বরিসের প্রস্থান ও মহাসংকটে লিজের শুরু
গাজীউল হাসান খান

করোনা-পরবর্তী সময়ে রাশিয়া-ইউক্রেন দীর্ঘ সংঘর্ষ এবং তার ফলে বিশ্ব অর্থনীতিতে মহামন্দার যে কালো ছায়া নেমে এসেছে তা মোকাবেলা করতে যুক্তরাজ্যের রক্ষণশীল দলনেত্রী এবং বর্তমান প্রধানমন্ত্রী লিজ ট্রাস কতটুকু উপযুক্ত সেটা নিয়ে এখন শুধু তাঁর নিজ দেশেই নয়, আলোচনা শুরু হয়েছে সবখানেই। তাঁর ভবিষ্যত্ শাসনকালে, তা যতই স্বল্পমেয়াদি হোক না কেন, বর্তমান যুক্তরাজ্য কতটুকু যুক্ত থাকবে সেটি নিয়েও জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে এখন নানা প্রশ্ন ব্যাপকতা লাভ করছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) সীমান্তগত ও বাণিজ্যিক কঠোর বিধিমালার প্রশ্নে, উত্তর আয়ারল্যান্ড ও স্কটল্যান্ডের স্বাধীনতার প্রশ্নে ২০২৩-এ যে গণভোটের দাবিটি ঝুলে রয়েছে, সেগুলোর কতটুকু সুরাহা করতে পারবেন অপেক্ষাকৃতভাবে কম অভিজ্ঞতাসম্পন্ন রাজনীতিক লিজ ট্রাস? বিগত তিনটি রক্ষণশীল সরকারের অধীনে মন্ত্রিত্ব পেলেও তাঁর সে সুতীক্ষ মেধা, রাজনৈতিক দূরদর্শিতা ও প্রশাসনিক দক্ষতা কোথায়? এ ছাড়া আগের তুলনায় যুক্তরাজ্যের মানুষের অর্থনৈতিক ও জ্বালানি সংকট বেড়েছে বহুগুণ। মুদ্রাস্ফীতি ও দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি এগিয়ে যাচ্ছে পাল্লা দিয়ে।
ব্রিটেনের ১৫তম প্রধানমন্ত্রী হিসেবে বড় দুঃসময়ে দায়িত্ব কাঁধে নিয়েছেন লিজ ট্রাস। এ সংকট দক্ষতার সঙ্গে মোকাবেলা করতে না পারলে ব্রিটিশ রাজনীতির গত ৬০ বছরের ইতিহাসে তিনিই হবেন সবচেয়ে স্বল্পস্থায়ী প্রধানমন্ত্রী। সাবেক রক্ষণশীলদলীয় প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী মার্গারেট থ্যাচার ছিলেন ব্রিটেনের প্রথম মহিলা প্রধানমন্ত্রী, যাঁর শাসনকাল হয়েছিল দীর্ঘস্থায়ী এবং অনেকটাই সফল। পরবর্তী সময়ে ক্ষমতায় উপবিষ্ট হয়েছিলেন দ্বিতীয় মহিলা প্রধানমন্ত্রী টেরেসা মে। তিনি অল্প সময়ে অভ্যন্তরীণ দলীয় কোন্দলে পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিলেন। অক্সফোর্ড শিক্ষিতা লিজ ট্রাস ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য না হলেও ব্রিটেনের সাধারণ নির্বাচন দ্বারপ্রান্তে এসে গেছে। অন্যান্য দেশ, যেমন—বাংলাদেশ, ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের মতো ব্রিটেনের সাধারণ নির্বাচনও অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে ২০২৪ সালে বা কাছাকাছি সময়ে। ব্রিটেনব্যাপী এখন প্রশ্ন উঠেছে, তত দিন পর্যন্ত যুক্তরাজ্যকে যুক্ত রেখে উদ্ভূত পরিস্থিতি সামলাতে পারবেন কী তিনি। অনেকে বলেন, নেহাত ভাগ্যগুণে প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন লিজ। সাবেক রক্ষণশীল অর্থমন্ত্রী ঋষি সোনাকের মতো বিদ্যাবুদ্ধি কিংবা কর্মদক্ষতাও তাঁর নেই। এ মন্তব্য বিরোধী দল ও সাধারণ মানুষ অনেকের।
ইউরোপের অন্যান্য দেশের তুলনায় ব্রিটেনের জ্বালানি সংকট কোনোভাবেই কম নয়। ব্রিটেনে এখন মাথাপিছু জ্বালানি ব্যয় দাঁড়াবে বছরে তিন হাজার ৫০০ পাউন্ডের বেশি, যা সাধারণ মানুষের ধারণাতীত। এ ছাড়া রয়েছে দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন ঊর্ধ্বগতি। বর্তমান মুদ্রাস্ফীতির কারণে (১০ শতাংশের বেশি) নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যসামগ্রী ক্রমেই মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে যাচ্ছে। ফলে দৈনন্দিন জীবনযাপনের মান নিচে নেমে যাচ্ছে। মানুষ দৃশ্যতই দরিদ্র হয়ে পড়ছে। খাদ্য ও স্বাস্থ্যসেবার মানও উল্লিখিত কারণে জটিল থেকে জটিলতর হয়ে উঠছে। এ অবস্থায় ক্ষমতাসীন দলে নেতৃত্বের পরিবর্তন কতটুকু সুফল বয়ে আনতে সক্ষম হবে সে প্রশ্ন এখন সবার মুখে মুখে। কারণ রপ্তানি বাণিজ্যের নিম্নগতি এবং জাতীয় রাজস্ব আয়ে ভাটা পড়ছে লক্ষণীয়ভাবে। এ ছাড়া দেশের উত্তরাঞ্চলে অবকাঠামোগত বিনির্মাণ এবং অর্থনৈতিক কিংবা বাণিজ্যিক উন্নয়নের জন্য যথেষ্ট অর্থ খরচ করে গেছেন দলের সাবেক প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন। তাতে রাজকোষে ঘাটতি দেখা দিয়েছে। যদিও নবনিযুক্ত প্রধানমন্ত্রী লিজ ট্রাস বলেছেন যে আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে উদ্ভূত পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য তাঁর নতুন সরকার একটি জরুরি পরিকল্পনা ঘোষণা করবে এবং কর্মসূচি হাতে নেবে, তবু প্রয়োজনীয় তহবিল জোগান দেওয়ার বিষয়টি অনেকটা অদৃশ্যই থেকে যাচ্ছে।
জীবনযাত্রার ব্যয় নির্বাহের জন্য সাধারণ মানুষকে অর্থ সাহায্য দেওয়া কিংবা উচ্চমাত্রার জ্বালানি বিল পরিশোধের জন্য সাহায্য করার বিষয়টি খুব সহজ নয়। ব্রেক্সিটের মাধ্যমে ব্রিটেনের ইইউ থেকে বেরিয়ে আসা এবং করোনার কারণে রপ্তানি আয় কমে যাওয়ার ফলে জাতীয় ক্ষেত্রে ব্যয় নির্বাহ করা এখন কষ্টসাধ্য হয়ে পড়েছে। ডলারের বিপরীতে পাউন্ড-স্টার্লিংয়ের উল্লেখযোগ্য দরপতন হয়েছে বিগত দিনগুলোতে। সেসব দিক বিবেচনায় ইউরোপ ও এশিয়ার অনেক উন্নয়নশীল দেশের পর্যায়ে নেমে যাচ্ছে ব্রিটেন, অতিদ্রুত। এ ক্ষেত্রে অন্যান্যের মতো ব্রিটেনও যে খুব শিগগির আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) কিংবা বিভিন্ন অর্থ প্রদানকারী সংস্থার দ্বারস্থ হবে না, এমন নয়। সুতরাং সম্প্রতি বাংলাদেশ নিয়ে যাঁরা হৈচৈ করেছেন, তাঁদের এখন আর হয়তো বুঝতে বাকি নেই যে বিভিন্ন সরকার পরিস্থিতির কতটা শিকারে পরিণত হতে পারে অতি অল্প সময়ের ব্যবধানে।
প্রায় ৩০ বছর ক্ষমতার বাইরে থেকে এক বিশাল জয় নিয়ে ২০১৯ সালে ব্রিটেনে ক্ষমতাসীন হয়েছিল ব্রিটিশ রক্ষণশীল দল। ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) থেকে বেরিয়ে যাওয়ার (ব্রেক্সিট) প্রশ্নে ২০১৬ সালে ক্ষমতা থেকে পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিলেন তত্কালীন রক্ষণশীল প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন। তাঁর স্থলাভিষিক্ত হয়েছিলেন রক্ষণশীল আরেক নেত্রী, টেরেসা মে। কিন্তু ব্রেক্সিটসংক্রান্ত বিভিন্ন জটিল প্রশ্নে তাঁকেও শেষ পর্যন্ত পদত্যাগ করতে হয়েছে নিজ দলের অন্য তরুণ নেতা বরিস জনসন ও অন্যদের কঠিন চাপের মুখে। বরিস জনসন ছিলেন তত্কালীন প্রধানমন্ত্রী টেরেসা মের ক্যাবিনেটে পররাষ্ট্রমন্ত্রী। ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) ত্যাগের বিভিন্ন শর্তকে কেন্দ্র করে বরিস পদত্যাগ করেন এবং রক্ষণশীল দলে নেতৃত্বের পরিবর্তন দাবি করেন। বিশিষ্ট সাংবাদিক কলামিস্ট বরিস এবং তাঁর অনুসারীরা ছিলেন কট্টর ব্রেক্সিটপন্থী। অন্যদিকে ডেভিড ক্যামেরন ও টেরেসা মে ইউরোপীয় ইউনিয়নে থাকার পক্ষপাতী ছিলেন। কিন্তু দলের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের ইচ্ছা বা মতের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে ক্যামেরন ও মে পদত্যাগ করেন। দলীয় নেতৃত্বে অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন তরুণ রাজনীতিক বরিস জনসন। তারই ধারাবাহিকতায় ব্রেক্সিট ইস্যুতে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতায় ২০১৯ সালে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে ক্ষমতাসীন হয়েছিলেন বরিস। কিন্তু তিন বছরের শাসনের পর বিভিন্ন অনিয়ম, ক্ষমতায় থেকে আইন অমান্য করে ১০ ডাউনিং স্ট্রিটে ‘নিশীথে মদের পার্টি’ করা কিংবা মিথ্যাচারের দায়ে শেষ পর্যন্ত দলীয় নেতাকর্মীদের চাপেই বরিসকে পদত্যাগ করতে হয়েছে।
অসামান্য সাংগঠনিক ক্ষমতার অধিকারী, বাগ্মী ও জনপ্রিয় লেখক, কলামিস্ট বরিস জনসন প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে শেষ পর্যন্ত সরে যেতে বাধ্য হলেও বেক্সিট ও করোনা মোকাবেলার জন্য তিনি ব্রিটিশ রাজনীতির ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে থাকবেন বলে অনেকে মনে করেন। যুক্তরাষ্ট্র চীনের বাইরে বর্তমান সমসাময়িক বিশ্বরাজনীতিতে বিকল্প নেতৃত্ব দেওয়ার যোগ্যতা বা ক্ষমতা তাঁর ছিল বলে অনেকে মনে করেন। প্রধানমন্ত্রিত্ব হারানোর পর তিনি হয়তো পার্লামেন্টের সদস্য পদ রেখে লিখে ও বক্তৃতা দিয়েই বেশির ভাগ সময় কাটাবেন বলে অনেকের ধারণা। তবে তিনি পরিস্থিতি বিবেচনা করে আবার দলীয় নেতৃত্বে ফিরে আসতে পারেন বলেও রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহলের বিশ্বাস। কারণ বরিস বসে বসে কাল কাটানোর মানুষ নন।
প্রধানমন্ত্রী হওয়ার আগে তিনি ব্রিটিশ ডেইলি টেলিগ্রাফে সাপ্তাহিক কলাম লিখে বছরে দুই লাখ ৭৫ হাজার পাউন্ড সম্মানী নিয়েছেন। এ ছাড়া ‘শেকসপিয়ার : দ্য রিডল অব জিনিয়াস’ গ্রন্থ লেখার জন্য পাঁচ লাখ পাউন্ড অর্থের বিনিময়ে চুক্তিবদ্ধ হয়েছিলেন। প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নেওয়ার আগ পর্যন্ত বরিস সংবাদপত্র, ম্যাগাজিন ও তথ্যচিত্র নির্মাণ করে প্রচুর অর্থ উপার্জন করেছেন। এখনো আবার তিনি আত্মজীবনী কিংবা স্মৃতিকথা লেখা শুরু করতে পারেন বিভিন্ন প্রকাশনা সংস্থার জন্য। ক্ষমতায় তাঁর তিন বছরের অভিজ্ঞতার কথা লিখেও মিলিয়ন পাউন্ড উপার্জনের পথ খোলা রয়েছে তাঁর জন্য। ব্রিটিশ ও বিশ্বখ্যাত প্রকাশকরা এরই মধ্যে তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করা শুরু করেছেন বলে জানা গেছে। পাশাপাশি দলের নেতৃত্বের অভিভাবক হিসেবেও সংশ্লিষ্ট থাকার তাগিদ রয়েছে। বরিসই একমাত্র রক্ষণশীলদলীয় রাজনীতিক, যিনি লেবার অধ্যুষিত লন্ডন মহানগরীতে পর পর দুইবার মেয়র নির্বাচিত হয়েছিলেন এবং সাফল্যজনকভাবে দায়িত্ব পালন করার গৌরব অর্জন করতে সমর্থ হয়েছিলেন। এটন কলেজ ও অক্সফোর্ডে অধ্যয়ন করা বরিস ছাত্রজীবন থেকেই নেতৃত্বের সঙ্গে জড়িত ছিলেন বিভিন্ন পর্যায়ে।
বরিস জনসনের পূর্বপুরুষরা ছিলেন তুরস্কের অভিজাত মুসলিম পরিবারের সদস্য। তাঁর প্রপিতামহ আলী কামাল ছিলেন উসমানীয় সুলতানের একজন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, বিশিষ্ট রাজনীতিক ও সাংবাদিক। বরিসের অন্য প্রপিতামহ ছিলেন উসমানীয় সালতানাতের একজন রাষ্ট্রদূত। আলী কামাল ১৯১৮ সালের পর উসমানীয় প্রশাসনের দায়িত্বে নিয়োজিত হয়েছিলেন এবং তিনি মুস্তফা কামাল আতাতুর্কের জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের বিরোধী ছিলেন। সে কারণে জাতীয়তাবাদীরা তাঁকে হত্যা করে। তবে তার অনেক আগেই আলী কামাল ইংল্যান্ডে এক সভ্রান্ত শ্বেতাঙ্গ মহিলাকে বিয়ে করেন। তিনি (মহিলা) ছিলেন ধর্মীয় দিক থেকে খ্রিস্টান। সেই শ্বেতাঙ্গ খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী মহিলা তাঁর সন্তানদের মুসলিম ও খ্রিস্টান ঐতিহ্য অনুসারে নাম রাখেন। বরিস জনসনের পিতামহের নাম ছিল উসমান কামাল উইলফ্রেড জনসন। পিতার হত্যাকাণ্ডের পর উসমান কামাল আর তুরস্কের ইস্তাম্বুলে ফিরে যাননি। কিন্তু এখনো সেখানে বরিস জনসনদের ভিটামাটি পড়ে রয়েছে। বরিসের কাছে ইস্তাম্বুল অত্যন্ত প্রিয় নগরী। তিনিও তাঁর প্রপিতামহ আলী কামালের মতো উসমানীয় সালতানাতের একজন অনুরক্ত ভক্ত। বরিস প্রধানমন্ত্রিত্ব ছেড়ে গেলেও অনেকে তাঁর কাছে এখনো অসামান্য অনেক অবদান আশা করেন।
লেখক : বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার (বাসস) সাবেক প্রধান সম্পাদক ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক




