হাদিসে যেসব ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে কঠোর হুঁশিয়ারি এসেছে
মুফতি সাইফুল ইসলাম
ইসলামী জীবনব্যবস্থার অন্যতম মৌলিক বৈশিষ্ট্য হলো এটি ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ, নৈতিক ও অর্থনীতির সর্বত্র সর্বান্তকরণ আলোকপাত করে দিয়েছে। সেই ধারাবাহিকতায় ইসলামের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা সামগ্রিক জীবনব্যবস্থায় জীবনদর্শনের মৌল চেতনার নীতিমালা সুস্পষ্ট করে দিয়েছে। ইসলামী জীবনাদর্শ থেকে উৎসারিত ইসলামী অর্থনীতি ইসলামী মূল্যবোধ দ্বারাই বিকশিত হয়েছে। তাই ইসলামের মৌলিক শিক্ষা ও মূল্যবোধই ইসলামী অর্থনীতির মৌলিক উপাদান।
ইসলামের অর্থব্যবস্থা অনেক বিশদ একটি বিষয়। যার সর্বব্যাপী আলোচনা শব্দসংখ্যার স্কেলে বেঁধে দেওয়া এই প্রবন্ধে সম্ভব নয়। আমরা আজ আলোচনা করব ইসলামী অর্থব্যবস্থায় উপার্জনের নীতি নিয়ে। উপার্জনের নীতিতে ইসলামের নির্দেশনা অনেক স্পষ্ট ও পরিষ্কার। ন্যায়-নিষ্ঠা ও সততা হচ্ছে বৈধ উপার্জনের বড় অনুষঙ্গ। নিচের হাদিসগুলোর ভাষ্যের প্রতি দৃষ্টিপাত করলে বিষয়টি অনুধাবন করা সহজ হবে।
হজরত কায়েস (রা.) বলেন, আমাদের ব্যবসায়ীদের বলা হতো দালাল। একদিন রাসুল (সা.) আমাদের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন। তখন তিনি আমাদের এর চেয়েও সুন্দর একটি নাম দেন। তিনি ইরশাদ করেন, ‘হে ব্যবসায়ীরা, পণ্য বিক্রি করতে গিয়ে অনেক অহেতুক কথা বলা এবং মিথ্যা শপথ করার পরিবেশ তৈরি হয়। এ জন্য তোমরা সদকা করো, যেন তোমাদের ত্রুটি-বিচ্যুতির কাফফারা হয়ে যায়। ’ (আবু দাউদ, হাদিস : ৩৩২৬)
রাফে ইবনে খাদিজ (রা.) বলেন, কোনো এক ব্যক্তি জিজ্ঞাসা করল, হে আল্লাহর রাসুল (সা.), উপার্জনের মাধ্যমগুলোর মাঝে কোন মাধ্যমটি সবচেয়ে উত্তম ও পবিত্র? রাসুল (সা.) উত্তর দিলেন, নিজের হাতের কাজ এবং বিশ্বস্ততাপূর্ণ ব্যবসা। ’ (মুসনাদে আহমাদ, হাদিস : ১৭২৫৬)
রাসুল (সা.) ব্যবসায়ীদের উদ্দেশ্য করে ইরশাদ করেছেন, ব্যবসায় অধিক কসম করা থেকে বিরত থাকো। এটি সাময়িক সময়ের জন্য ব্যবসার প্রসার ঘটালেও বরকত নষ্ট করে দেয়। (মুসলিম, হাদিস : ১৬০৭)। মহানবী (সা.)
আরো বলেন, ‘কোনো ব্যবসায়ীর জন্য উচিত নয় কোনো জিনিস বিক্রি করা এবং তার ভেতরের দোষ-ত্রুটির কথা বর্ণনা না করা। ’ (মুসনাদে আহমাদ, হাদিস : ১৭৪৫১)
রাসুল (সা.) একবার একজন শস্য ব্যবসায়ীর পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন। সে সময় তিনি তার শস্যের স্তূপের ভেতর হাত ঢুকিয়ে দিলেন। তখন ভেতরের শস্যগুলোতে তিনি কিছুটা আর্দ্রতা অনুভব করলেন। নবী (সা.) জিজ্ঞাসা করলেন এটা কী? সেই ব্যবসয়ী উত্তর দিলেন বৃষ্টিতে ভিজে গিয়েছিল। তখন তিনি বললেন, ভেজা অংশটা ওপরে রাখলে না কেন? তারপর নবী (সা.) বললেন, যারা ধোঁঁঁঁকা দেয় তারা আমাদের অন্তর্ভুক্ত নয়। (মুসলিম, হাদিস : ১০২)
এই হাদিসগুলোতে ব্যবসার ক্ষেত্রে বিভিন্ন নৈতিকতার শিক্ষার পাশাপাশি ওই যুগের যৎসামান্য ব্যাবসায়িক প্রতারণার বিষয়ে কঠোর সতর্কবাণী উচ্চারিত হয়েছে। পক্ষান্তরে হাল আমলের ক্রেতা ঠকানোর ভয়াবহতম পন্থা আর পণ্যে ফরমালিনসহ নানা ধরনের প্রাণঘাতী মিশ্রণ ঘটানোর ক্ষেত্রে ইসলামের সাবধান বাণী কত কঠোরতম হতে পারে তা সহজেই অনুমেয়।
আজকের সমাজে পণ্যের গুদামজাতকরণ একটি স্বাভাবিক বিষয়। যেখানে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য আটকে রেখে মূল্যবৃদ্ধির অপেক্ষা করা হয়। মূল্য বেড়ে যাওয়ার পর সেই পণ্য অতিরিক্ত মুনাফায় বাজারজাত করা হয়। বিশ্বনবী (সা.) এ জাতীয় কূটকৌশলের ব্যাপারে তীব্র অসন্তোষ ব্যক্ত করেছেন। তিনি ইরশাদ করেছেন, ‘যে ব্যাবসায়ী পণ্য আবদ্ধ ও স্তূপ করে রাখে সে গুনাহগার। ’ (মুসলিম, হাদিস ১৬০৫)
অপরদিকে ব্যবসায় মানবিক হওয়ায় উদ্বুদ্ধ করে তিনি ঘোষণা করেছেন, ‘যে ব্যবসায়ী নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য আটকে রাখে না; বরং সময়মতো বাজারে নিয়ে আসে সে আল্লাহর রহমত পাওয়ার অধিকারী। তাকে আল্লাহ রিজিক দেবেন। আর নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের আবদ্ধকারী হচ্ছে অভিশপ্ত। ’ (ইবনে মাজাহ, হাদিস : ২১৫৩)
ওপরের হাদিসগুলো থেকে প্রতিয়মান হয় যে গুদামজাত করে ভোক্তা সাধারণকে বিপদে ফেলে পণ্যের দাম বাড়ানো একটি গর্হিত কাজ। একইভাবে পরিকল্পনা করে জোটবদ্ধ হয়ে পণ্যের দাম অযৌক্তিক উপায়ে বাড়িয়ে দেওয়াও মারাত্মক অন্যায়। যা বিভিন্ন মৌসুমে প্রতিনিয়ত আমাদের সমাজে ঘটে চলেছে। বলাবাহুল্য এ জাতীয় প্রবণতার সঙ্গে ইসলামের সহানুভূতিশীল ব্যবসানীতির কোনো সম্পর্ক নেই।
মূলত ইসলামের অন্যতম উপার্জননীতি হচ্ছে সৎ ব্যবসায় নিয়োজিত থাকা, অসৎ ব্যবসা থেকে বিরত থাকা। ইসলামের নান্দনিক এই উপার্জননীতি বাস্তবায়িত হলে সমাজের সর্বত্র বিরাজ করবে হৃদ্যতা ও প্রশান্তির আবহ।
আল্লাহ তাআলা আমাদের সবাইকেই হালাল উপায়ে রিজিক অন্বেষণের তাওফিক দান করুন। আমিন