বঙ্গবন্ধু ও আমাদের স্বাধীনতা

Published: 26 March 2022

।।ড. প্রভাষ কুমার কর্মকার।।

২৬শে মার্চ আমাদের মহান স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা ঘোষণার মধ্য দিয়ে বাঙালির অন্তরের কামনারই যেন প্রতিফলন ঘটেছিল এই ২৬শে মার্চ প্রথম প্রহরে। নিষ্পেষিত-নির্যাতিত-শোষিত মানুষের আহাজারিতে লুকানো সুপ্ত মনোবেদনা এবং মনের গহিনে অধিকারবঞ্চিতের অসহ্য যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেতে তাদের কামনা দীর্ঘায়িত হলেও অবহেলিত বাঙালির কামনা পূরণে শান্তির প্রবেশদ্বার ১৯৭১ সালের আগ পর্যন্ত রচিত হয়নি। হয়তো মনোজগতের কোনো এক অচিন কোণে নীরবে-নিভৃতে তাদের সুপ্ত বাসনার কিঞ্চিত্ ছাপ দেখা দিলেও এই দ্বার খোলার চিন্তা প্রখরভাবে কখনো তাদের কল্পনায় আসেইনি, যে কারণে মুক্তির সন্ধান করা যায়নি।

শক্ত মেরুদণ্ডের কোনো নেতৃত্ব খুঁজে পাওয়া যায়নি!
অবশেষে বাঙালির আস্থা-ভালোবাসা এবং ভরসার আশ্রয়স্থলের সন্ধান মিলল। বিষাদময়তা থেকে মুক্ত করার মানসে এই অঞ্চল জ্যোতির্ময় বঙ্গবন্ধুর পরশে ধন্য হলো, আলোকিত হলো। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শোষিতের জন্য নিবেদিত হয়ে কাজ শুরু করলেন। অসম্ভব আবেদন ও আবেগঘন অনুভূতির বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়ে তিনি বাঙালির জীবনে অহংকারের ভিন্নমাত্রা যুক্ত করলেন।

নিজস্ব অনুভূতির পরশমাখা উজ্জ্বলালোকে পূর্ণ স্পর্শানুভূতিযুক্ত অমিয় আবেদনের এক স্রোতোধারার মাধ্যমে স্বাধীনতার ঘোষণা দিলেন—‘এটাই হয়ত আমার শেষ বার্তা, আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন। বাংলাদেশের জনগণ, তোমরা যে যেখানেই আছ এবং যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে শেষ পর্যন্ত দখলদার সৈন্য বাহিনীকে প্রতিরোধ করার জন্য আমি তোমাদের আহ্বান জানাচ্ছি। পাকিস্তান দখলদার বাহিনীর শেষ সৈনিকটিকে বাংলাদেশের মাটি থেকে বিতাড়িত করে চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত তোমাদের যুদ্ধ চালিয়ে যেতে হবে। ’

বঙ্গবন্ধুর এই ডাকে বাঙালি দলে দলে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ল—নিরস্ত্র নিরীহ বাঙালির ওপর পাকিস্তানি হানাদার ও এ দেশীয় দোসরের নির্মম অত্যাচার আর নির্যাতনে বয়ে গেল নজিরবিহীন রক্তগঙ্গা। আর এ সব কিছুকে তুচ্ছজ্ঞানে বাংলার মানুষ এগিয়ে গিয়েছে স্বাধীনতার প্রাণপুরুষের নেতৃত্বেই। তাঁরই নির্দেশিত পথে বীর বাঙালি বিজয় ছিনিয়ে আনল। ৩০ লাখ শহীদের রক্তে রাঙা বাংলা প্রান্তরের মহাবিজয়ে সম্ভ্রমহারা হতে হয়েছে দুই লাখ মা-বোনকে। দীর্ঘ ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের ফলপ্রাপ্তি ঘটেছে লাল টুকটুকে স্ব্বাধীনতা সূর্যের কিরণের মধ্য দিয়ে। বঙ্গবন্ধুর নিজ জীবনের মায়া ত্যাগ করে শত নির্যাতন সহ্য করে স্বাধীনতার পথে অটল থাকা এবং বাংলার সর্বসাধারণকে একত্রীকরণের দ্বারা তিনিই নির্মল বায়ুর সমারোহপূর্ণ অমৃতভাণ্ডার বাংলাদেশের স্বত্বাধিকারী হিসেবে শোষিত-বঞ্চিত মানুষকে উপহার দিলেন সার্বভৌম এই জাতিরাষ্ট্র। হাজার বছরের বঞ্চনার অবসান ঘটিয়ে বাঙালির জন্য সার্বভৌম বাংলাদেশের ঠিকানা নির্ধারণ, গর্বের লাল-সবুজের জাতীয় পতাকা এবং ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি…’ মনোমুগ্ধকর জাতীয় সংগীতের অংশীজন হওয়ার সুযোগ করে দিলেন দূরদর্শী নেতৃত্ব জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন থেকে ছয় দফা হয়ে ৭ই মার্চের ভাষণ এবং সর্বশেষ একাত্তরের স্বাধীনতার ডাক—তাঁর চরম ত্যাগ ও অসম্ভব বুদ্ধিদীপ্ত পদক্ষেপের ফসল এই বাংলাদেশ। সে বিষয় বিশ্লেষণ কিংবা তাঁর চিত্রায়ন এই পরিসরে আজ করতে চাই না। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বের সফলতার অন্তর্নিহিত তাত্পর্য তাঁর নেতৃত্বের ক্যারিসমা। এই ক্যারিসমেটিক নেতার নেতৃত্বের অনন্যসাধারণ বৈশিষ্ট্যের আঙ্গিকগুলো শত ব্যঞ্জনায়ও শেষ করা যাবে না। জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করা, নেতৃত্বের আবেদন সৃষ্টি করার মাধ্যমে সাধারণের মনের মণিকোঠা স্পর্শ করে অবহেলিত-শোষিতের বন্ধু হওয়া তাঁর নেতৃত্বের মূল অলংকার হিসেবেই দেশে-বিদেশে অনুকরণীয় হয়ে চলেছে আজও। সহজ কথায় বলা যায়, সত্য-সুন্দর-কল্যাণের পথে থেকে সাধারণ মানুষের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটিয়ে এই মুক্তির দূত তাদের হূদয়ে স্থান করে নিতে পারতেন অতি অনায়াসেই।

প্রকৃতপক্ষে ১৭৬২ সালে Jean-Jacques Rousseau কর্তৃক ‘সামাজিক চুক্তি’ গ্রন্থে রাষ্ট্র তথা সমাজ গঠনের আদি কারণ হিসেবে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের বিখ্যাত যে ‘General Will’ তত্ত্ব প্রদান করেন, তার বাস্তব প্রয়োগ যেন আরো অনন্যসাধারণভাবে দূরদর্শী নেতা বঙ্গবন্ধু করলেন। বাঙালির বোধিসত্ত্বার চরম প্রকাশ করে বঙ্গবন্ধু সাধারণের মণিকোঠা স্পর্শ করলেন। ইতিহাস তার জ্বলন্ত সাক্ষী হয়ে আছে আজও। তাঁর আকাঙ্ক্ষার সব প্রমাণ গ্রথিত আছে ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে—তাইতো বঙ্গবন্ধু বলছেন, ‘যে কোন মহত্ কাজ করতে হলে ত্যাগ ও সাধনার প্রয়োজন। যারা ত্যাগ করতে প্রস্তুত নয়, তারা জীবনে কোন ভাল কাজ করতে পারে নাই—এ বিশ্বাস আমার ছিল। …এদেশে রাজনীতি করতে হলে ত্যাগের প্রয়োজন আছে। ’ বঙ্গবন্ধু তাঁর মহত্ত্বের গুণে শুধু বাংলাদেশই নয়, সারা বিশ্বের মহান দূরদর্শী নেতৃত্বের আসনে অবস্থান করে নিয়েছেন। স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ বঙ্গবন্ধুর একমাত্র অভিলাষ হওয়ার কারণে বাঙালির যত ভিন্নতা, দীনতা-হীনতা, জড়তা কাটিয়ে তিনি বাঙালিকে অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছানোর শক্তিতে উজ্জীবিত করতে পেরেছিলেন।

বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশের সুবর্ণ জয়ন্তীর বছরে বঙ্গবন্ধুকে হারানোর ব্যথা নিয়েই তাঁর সব ভিন্নতাকে অভিন্নতার সুরে গাঁথার অনবদ্য ইতিহাস লিখতে হচ্ছে। বাঙালির অনেক কষ্টের এই ইতিহাসে এইটুকু সান্ত্বনা যে ষড়যন্ত্রকারীরা যেভাবে বঙ্গবন্ধুর নাম মুছে ফেলতে চেয়েছিল তার হিতে বিপরীত হয়েছে—বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও চেতনা আরো প্রবল হয়েছে তরুণ প্রজন্মের মধ্যে। জাতির পিতার দেখানো পথে তাঁরই গুণে গুণান্বিতা আধুনিক বাংলাদেশের রূপকার জননেত্রী শেখ হাসিনা আজ বাংলাদেশের নেতৃত্বের আসনে। দেশে সব অভিন্নতার কেন্দ্রবিন্দু আবর্তিত হচ্ছে বাঙালির জয়যাত্রার পুরোধা ব্যক্তিত্ব উন্নত বাংলাদেশ বিনির্মাণে কর্ণধার বঙ্গবন্ধুকন্যা দেশরত্ন শেখ হাসিনাকে ঘিরে। দেশের উন্নয়ন অগ্রযাত্রায় যুক্ত হওয়া স্বাধীনতাপূর্ব, স্বাধীনতাকালীন ও স্বাধীনতা-উত্তর এই তিন প্রজন্মের সম্মিলিত অংশগ্রহণে যে মধুুময়তা ও স্বস্তিশ্বাসের বাতাবরণ তৈরি হয়েছে, সেই রেশ যেন উন্নত বাংলাদেশের সফল রূপকার বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও স্বপ্ন বাস্তবায়নকারী মননের সদা জাগ্রত দূরদর্শী ভাবনার অধিকারী বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার ভিশন-মিশনের আলোকে ২০৪১ পর্যন্ত প্রবাহিত হয়—এই প্রত্যাশা আজ সাড়ে ১৬ কোটি বাঙালির।

দেশরত্ন গণতন্ত্রের মানসকন্যার নেতৃত্বে জাতির পিতার আদর্শ ও চেতনালোকে বিকশিত হোক এবং উন্নত রাষ্ট্রগুলোর নিয়ন্ত্রণরথের সারথি হয়ে সব দৈন্যদশাকে পরাভূত করে আলোক জাগরণে এগিয়ে চলুক বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার বাস্তবধর্মী পরিকল্পনালোকে আজ বাংলাদেশের বাঙালিরা উজ্জীবিত হয়েছে—বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের আধুনিক সোনার বাংলা ২০৪১-এ আধুনিক উন্নত বাংলাদেশ হিসেবে পরিগণিত হবেই হবে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ২১০০ সালে ডেল্টা পরিকল্পনা মোতাবেক উন্নত দেশের চালকের আসনে আসীন হয়ে বাংলাদেশের জয়জয়কার নিশ্চিতে কার্যকর ভূমিকা রাখবে বলে আজ প্রত্যেক বাঙালি বিশ্বাস করে। আসুন, আমরা যে যার অবস্থানে থেকে সাধ্যমতো অবদান রাখতে চেষ্টা করি এবং তারুণ্যের শক্তি-সাহসকে সঞ্চারিত করি, একীভূত করি অপ্রতিরোধ্য উন্নয়ন অগ্রযাত্রায় ছুটে চলা বাংলাদেশকে। বঙ্গবন্ধুর প্রেরণায় তাঁরই দেখানো পথে শেখ হাসিনার স্বপ্ন-সাধনার তান বাঁধি অমিয় সুধালোকে, চলুন বদলে দিই আমাদের প্রাণপ্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশকে—সুবর্ণ জয়ন্তীর শুভলগ্নে এই হোক জাতিরাষ্ট্র বাংলাদেশের দৃঢ় প্রত্যয়।