রাশিয়ার বিরুদ্ধে পশ্চিমা বিশ্বের নিষেধাজ্ঞা কতটা কার্যকর হবে
।।নিরঞ্জন রায়।।

পশ্চিমা বিশ্বের হুমকি-ধমকির কোনো রকম তোয়াক্কা না করে রাশিয়া ইউক্রেনে আক্রমণ করে বসেছে। রাশিয়া যে এক পর্যায়ে এমনটা করবে তা আগে থেকেই আঁচ করা গিয়েছিল। শুধু মহড়া দেওয়ার জন্য বা অহেতুক শক্তি প্রদর্শনের জন্য যে রাশিয়া গত কয়েক মাস ধরে ইউক্রেনের চারপাশে সেনা সমাবেশ ও যুদ্ধ সরঞ্জাম জড়ো করেনি, তা বুঝতে খুব বেশি জ্ঞানগরিমার প্রয়োজন পড়ে না। পশ্চিমা বিশ্ব, বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এটা বুঝতে পারেনি তা-ও বিশ্বাস করার কোনো কারণ নেই।
ইউক্রেনকে পক্ষে নেওয়ার জন্য রাশিয়া যে প্রয়োজনে আক্রমণ করতে দ্বিধা করবে না তা জানা সত্ত্বেও পশ্চিমা বিশ্ব সেভাবে সামরিক শক্তি বৃদ্ধি করে রাশিয়াকে প্রতিহত করার কোনো প্রচেষ্টাই কার্যত করেনি। কারণ আমেরিকা ভালো করেই জানে যে তাতে খুব একটা লাভ হবে না। রাশিয়াপন্থী হওয়ায় আমেরিকা তার নাকের ডগার কিউবাকে শক্ত হয়ে দাঁড়াতে দেয়নি। কয়েক বছর আগে ব্রাজিল রাশিয়ার সঙ্গে হাত মিলিয়ে ব্রিকস (ব্রাজিল, রাশিয়া, ইন্ডিয়া, চীন এবং সাউথ আফ্রিকা) সংস্থায় যোগ দেওয়ায় সেখানকার সরকারই পরিবর্তন হয়ে আমেরিকাপন্থী সরকার গঠিত হয়েছে।
যা আমেরিকা সহ্য করেনি, তা রাশিয়া যে সহ্য করবে না, এটাই স্বাভাবিক। রাশিয়া যে তার ঘরের কোনার কোনো দেশে আমেরিকা বা ন্যাটোর আস্থাভাজন সরকার মেনে নেবে না তা আমেরিকাসহ পশ্চিমা বিশ্বের ভালোই জানা থাকার কথা। এ কারণেই কোনো রকম শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে রাশিয়াকে ইউক্রেন আক্রমণ থেকে বিরত রাখার চেষ্টা না করে আমেরিকা শুধু হুমকি-ধমকির মধ্যেই সীমাবদ্ধ রেখেছে। কখনো হুমকি দিয়ে বলেছে, ইউক্রেন আক্রমণ করলে রশিয়াকে চড়া মূল্য দিতে হবে, কখনো বলেছে রাশিয়াকে কোনো রকম ছাড় দেওয়া হবে না ইত্যাদি। বাস্তবে রাশিয়া যখন আক্রমণ করেই বসল তখন পশ্চিমা বিশ্ব তাদের একমাত্র অস্ত্র অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা ছাড়া আর তেমন কোনো কার্যকর পদক্ষেপ এখন পর্যন্ত নিতে পারেনি।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এই অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আদৌ কার্যকর হবে কি না এবং হলে কতটা কার্যকর হবে? এই প্রশ্নের উত্তর জানতে হলে আমাদের ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে থাকা ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। পশ্চিমা বিশ্বের অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ মোটেও নতুন কোনো পদক্ষেপ নয়। এর আগে অনেক দেশের ওপরই এই নিষেধাজ্ঞার খড়্গ আরোপ করা হয়েছে। কিন্তু তাতে কি তেমন লাভ হয়েছে? অবস্থাদৃষ্টে তা মনে হয় না। কয়েক যুগ ধরে উত্তর কোরিয়ার ওপর সবচেয়ে কঠোর এবং ভয়ংকর এক অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা আছে। কিন্তু তাতে উত্তর কোরিয়াকে মিসাইল পরীক্ষা থেকে কোনো রকম বিরত রাখা যায়নি। কিউবা, ইরানসহ আরো বেশ কয়েকটি দেশের ওপর আছে কঠোর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা। এসব নিষেধাজ্ঞার কারণে সেসব দেশের সাময়িক কিছু অসুবিধা হচ্ছে ঠিকই, কিন্তু সার্বিক অর্থে সব কিছুই চলছে স্বাভাবিকভাবেই। এমনকি ২০১৪ সালে রাশিয়া যখন ক্রিমিয়া তাদের দখলে নেয়, তখনো আমেরিকাসহ পশ্চিমা বিশ্বের অনেক দেশই রাশিয়ার ওপর আংশিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে রেখেছে। অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞায় যদি তেমন কোনো কাজ হতো, তাহলে রাশিয়া আরো বড় ধরনের নিষেধাজ্ঞার ভয়ে ইউক্রেন আক্রমণ করার ঝুঁকি নিত না।
আসলে পশ্চিমা বিশ্বের অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা এখন আর সেভাবে কাজ করে না। এই নিষেধাজ্ঞা কাজ না করার পেছনে অনেক কারণের মধ্যে একটি বড় কারণ নিষেধাজ্ঞা এড়িয়েও অর্থনৈতিক লেনদেন চালিয়ে যাওয়ার অনেক সুযোগ আছে। তা ছাড়া রয়েছে নিষেধাজ্ঞার প্রয়োগ এবং তদারকি ও কার্যকর বা এনফোর্স করার সীমাবদ্ধতা। নিষেধাজ্ঞা প্রযোজ্য হয় নিষেধাজ্ঞা আরোপকারী দেশের নাগরিক, সেই দেশের উৎপাদিত পণ্যসামগ্রী এবং মুদ্রার ওপর। কানাডার নিষেধাজ্ঞা প্রযোজ্য হবে কানাডার নাগরিকের ওপর, কানাডায় উৎপাদিত পণ্যসামগ্রী এবং কানাডীয় মুদ্রায় লেনদেন করার ক্ষেত্রে। ইউকে নিষেধাজ্ঞা প্রযোজ্য হবে ইউকের নাগরিকের ওপর, ইউকে উৎপাদিত পণ্যসামগ্রী এবং ইউকের মুদ্রা পাউন্ড স্টারলিংয়ের মাধ্যমে লেনদেন করার ক্ষেত্রে। একইভাবে আমেরিকার নিষেধাজ্ঞা প্রযোজ্য হবে আমেরিকার নাগরিকের ওপর, আমেরিকায় উৎপাদিত পণ্যসামগ্রী এবং ইউএস ডলারে লেনদেন করার ক্ষেত্রে। আমেরিকার নাগরিকদের জড়িত না করে, আমেরিকা থেকে সরাসরি পণ্য না কিনলে এবং আমেরিকান ডলারে লেনদেন না করলে কোনো রকম নিষেধাজ্ঞা লঙ্ঘনের পর্যায় পড়বে না। আর বর্তমানে বিশ্ববাণিজ্যের পরিধি, বিস্তৃতি এবং বহুমুখীকরণ এমনভাবে ঘটেছে, তাতে যে যেভাবে চাইবে সেভাবেই লেনদেন করতে পারবে।
মূলত আমেরিকা ছাড়া এখন অন্য কোনো দেশের নিষেধাজ্ঞার তেমন কোনো গুরুত্ব নেই বললেই চলে। কেননা সেসব দেশের মুদ্রায়, যেমন—কানাডিয়ান ডলার, ব্রিটিশ পাউন্ড স্টারলিং, ইউরো, অস্ট্রেলিয়ান ডলার, জাপানি ইয়েন এখন আর আন্তর্জাতিক লেনদেন সেভাবে সম্পন্ন হয় না। এ কারণেই আমেরিকার নিষেধাজ্ঞাকেই এখন সবাই সমীহ করে। কারণ আমেরিকার মুদ্রা ইউএস ডলারই এখন বিশ্বে একমাত্র গ্রহণযোগ্য আন্তর্জাতিক মুদ্রা। বিশ্বের আন্তর্জাতিক লেনদেনের বেশির ভাগ সম্পন্ন হয় এই আমেরিকান ডলারে। এ কারণেই আমেরিকান নিষেধাজ্ঞা এখনো কিছুটা কার্যকর। কিন্তু সেই আমেরিকার নিষেধাজ্ঞাও এর কার্যকারিতা হারাতে বসেছে এই অস্ত্রের যত্রতত্র ব্যবহার বা অপব্যবহারের কারণে।
উল্লেখযোগ্য কোনো কারণ ছাড়াই বাংলাদেশের র্যাবের কয়েকজন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে আমেরিকার নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। আবার একটি জাতিগোষ্ঠীকে নির্যাতন করে নিজ দেশ থেকে বিতাড়িত করার অভিযোগে মিয়ানমারের মিলিটারি অফিসারের ওপর এই একই নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। একই নিষেধাজ্ঞা এখন আরোপ করা হয়েছে রাশিয়ার ওপর, একটি স্বাধীন দেশ আক্রমণ করার অভিযোগে। এই যদি আমেরিকার নিষেধাজ্ঞা আরোপের ধরন হয়, তাহলে সেই নিষেধাজ্ঞা কাজ করবে এমনটা আশা করা যায় না। যখন বিশ্বে কোনো অননুমোদিত মুদ্রার প্রচলন ছিল না এবং একমাত্র অনুমোদিত মুদ্রায় লেনদেন করার সুযোগ ছিল তখনই নিষেধাজ্ঞা সেভাবে কাজ করেনি। এখন ক্রিপ্টোকারেন্সির মতো সহজলভ্য অননুমোদিত মুদ্রার ব্যাপক ব্যবহারের করণে নিষেধাজ্ঞা যে মোটেই কাজ করে না, তা তো এরই মধ্যে প্রমাণিত।
নিষেধাজ্ঞা আরোপের ক্ষেত্রে আরো একটি বড় সমস্যা হলো, যে দেশের ওপর এই নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয় সেই দেশকে নিষেধাজ্ঞা ভঙ্গের দায়ে দায়ীও করা যায় না। কোনো রকম শাস্তিও দেওয়া যায় না। পক্ষান্তরে অনেক নিরীহ প্রতিষ্ঠান বা সংস্থা এই নিষেধাজ্ঞা ভঙ্গের দায়ে অভিযুক্ত হয় এবং কঠোর শাস্তিও ভোগ করে থাকে। অতীতের অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, এই অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞার সবচেয়ে বড় ভুক্তভোগী হয়েছে ইউরোপ আমেরিকার বৃহৎ ব্যাংক এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠান। গত ১০ বছরের নিষেধাজ্ঞা আরোপের ফলে নিষেধাজ্ঞায় থাকা দেশগুলো কতটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তা নিশ্চিত করে বলা না গেলেও এই নিষেধাজ্ঞা ভঙ্গের দায়ে যে ইউরোপ আমেরিকার বৃহৎ ব্যাংকগুলো মারাত্মক আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে তা মোটামুটি নিশ্চিত করেই বলা যায়।
এক দশকে এই নিষেধাজ্ঞা এবং কমপ্লায়েন্স ভঙ্গের অভিযোগে ইউরোপ আমেরিকার বেশ কয়েকটি ব্যাংক প্রায় ১০০ বিলিয়ন ডলার জরিমানা গুনেছে। জার্মানির বৃহৎ এবং একসময়ের বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ আর্থিক প্রতিষ্ঠান ডায়েচ ব্যাংক এই বিশাল অঙ্কের জরিমানার অর্থ গুনতে গিয়ে একেবারে মুখ থুবড়ে পড়েছে। তাই রাশিয়ার বিরুদ্ধে এই নতুন করে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞার ফলে আবারও বিশ্বে আর্থিক লেনদেন গতি হারাবে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে কিছুটা স্থবিরতাও নেমে আসবে। কেননা আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো অধিকমাত্রায় সতর্কতা অবলম্বন করবে এবং নিষেধাজ্ঞা ভঙ্গের দায়ে বিশাল অঙ্কের জরিমানা গোনার ভয়ে অনেক লেনদেন করতেই চাইবে না। এহেন পরিস্থিতিতে গরিব ও উন্নয়নশীল দেশগুলো এক ধরনের বৈরী পরিবেশের সম্মুখীন হবে। কারণ উন্নত বিশ্বের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান এসব দেশের লেনদেনে রাশিয়ার গন্ধ খোঁজার চেষ্টা করবে।
আমাদের দেশেরও এই নিষেধাজ্ঞার বিষয়টি সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে দেখতে হবে। কেননা রাশিয়ার সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য থাকতেই পারে। তা ছাড়া রাশিয়ার সহযোগিতায় রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুেকন্দ্রের কাজ চলমান। তাই নানা কারণে রাশিয়ার নাগরিকদের অর্থ পরিশোধ করা লাগতেই পারে। যদিও রাশিয়ার বিরুদ্ধে যে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে তা এখনো কমপ্রিহেনসিভ নিষেধাজ্ঞার পর্যায় পড়ে না, বরং সেক্টোরাল নিষেধাজ্ঞা। কিন্তু এগুলোর পার্থক্য এতই জটিল যে তা ভালোভাবে বুঝে সঠিকভাবে লেনদেন করতে না পারলে যেকোনো সময় নিষেধাজ্ঞা ভঙ্গের দায়ে অভিযুক্ত হতে পারে। এ কারণেই অধিক সতর্কতামূলক ব্যবস্থা হিসেবে রাশিয়ার সঙ্গে কোনো রকম লেনদেন করার ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা আরোপকারী দেশের মুদ্রায়, বিশেষ করে ইউএস ডলারে লেনদেন না করে অন্য কোনো মুদ্রায় সম্পন্ন করাই হবে উত্তম পন্থা। মোটকথা রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমণের ফলে আরোপিত অধিকতর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা রাশিয়াকে কতটা কাবু করতে পারবে তা দেখার জন্য আমাদের অনেক দিন অপেক্ষা করতে হবে। তবে এই নিষেধাজ্ঞার ফলে উন্নত দেশসহ সমগ্র বিশ্ব যে ব্যবসা-বাণিজ্য এবং আর্থিক লেনদেনের ক্ষেত্রে মারাত্মক ক্ষতির সম্মুখীন হবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।




