বাজার নিয়ন্ত্রণে প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বাড়াতে হবে

Published: 18 March 2022

।। ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ ।।

বহির্বিশ্ব ও অভ্যন্তরীণ প্রেক্ষাপটে একটা দেশের সার্বিক সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অবস্থা নিরূপণ করতে হয়। এই মুহূর্তে দেশে ও দেশের বাইরে—সর্বত্র মানুষ কিভাবে জীবন যাপন করছে সেটা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। বিশেষ করে সাধারণ মানুষের জীবনযাপন চ্যালেঞ্জগুলো এখন আলোচনার বিষয়। যুদ্ধসহ নানা কারণে বিশ্বের অর্থনৈতিক অবস্থা এখন মোটেও ইতিবাচক নয়।

কভিড-পরবর্তী ঘুরে দাঁড়ানোর মধ্যেই ইউক্রেন সংকট ও উগ্র জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক অস্থিরতা বৃদ্ধি বৈশ্বিক রাজনৈতিক ব্যবস্থা ওলটপালট করে দিচ্ছে এবং নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে বিশ্ব অর্থনীতিতে। এর ধকল সইতে হচ্ছে সাধারণ মানুষকে।

বৈশ্বিক পরিস্থিতির কারণে তেল-গ্যাসসহ, খাদ্যদ্রব্য ও খাদ্যবহির্ভূত দ্রব্যসামগ্রী ও সেবাসহ প্রায় সব কিছুরই দাম বেড়ে যাচ্ছে। সাধারণত বা অর্থনীতির তত্ত্ব অনুসারে দাম বাড়ে চাহিদার তুলনায় সরবরাহ ঘাটতি হলে। এটাই বৈশ্বিক নিয়ম। সারা বিশ্বেই ব্যবসায়ীরা অর্থনীতি নিয়ন্ত্রণ করেন এবং পরোক্ষভাবে রাজনীতিতেও প্রভাব রাখেন। কিন্তু সেটা আইন-কানুন ও নীতি-নৈতিকতার বাইরে গিয়ে নয়। আমাদের এখানে জিনিসপত্র এবং সেবার দাম বাড়ার পেছনে বৈশ্বিক পরিস্থিতি পরোক্ষভাবে প্রভাব ফেলছে। কিন্তু আমাদের সমস্যা হচ্ছে, বিশ্বের বাজারে দাম বাড়ার প্রভাব আমাদের বাজারে পড়ার আগেই পণ্যমূল্য বৃদ্ধি পায়। মূলত আমাদের দেশে কতগুলো অভ্যন্তরীণ ডায়নামিকস আছে, সেগুলোর কারণেই দ্রব্যমূল্য বেড়ে যায়।

আমাদের দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়গুলো পর্যালোচনা করতে হলে প্রথমত, দেখতে হবে শাসনব্যবস্থা কেমন, দ্বিতীয়ত, দেশের সরকারি ও বেসরকারি উভয় ধরনের প্রতিষ্ঠানগুলোর দক্ষতা ও ইতিবাচক উদ্যমের মাত্রা, তৃতীয়ত, মানুষ কিভাবে বিদ্যমান ব্যবস্থার সুবিধা-অসুবিধা সম্পর্কে প্রতিক্রিয়া জানায় এবং চতুর্থত, জানার পর কী রকম প্রতিকারের ব্যবস্থা নেওয়া হয়। এই প্রেক্ষাপটেই আমাদের বাজার নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থাটাকে মূল্যায়ন করা যেতে পারে। আমাদের মনে রাখতে হবে, সরকারের নীতি প্রণয়নের প্রক্রিয়া এবং বাস্তবায়ন, বাজার তথা ভোক্তা ও সরবরাহকারীর আচরণ এবং বেসরকারি খাতের ভূমিকা—এই তিনটি অংশ একটা দেশের অর্থনীতিতে প্রভাব বিস্তার করে।

গত ৫০ বছরে বাংলাদেশের যে অর্জন তাকে মোটাদাগে ভৌত অবকাঠামোর উন্নয়ন প্রবৃদ্ধি ও মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি এবং সামাজিক সূচকগুলোর উন্নতিকে বোঝানো হয়। এগুলো নিঃসন্দেহে ভালো বিষয়। কিন্তু এই উন্নয়ন অনাদিকাল চলতে থাকবে, কিন্তু এর ফলটা লোকজন পাচ্ছে কি না সেটা গুরুত্ব পাবে না, তা হতে পারে না। ফল পেতে কয়েক প্রজন্ম চলে যাবে, সেটাও গ্রহণযোগ্য নয়। যেকোনো উন্নয়নের ফল বর্তমান প্রজন্মকেও ভোগ করতে হবে। যুক্তি দেওয়া হবে যে এর ফল ভবিষ্যৎ প্রজন্ম পাবে, এটা কোনো কথা হতে পারে না। নীতিনির্ধারক ও ব্যবসায়ীদের ভাবতে হবে, এখন যা করা হচ্ছে বর্তমান প্রজন্মের জন্যও দরকার। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের সুরক্ষা আমাদের অবশ্য কর্তব্য। তার আগে বর্তমানের সঙ্গে ভবিষ্যতের বন্ধনকে সুদৃঢ় করতে হবে। শুধুই ভবিষ্যতে সব হবে, সেটা কোনো কাজের কথা নয়। এমনও হতে পারে যে পরে দেখা যাবে, ভবিষ্যতের লোকজনকেও এই একই কথা বলা হবে যে তোমাদের আরো অপেক্ষা করতে হবে।

মানুষের অর্থকষ্ট বেড়ে গেলে উন্নয়নের প্রশ্নটা সামনে এসে যায় এবং সেটাই স্বাভাবিক। আমাদের জীবন মান যথেষ্ট পরিমাণে উন্নতি হয়েছে সেটা বলা যাবে না। এর বড় কারণ কোনোভাবেই আয় ও সম্পদের বৈষম্য কমছে না। দ্বিতীয়ত, বৈষম্যটা প্রতিফলিত হয় মানুষের ক্রয়ক্ষমতা ও চাহিদ পূরণের ব্যবস্থা দেখে। এখন করোনা কিছুটা কমে আসায় অর্থনীতি আস্তে আস্তে মুক্ত হচ্ছে, ঘুরে দাঁড়াচ্ছে। মানুষের চাহিদাও বৃদ্ধি পেয়েছে। এখন যদি যুক্তি দিই যে চাহিদা ও মানুষের সক্ষমতা বেড়েছে বলেই মূল্যস্ফীতি বেড়েছে, সেটা হবে দুঃখজনক। দেখতে হবে মানুষ তার চাহিদা কিভাবে পূরণ করছে, বাড়তি আয় থেকে নাকি সঞ্চয় ভেঙে বা ধারদেনা করে। মূলত আমাদের মানুষের চাহিদা পূরণ করার জন্য সুষ্ঠু ব্যবস্থা দেশে নেই; সরবরাহ চেইনের দুর্বলতা ও মধ্যস্বত্বভোগীদের প্রভাব; বাজারের প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশের অভাব; বাজারের নিয়ন্ত্রণের অভাবের কারণেই চাহিদার কথা বলে দাম বাড়ানো হচ্ছে। এখানে পাইকার থেকে খুচরা বিক্রেতা পর্যন্ত সবাই গোষ্ঠীবদ্ধ হয়ে বাজার ম্যানিপুলেট করেন।

এখন ধমক দিয়ে দ্রব্যমূল্য কমাবে বলে যেসব কথা বলা হচ্ছে, তাতে সমস্যার স্থায়ী সমাধান হবে না। কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে। ধমকে কিছু কাজ হলেও সেটাও নিতান্ত সাময়িক। এখানে সবচেয়ে জরুরি হচ্ছে, যে চাহিদা আছে সেটা অযৌক্তিক বা বাড়তি চাহিদা নয়—সেটা মেনে নিতে হবে। সেটা মেনে নিয়ে চাহিদা মেটাতে সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে। শাক-সবজি বা পচনশীন দ্রব্যের উৎপাদনকারীরা যথেষ্ট মূল্য পান না—এটা দীর্ঘদিনের সমস্যা এ দেশে। আমাদের ভাবতে হবে পাঁচ টাকার বেগুন ঢাকায় এসে ৪০ টাকা হবে কেন? ছয় টাকার করলা ঢাকায় ১০০ টাকায় বিক্রি হয় কেন? ঘাটে ঘাটে চাঁদাবাজি, নানা রকম ম্যানিপুলেশনের কারণেই এটা হচ্ছে। একদিকে কৃষক ন্যায্য মূল্য পান না, আবার ক্রেতা বা ভোক্তারাও সুবিধা পান না। মাঝখানে মধ্যস্বত্বভোগী ক্ষমতা ও রাজনৈতিক বলয়ের মধ্য থেকে সুবিধা নিচ্ছে।

এই অবস্থা আমাদের উন্নয়নের প্রতিফলন নয়। উন্নয়ন বলতে শুধু কতগুলো সামষ্টিক সূচক নয়। মাথাপিছু আয়, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ, রপ্তানি আয়, রেমিট্যান্স আয়—শুধু এসব দিয়ে উন্নয়নকে নিরূপিত করা ভুল হবে। উন্নয়নের সামষ্টিক ফল দেখতে হয় জীবনযাপনের পর্যায়ে। কিন্তু এটা না করে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির যৌক্তিকতা দেখাতে এসব সূচক সামনে আনা হয় অজুহাত হিসেবে। এখন রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণও দেখানো হচ্ছে। কিন্তু যুদ্ধ শুরু হয়েছে মাত্র কয়েক দিন আগে। এর আগে থেকেই দেশে পেঁয়াজ, চাল ও ডাল ছিল। গমের সংগ্রহ মোটামুটি ভালো ছিল। ফলে চট করে এসব পণ্যের দাম বেড়ে যাওয়া গ্রহণযোগ্য নয়। প্রকৃতপক্ষে নিয়ন্ত্রণ, নজরদারি, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির অভাব এবং অপরাধীদের শাস্তি দিতে না পারার কারণেই বাজারে অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি, পণ্যের গুদামজাত, পণ্যে ভেজাল দেওয়া এগুলো ঘটে থাকে।

মাঝেমধ্যে আমরা দেখি বাজারে মোবাইল কোর্ট যায় হঠাৎ করে। এগুলো খুবই সাময়িক। আমি বলব আপনি একজন দোকানদারকে টাকা ফাইন করলেন, তাতে ক্ষতি কী? দোকানদার কয়েক দিনেই এই টাকার ব্যবস্থা করে নেবে। অথবা দোকানদারদের সমিতি আছে, সবাই মিলে তাকে জরিমানার টাকাটা দিয়ে দেবে। তবে কাজ হতো, যদি ম্যানিপুলেটের প্রমাণ পেয়ে কিছু দোকান, প্রয়োজনবোধে কিছু মার্কেট সম্পূর্ণ বন্ধ করে দেওয়া যেত এবং তাদের পণ্য নিলামে কিংবা টিসিবির মাধ্যমে বিক্রি করে দেওয়া যেত। এ রকম কড়া অবস্থানে না গেলে কাজ হবে না। একইভাবে যাঁরা আমদানি করছেন, তাঁদের আমদানি ব্যয় ও বিক্রয় মূল্যের ব্যবধান দেখতে হবে। যেমন ভোজ্য তেলের দাম আন্তর্জাতিক বাজারে এক ডলার বা ৮৫ টাকা বাড়লে বাংলাদেশে সেটা ৩০০ বা ৪০০ টাকা বেড়ে যাওয়া মেনে নেওয়া যায় না।

আরেকটা বিষয় হলো যে মূল্যস্ফীতি সম্পর্কে সরকারি তথ্য নিয়ে বিতর্ক সরকারের উপকারের চেয়ে ক্ষতিই বেশি। কারণ যে ভুল তথ্যের ওপর নির্ভর করে সিদ্ধান্ত নেবে সরকার, সেটা কোনোভাবেই মঙ্গলজনক হবে না। বলা হলো মূল্যস্ফীতি ৫.৮। কিন্তু এর কোনো বাস্তবতা নেই। পরিসংখ্যান ব্যুরোর লোকজন কী জানে ঢাকায় করলার দাম ১০০ টাকা? দিনাজপুরে ১০ টাকা দামের করলা হিসাব করলে কি সঠিক চিত্র পাওয়া যাবে? অথচ অনেক গবেষণা প্রতিষ্ঠান বলছে মূল্যস্ফীতি ১২ শতাংশ। অনেকে তার চেয়েও বেশি বলছে। সরকারকে বাজারের সঠিক তথ্য সংগ্রহ করে সেগুলোর মূল্যায়ন করে স্বচ্ছতার সঙ্গে প্রকাশ করতে হবে।

জনগণের ক্রয়ক্ষমতা ও চাহিদা বেড়েছে বলে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে—এই ধরনের মন্তব্য প্রকৃত পরিস্থিতিকে আড়াল করার জন্য করা হয়। তাতে সমস্যার সমাধান হয় না। বিষয়টি অর্থনৈতিকভাবে দেখতে হবে। মূলত সরবরাহজনিত সমস্যাই আমাদের দেশে মূল্যবৃদ্ধির কারণ। আমাদের বাজার প্রতিযোগিতামূলক নয় এবং সরবরাহ চেইন একেবারেই দুর্বল। আমাদের দুর্বলতা হচ্ছে ম্যানিপুলেশন ঠেকাতে না পারা, দায়ী ব্যক্তিদের শাস্তি দিতে না পারা। এই দুর্বলতা কাটিয়ে ওঠার ব্যাপারে মনোযোগ দিতে হবে। এ জন্য প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বাড়াতে হবে।

লেখক : সাবেক গভর্নর, বাংলাদেশ ব্যাংক ও অধ্যাপক, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়