়িয়ে সেই সময়ে শোক ও বিষাদকে এই সময়ে একাকার করে দেখাটা সঠিক দৃষ্টিভঙ্গি নয়। তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকরা তাদের সামান্যসংখ্যক মানুষের মুখের ভাষা উর্দুকে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ওপর চাপিয়ে দেওয়ার যে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, সেটা ছিল তাদের রাজনৈতিক কৌশল মাত্র। তারা এই কৌশলের মাধ্যমে এটা প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিল আমার-তোমাদের শাসক এবং প্রভু, কাজেই আমরা যেভাবে চাইব সেভাবেই তোমাদের শিক্ষা, সংস্কৃতি, ভাষা, ধর্ম পালন করতে হবে।

তাদের বিশ্বাস ছিল, বাংলা হলো ভারতঘেঁষা হিন্দুয়ানি ভাষা, আর উর্দু হলো আরবিঘেঁষা অভিজাত ভাষা। এখানে মনে রাখার বিষয় হলো, এ ধরনের ভাষা বিতর্ক পাকিস্তানিরা রাতারাতি কিন্তু আরোপিত করেনি, এই চর্চাটা আমাদের মাঝে বহুদিন থেকেই বিদ্যমান। সেই মধ্যযুগে সুলতানি আমলে যখন আমাদের রাজভাষা ফারসি তখন অভিজাত মুসলমান শ্রেণি মনে করত বাংলা নিচুজাতের ভাষা। আবার একইভাবে হিন্দু ব্রাহ্মণ শ্রেণির যারা সংস্কৃত চর্চা করত তারাও সংস্কৃতকে নিজেদের অভিজাত শ্রেণির ভাষা মনে করত, আর সাধারণ মানুষের মুখের প্রাকৃত ভাষাকে অস্পৃশ্য মনে করত।
সাতচল্লিশের বিভাজনে মুসলমানদের জন্য আলাদা দেশ গঠনের পরে তারা মনে করল তাদের তথাকথিত অভিজাত ভাষা পূর্ববঙ্গের প্রাকৃতজনের ওপর চাপিয়ে দিয়ে ক্ষমতার প্রাথমিক পরীক্ষা করবে। এখানে মনে রাখা দরকার, ভারতবর্ষের মানুষের ধর্ম বা ধর্মসংক্রান্ত শব্দগুলো কিন্তু আরবি নয়, ফারসি। যেমন—নামাজ, রোজা, বেহেশত, দোজখ আমরা ইত্যাদি ধর্মীয় শব্দ ব্যবহারে অভ্যস্ত। আরবি সালাত, সিয়াম, জান্নাত, জাহান্নাম আমাদের মুখে সহজে আসে না। এর কারণ হলো প্রায় ২০০ বছরে মোগলদের মাধ্যমে ধর্ম ও ধর্মসংশ্লিষ্ট ভাষা ও শব্দগুলো বিকাশ ও প্রচার লাভ করেছে। ফারসির মাধ্যমে অনেক হিন্দি শব্দও তৎকালীন অভিজাত মুসলমানরা গ্রহণ করেছেন, যেমন—‘পানি’ একটা হিন্দি শব্দ আর ‘জল’ তৎসম বা সংস্কৃত শব্দ। বাঙালি মুসলমানরা পানিতে অভ্যস্ত, জলে নয়। সুতরাং তাদের দ্বন্দ্বটা ছিল মূলত সংস্কৃতের সঙ্গে, আর বাংলা যেহেতু সংস্কৃতবহুল ভাষা, কাজেই ভাষা নিয়ে যে রাজনীতি সেখানে ধর্মের প্রবেশ করানো ছিল পাকিস্তানিদের একটা কৌশল মাত্র।

ভাষা আন্দোলন কোনো রাজনৈতিক আন্দোলন ছিল না, এটা ছিল মূলত একটা সাংস্কৃতিক আন্দোলন। মূলত সাংস্কৃতিককর্মীরা তাঁদের সৃজনশীলতা দিয়ে এই আন্দোলন চাঙ্গা করে তুলেছিলেন। নাট্যকর্মীরা নাটক লিখে, অভিনয় করে, কবি-সাহিত্যিকরা কবিতা-গল্প-উপন্যাস লিখে, চিত্রশিল্পীরা ছবি এঁকে আন্দোলনে অংশ নিয়েছিলেন। তাঁরা দেখিয়ে দিয়েছেন অসির চেয়ে মসি কতটা শক্তিশালী হয়ে উঠতে পারে।

বিগত হাজার বছরের ইতিহাসে এই ভাষা আন্দোলনই ছিল একমাত্র আন্দোলন, যেটার মাধ্যমে বাঙালি তার আত্মপরিচয়কে সগৌরবে তুলে ধরতে পেরেছিল। বাঙালির ধার্মিক পরিচয়টা নির্দিষ্ট কোনো জুতসই আকার লাভ করতে পারেনি। পূর্ববঙ্গের মুসলমানদের একটা অংশ নিজেদের ধর্ম পরিচয়কে গৌরবের সঙ্গে প্রচার করতে চাইলেও আরবীয় মুসলমানদের দৃষ্টিতে সেই ধর্ম পরিচয় খুব একটা পরিপূর্ণতা পায়নি। আর ভাষিক পরিচয়ই যেহেতু তার জাতির পরিচয় বহন করে, সেটা তারা কোনো দিনই ঠিকমতো প্রচার করতে পারেনি। এর মধ্যে দ্বিজাতিতত্ত্বের বিষফোড়া যখন বাঙালির ঘাড়ে জোয়ালের মতো আঁকড়ে ধরল আর সেই সুযোগে বাঙালির জাতির পরিচয় নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার অভিসংকল্পে পাকিস্তানি শাসকরা ভাষার ওপর হাত দিল, শুধু তখনই বাঙালি বুঝতে পারল তার পরিচয়ের শেষ চিহ্নটুকুও নিশ্চিহ্ন হতে চলেছে, তাদের আত্মপরিচয় হুমকির মুখে, ফলে তারা রুখে দাঁড়াল। পাকিস্তানিরা হয়তো কল্পনাও করেনি বাঙালি এতটা একরোখা ও জেদি হয়ে উঠবে ভাষার দাবিতে। পাকিস্তানি শাসকদের অপরিণামদর্শিতায় নিদর্শন হলো জোরজবরদস্তি পন্থা বেছে নেওয়া। একুশে ফেব্রুয়ারি ছিল তাদের সেই জোরজবরদস্তিতার প্রমাণচিহ্ন। তারা হয়তো বুঝতেও পারেনি একুশে জনতার মিছিলে গুলি আসলে ছিল এ দেশ থেকে তাদের বিদায়ের স্বাক্ষরপত্র। সেদিনে এ রকম অভূতপূর্ব গণজাগরণ, আত্মসংকটে এ রকম ঐক্য আর কখনো বাঙালির জীবনে ঘটেনি। এই জাগরিত জনগণকে স্বাধীনতা পর্যন্ত একটা পতাকাতলে ধরে রাখার মতো নেতৃত্বগুণ নিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মতো নেতার আবির্ভাব ঘটেছিল। আর এই আন্দোলনে বাঙালি যে তার আত্মপরিচয়ের কথাটা অনেক জোর গলায় বলতে পেরেছিল সেটা ছিল ধর্মের ভিত্তিতে দেশ বিভাজন নীতির ওপর প্রচণ্ড একটা থাপ্পর।

ফেব্রুয়ারি শোকের মাস নয়, গৌরবের মাস, বাঙালির আত্মপরিচয় সগৌরবে দৃপ্তকণ্ঠে ঘোষণা করার মাস। পৃথিবীতে নানা দাবিতে পৃথিবীর অসংখ্য মানুষ প্রাণ দিয়েছেন, তাঁদের সেই প্রাণ বিসর্জন কখনো সাফল্য এনেছে, আবার কখনো সেটা ব্যর্থ হয়। কিন্তু ভাষার দাবিতে প্রাণ বিসর্জন পৃথিবীর বিরলতম ঘটনার একটা। কাজেই রফিক, শফিক, জব্বারসহ আরো নাম না জানা যাঁরা এই অসাধারণ ঘটনা ঘটিয়ে পৃথিবীর বুকে নতুন ইতিহাস সৃষ্টি করলেন, তাঁদের জন্য কেন শোক প্রকাশ করব, বরং তাঁদের জন্য গৌরবে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোই তাঁদের প্রতি সম্মান জানানোর শ্রেষ্ঠ পন্থা, কারণ শুধু ভাষাই নয়, তাঁরা চিৎকার করে বলে গেছেন আমরা বাঙালি আর এটাই আমাদের প্রধানতম পরিচয়, পৃথিবীর মানুষ আমাদের এই নামেই চিনুক। কাজেই এই সময়ে যখন আবার পাকিস্তানি ভাবধারায় অনুরক্ত কিছু মানুষ বাঙালির আত্মপরিচয়কে মুছে দিয়ে তার অন্য পরিচয়কে বড় করে তুলতে চায়, তখন বেশি বেশি করে ফেব্রুয়ারির তাৎপর্য ও গৌরবগাথা তরুণ প্রজন্মের ভেতর সচেতনভাবে ছড়িয়ে দেওয়ার উদ্যোগ নিতে হবে। এখন ভার্চুয়াল জগেকন্দ্রিক যে উগ্রবাদী গোষ্ঠী পাকিস্তানি ভাবধারায় বেড়ে উঠছে তাদের কাছে ফেব্রুয়ারির জাগরণ ও এই আত্মপরিচয়ের বার্তা ঠিকমতো পৌঁছে দিতে পারলে বাঙালির বিভাজনরেখা ধীরে ধীরে লোপ পাবে।