সুইফট থেকে রাশিয়াকে বহিষ্কারের পরিণতি

Published: 4 March 2022

।। নিরঞ্জন রায় ।।

পশ্চিমা বিশ্বের আরোপ করা অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা এখন আর সেভাবে কাজ করে না। বিষয়টি পশ্চিমা বিশ্বও যথার্থই বুঝতে পেরেছে এবং এ কারণেই শুধু অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞার ওপর নির্ভর না করে তড়িঘড়ি রাশিয়ার কিছু ব্যাংককে সুইফট (ঝডওঋঞ—সোসাইটি ফর ওয়ার্ল্ডওয়াইড ইন্টারব্যাংক ফিন্যানশিয়াল টেলিকমিউনিকেশন) থেকে বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। পশ্চিমা বিশ্বের এই পদক্ষেপ আদৌ কাজ করবে কি না, করলে কিভাবে কাজ করবে এবং কতটা কাজ করবে, তা দেখার জন্য আমাদের অপেক্ষা করতে হবে। তবে সুইফট থেকে বহিষ্কারের কারণে রাশিয়া যুদ্ধ বন্ধ করে ফিরে যাবে—এমনটা ভাবার কোনো কারণ নেই।

রাশিয়া, বিশেষ করে পুতিন ভালো করেই জানেন যে এই যুদ্ধে হেরে যাওয়ার অর্থই হচ্ছে রাশিয়ার অস্তিত্বই হারিয়ে যাওয়া। পুতিন দীর্ঘ ২০ বছর চেষ্টা করে রাশিয়ার হারানো গৌরব পুনরুদ্ধারে যতটুকু অগ্রগতি অর্জন করেছেন, তার পুরোটা তো শেষ হয়ে যাবেই, উল্টো রাশিয়া বিশ্বরাজনীতিতে আরো পিছিয়ে যাবে ৫০ বছর। তাই রাশিয়ার মতো বিশ্বের দ্বিতীয় পরাশক্তি যে সর্বশক্তি নিয়োগ করে হলেও এই যুদ্ধে জয়ী হতে চেষ্টা করবে, তা খুব সহজেই অনুমেয়।

রাজনৈতিক পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে হয় রাজনীতি দিয়ে এবং সামরিক আগ্রাসন মোকাবেলা করতে হয় সামরিক শক্তি দিয়ে। কিন্তু পশ্চিমা বিশ্ব এই কাজটি করতে সক্ষম হয়নি। এখন তারা রাশিয়াকে মোকাবেলা করার চেষ্টা করছে অর্থনৈতিক শক্তি দিয়ে। এ যেন সামরিক শক্তি বনাম অর্থনৈতিক শক্তির যুদ্ধ। অর্থনৈতিক শক্তি প্রয়োগের সবচেয়ে বড় অসুবিধা হচ্ছে, যাদের ওপর এই শক্তি প্রয়োগ করা হয়, শুধু যে তারা ক্ষতিগ্রস্ত হয় তেমন নয়। যারা এই শক্তি প্রয়োগ করে, তারাও যথেষ্ট ক্ষতিগ্রস্ত হয়। রাশিয়ার বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা জারি করার সঙ্গে সঙ্গে পশ্চিমা বিশ্বে দ্রব্যমূল্যের ভয়ংকর ঊর্ধ্বগতি লক্ষ করা গেছে। শুধু তেলের মূল্য নয়, প্রতিটি জিনিসের দাম বেড়ে গেছে মাত্রাতিরিক্ত। আগে যে পরিমাণ খাদ্যদ্রব্য কিনতে ১০০ ডলার লাগত, এখন সেই একই পরিমাণ জিনিস কিনতে লাগে ১৪০ ডলার। আমি সম্প্রতি ৯০ ডলার দিয়ে যে গ্রোসারি কিনেছি, তা আগে কিনতে খরচ হতো ৬০ ডলার। পশ্চিমা বিশ্বের একটা সুবিধা হচ্ছে, তারা এসব তোয়াক্কা করে না। আর এসব দেশের অর্থনীতি কিভাবে কাজ করে, তা কারো পক্ষে বুঝে ওঠা সম্ভব নয়। উন্নত বিশ্বের অর্থনীতির এমন এক ব্যবস্থা, যেখানে কোনো কাজ না করেও মিলিয়ন ডলার দিয়ে বাড়ি কেনা যায়, দামি গাড়ির মালিক হওয়া যায় এবং বিলাসবহুল জীবন যাপন করা যায়। আমার পরিচিত অনেকেই আছে, যারা এমনটা করছে। এগুলো নিয়ে এখানে কথা বলারও সুযোগ নেই। এই যে ঢালাওভাবে নিষেধাজ্ঞা আরোপের ফলে দ্রব্যমূল্য অস্বাভাবিক বৃদ্ধি পেয়েছে, তা নিয়ে এখানকার মিডিয়ায় কোনো রকম আলোচনা নেই।

এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে রাশিয়াকে সুইফট থেকে বহিষ্কার করার প্রভাব অবশ্যই পড়বে। তবে এই প্রভাব কি শুধু রাশিয়ার ওপর পড়বে, নাকি অন্যান্য দেশের ওপরও পড়বে—সেটাই দেখার বিষয়। এ রকম শাস্তিমূলক ব্যবস্থা এই প্রথম এবং এর আগে কোনো ব্যাংক বা দেশকে সুইফট থেকে বহিষ্কারের ঘটনা বিশেষ করে রাজনৈতিক কারণে আগে ঘটেছে, এমন কথা শোনা যায়নি। বর্তমান বিশ্বে আর্থিক লেনদেন এতটাই সুইফটনির্ভর যে এই পদ্ধতির সাহায্য ছাড়া ব্যাংক তার লেনদেন দক্ষতার সঙ্গে চালিয়ে নিতে পারবে না। আন্তর্জাতিক লেনদেন বাদ দিলেও দেশের ভেতরে আন্ত ব্যাংক লেনদেন এবং মেসেজ আদান-প্রদানে সুইফটের সাহায্য নেওয়া হয়। সুইফট অরাজনৈতিক এবং সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ আর্থিক মেসেজ আদান-প্রদানকারী একটি প্ল্যাটফর্ম হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এবং এত দিন পর্যন্ত তা অটুট ছিল। এই সুইফটের সদস্যসংখ্যা দুই শর অধিক দেশের ১০ হাজারের বেশি ব্যাংক। এই প্রথম সুইফট তার নিরপেক্ষতা হারাল এবং রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হলো। এর সুদূরপ্রসারী ক্ষতি হবে ভয়ংকর এবং এ জন্য উন্নত বিশ্বকে, বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে খেসারত দিতে হবে। এত দিন সুইফটের কারণে বিশ্বব্যাপী আর্থিক লেনদেনের ক্ষেত্রে যে শৃঙ্খলা বজায় রাখা সম্ভব হয়েছে, তা বিঘ্নিত হবে এবং ভেঙে পড়বে।

আগের টেস্টনির্ভর টেলেক্স ব্যবস্থার পরিবর্তে যখন ব্যাংকিং লেনদেনে সুইফটের আগমন ঘটে, তখন তাদের অনেক বক্তব্যের মধ্যে দুটি প্রধান যুক্তি সবাই সাদরে গ্রহণ করেছিল। আর তা হচ্ছে সুইফটের মাধ্যমে লেনদেনে জাল-জালিয়াতির ঝুঁকি নেই বললেই চলে। আর এই ব্যবস্থা একটি অরাজনৈতিক এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানে সেবা প্রদানে নিয়োজিত সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ প্ল্যাটফর্ম হিসেবে কাজ করবে। যদিও জাল-জালিয়াতির বিষয়ে আগেই প্রশ্ন উঠেছে, যখন হ্যাক করে বাংলাদেশ ব্যাংকসহ বিশ্বের কয়েকটি ব্যাংকের অর্থ আত্মসাতের ঘটনা ঘটে। কিন্তু তাদের নিরপেক্ষ ও অরাজনৈতিক অবস্থান বজায় ছিল ঠিকই এবং এ কারণেই সুইফটের ওপর সবার শতভাগ আস্থা এবং এই ব্যবস্থা এত জনপ্রিয়। সুইফটের ওপর শত্রু-মিত্র সব দেশের প্রতিটি ব্যাংকের আস্থা এতই শক্ত যে একটিমাত্র ব্যবস্থার ওপর নির্ভর করার ঝুঁকি জানা থাকা সত্ত্বেও কখনোই বিকল্প ব্যবস্থার কথা কেউ চিন্তা করেনি, যদিও সুইফটের বিকল্প কয়েকটি প্রযুক্তি এরই মধ্যে আবিষ্কৃতও হয়েছে। বেশ কয়েক বছর আগে রিপলনেট (জরঢ়ঢ়ষবঘবঃ) নামে সুইফটের বিকল্প প্রযুক্তি প্রায় চালু হওয়ার দ্বারপ্রান্তে চলে এসেছিল। এত দিন হয়তো অনুরূপ আরো অনেক প্রযুক্তি তৈরিও হয়ে থাকতে পারে।

রাশিয়াকে সুইফট থেকে বহিষ্কারের কারণে রাশিয়া কতটুকু কাবু হবে, তা হয়তো ভবিষ্যৎ বলবে। তবে একসময় যুদ্ধ থেমে যাবে। সব কিছু স্বাভাবিক হয়ে যাবে। কিন্তু এই সুইফটের রাজনৈতিক ব্যবহার বিশ্বের অনেক দেশের জন্যই এক সতর্কবার্তা হিসেবে থেকে যাবে। আজ যে অস্ত্র রাশিয়ার আগ্রাসনের বিরুদ্ধে ব্যবহৃত হয়েছে, কাল যে অন্য দেশের ওপর ব্যবহৃত হবে না, তার তো কোনো নিশ্চয়তা থাকল না। একবার যেহেতু সুইফটকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা শুরু হয়েছে, তাই ভবিষ্যতেও অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞার মতো এই হাতিয়ার যেকোনো দেশকে শায়েস্তা করার জন্য ব্যবহৃত হবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

অনেকেই ভাবতে পারেন, রাশিয়ার মতো সামরিক আগ্রাসনে জড়িত না হলে এ রকম ব্যবস্থা গৃহীত হওয়ার কোনো আশঙ্কা নেই। অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা প্রয়োগের ক্ষেত্রেও এ রকম যুক্তি দেখানো হয়ে থাকে। কিন্তু বাস্তবে সবাই প্রত্যক্ষ করেছেন অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা কিভাবে রাজনৈতিক কারণে ব্যবহৃত হচ্ছে। ঙঋঅঈ (অফিস অব ফরেইন অ্যাসেট কন্ট্রোল)-এ নিষেধাজ্ঞার যে সংজ্ঞা ও উদ্দেশ্য দেওয়া আছে, তাতে কোনো অবস্থায়ই বাংলাদেশের র‌্যাবের কোনো সদস্য পড়েন না। অথচ রাজনৈতিক চাপ প্রয়োগ করার উদ্দেশ্যেই যুক্তরাষ্ট্র যে এই নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে, তা আর বুঝতে কারো বাকি নেই। এ কারণেই এই সুইফট থেকে বহিষ্কারের হুমকি যে ভবিষ্যতে ভারত বা চীন বা বাংলাদেশ বা অন্য কোনো দেশের বিরুদ্ধে দেওয়া হবে না, তা নিশ্চিত করে বলা যাবে না। পৃথিবীর সব দেশ যুক্তরাষ্ট্রে ডলারে অর্থ জমা রাখে একটিমাত্র কারণে যে সেখানে আইনের শাসন যথেষ্ট শক্ত এবং সব রাজনৈতিক প্রভাবের ঊর্ধ্বে। একইভাবে সুইফট ছিল সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ একটি প্ল্যাটফর্ম। ইউক্রেনের বিরুদ্ধে রাশিয়ার যুদ্ধ মোকাবেলা করতে গিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা বিশ্ব এই ব্যবস্থা দুটি যেভাবে ব্যবহার করেছে, তাতে অনেক দেশই ভবিষ্যতে ইউএস ডলারে অর্থ জমা রাখতে দ্বিতীয়বার চিন্তা করবে এবং সুইফটের ওপর শতভাগ নির্ভর করার ব্যাপারেও হয়তো চিন্তা-ভাবনা করবে।

এই যুদ্ধ থেকে অনেক দেশকেই এখন শিক্ষা গ্রহণ করতে হবে এবং অনেক বিকল্প ব্যবস্থা প্রচলনের উদ্যোগ নিতে হবে। ইউএস ডলারের ওপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে আনার কোনো বিকল্প নেই। আঞ্চলিক বাণিজ্যকে শুধু চালুই নয়, একে জনপ্রিয়ও করে তোলার উদ্যোগ নিতে হবে। একসময় এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়ন বা আকু আমাদের প্রতিবেশী দেশগুলোর মধ্যে লেনদেন নিষ্পত্তিতে খুব ভালো ভূমিকা রেখেছিল। সবাই অতি মাত্রায় ইউএস ডলারে লেনদেনে উৎসাহিত হয়ে যাওয়ার কারণে সেই আকু অকার্যকর হয়ে যায় এবং জানপ্রিয়তা হারায়। এখন সময় এসেছে এ রকম আঞ্চলিক বাণিজ্য সংস্থাগুলোকে অধিক মাত্রায় কার্যকর করে তোলা। সুইফটের বিকল্প পদ্ধতি বা প্রযুক্তির কথা নিশ্চয়ই অনেক দেশ সক্রিয়ভাবে ভাবতে শুরু করবে। এই যুদ্ধের জয়-পরাজয় যেটাই হোক না কেন, রাশিয়ার বিরুদ্ধে সুইফট অস্ত্র ব্যবহারের পরিণতিতে ভবিষ্যতে বিশ্ব মুদ্রাবাজারে যুক্তরাষ্ট্রের একচ্ছত্র আধিপত্য যথেষ্ট খর্ব হলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।

লেখক : সার্টিফায়েড অ্যান্টি মানি লন্ডারিং অ্যাকাউন্ট্যান্ট ও ব্যাংকার, টরন্টো, কানাডা
Nironjankumar_roy@yahoo.com