ইসলামে বাজারে যাওয়ার শিষ্টাচার
মুফতি মুহাম্মদ মর্তুজা
হাদিসের ভাষ্যমতে, আল্লাহর কাছে সবচেয়ে নিকৃষ্ট জায়গা হলো বাজার। কেননা বাজার মানুষকে আল্লাহর জিকির ও ইবাদত থেকে ভুলিয়ে রাখে। মানুষের অধিক দুনিয়াপ্রীতির কারণে বাজারগুলো হয়ে উঠেছে ধোঁকা-প্রবঞ্চনা, মিথ্যাচার, বিশ্বাসঘাতকতা প্রভৃতি পাপাচারের স্থান। পাশাপাশি পর্দার লঙ্ঘন তো আছেই।
তথাপি জীবনের তাগিদে মানুষকে বাজারে যেতে হবে। ক্রয়-বিক্রয়ও করতে হবে।
তবে তা হতে হবে আল্লাহর দেওয়া বিধান ও রাসুল (সা.)-এর সুন্নত অনুযায়ী। ইসলামে বাজারে গমনের জন্য কিছু শিষ্টাচার রয়েছে, নিম্নে সেগুলো তুলে ধরা হলো—
বাজারে গমনের আগে দোয়া পড়া : রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি বাজারে প্রবেশ করে বলবে, লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াহদাহু লা শারিকা লাহু, লাহুল মুলকু ওয়া লাহুল হামদু, ইয়ুহয়ি ওয়া ইউমিতু বিয়াদিহিল খাইর, ওয়া হুয়া আলা কুল্লি শায়ইং কাদির। (অর্থ: আল্লাহ ছাড়া কোনো উপাস্য নেই, তিনি এক, তাঁর কোনো অংশীদার নেই, রাজত্ব তাঁরই, সমস্ত প্রশংসা তাঁর। তিনি জীবিত করেন এবং মৃত্যু দেন। তিনি চিরঞ্জীব, তাঁর মৃত্যু নেই। তাঁর হাতেই সব কল্যাণ। তিনি সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী)। আল্লাহ তার জন্য দশ লাখ নেকি বরাদ্দ করেন, দশ লাখ গুনাহ মাফ করেন এবং তার দশ লাখ মর্যাদা বৃদ্ধি করবেন। ’ (তিরমিজি, হাদিস : ৩৪২৮)
একে অন্যকে সালাম দেওয়া : সাহাবায়ে কেরামের কেউ কেউ শুধু সালামের ফজিলত অর্জনের উদ্দেশ্যেই বাজারে যেতেন। তোফায়েল ইবনে উবাই ইবনে কাব (রা.) হতে বর্ণিত, তিনি আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.)-এর কাছে আসতেন এবং সকালে তাঁর সঙ্গে বাজারে যেতেন। তিনি বলেন, ‘যখন আমরা সকালে বাজারে যেতাম, তখন তিনি প্রত্যেক খুচরা বিক্রেতা, স্থায়ী ব্যবসায়ী, মিসকিন তথা অন্য কোনো ব্যক্তির কাছ দিয়ে অতিক্রম করার সময় তাকে সালাম দিতেন। ’ তোফায়েল বলেন, সুতরাং আমি একদিন (অভ্যাসমতো) আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.)-এর কাছে গেলাম। তিনি আমাকে তাঁর সঙ্গে বাজারে যেতে বলেন। আমি বললাম, ‘আপনি বাজারে গিয়ে কী করবেন? আপনি তো বেচা-কেনার জন্য কোথাও থামেন না, কোনো পণ্য সম্পর্কে জিজ্ঞেস করেন না, তার দরদাম জানতে চান না এবং বাজারের কোনো মজলিসে বসেনও না। আমি বলছি, এখানে আমাদের সঙ্গে বসে যান, এখানেই কথাবার্তা বলি। ’ (তোফায়েলের ভুঁড়ি মোটা ছিল, সে জন্য) তিনি বলেন, ‘ওহে ভুঁড়িমোটা, আমরা সকালবেলায় বাজারে একমাত্র সালাম দেওয়ার উদ্দেশ্যে যাই। যার সঙ্গেই আমাদের সাক্ষাৎ হয়, আমরা তাকেই সালাম দিই। ’ (মুয়াত্তায়ে মালেক, হাদিস : ৮৫০)
বাজারে হৈ-হুল্লোড় না করা : বাজারে গিয়ে হৈ-হুল্লোড় করা, মানুষের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করা ইসলামের শিষ্টাচারবহির্ভূত। আবু আবদুল্লাহ আল-জাদালি (রহ.) থেকে বর্ণিত, আমি রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর চরিত্র-মাধুর্য সম্বন্ধে আয়েশা (রা.)-কে প্রশ্ন করলাম। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) কখনো অশ্লীল ও কটুভাষী ছিলেন না, অশ্লীল ব্যবহারও করেননি। তিনি কখনো বাজারে গিয়ে হট্টগোল করতেন না এবং অন্যায়ের দ্বারা অন্যায়ের প্রতিশোধ নেননি; বরং তিনি উদার মন নিয়ে ক্ষমা করে দিতেন। ’ (তিরমিজি, হাদিস : ২০১৬)
হালাল পণ্য ক্রয়-বিক্রয় করা: বাজারে ক্রয়-বিক্রয় ও লেনদেনের ক্ষেত্রে হালাল-হারামের বিষয়টি গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করা মুমিনের কর্তব্য। নোমান ইবনে বশির (রা.) বলেন, নবী (সা.) বলেছেন, হালাল সুস্পষ্ট এবং হারামও সুস্পষ্ট, উভয়ের মাঝে বহু অস্পষ্ট বিষয় রয়েছে। যে ব্যক্তি গুনাহের সন্দেহযুক্ত কাজ পরিত্যাগ করে, সে ব্যক্তি যে বিষয়ে গুনাহ হওয়া সুস্পষ্ট, সে বিষয়ে অধিকতর পরিত্যাগকারী হবে। পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি গুনাহের সন্দেহযুক্ত কাজ করতে দুঃসাহস করে, সে ব্যক্তির সুস্পষ্ট গুনাহের কাজে পতিত হওয়ার যথেষ্ট আশঙ্কা রয়েছে। গুনাহসমূহ আল্লাহর সংরক্ষিত এলাকা, যে জানোয়ার সংরক্ষিত এলাকার চারপাশে চরতে থাকে, তার ওই সংরক্ষিত এলাকায় প্রবেশ করার সম্ভাবনা আছে। (বুখারি, হাদিস : ২০৫১)
প্রতারণা থেকে বিরত থাকা : বাজারে ক্রয়-বিক্রয়ের ক্ষেত্রে ক্রেতা-বিক্রেতা কোনো পক্ষেরই মিথ্যা, ধোঁকাবাজি ও প্রতারণার আশ্রয় নেওয়া উচিত নয়। নবীজি (সা.) ইরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি প্রতারণা করে, তার সঙ্গে আমার কোনো সম্পর্ক নেই। (আবু দাউদ, হাদিস : ৩৪৫২)
মাপে কম দেওয়ার বিষয়ে সতর্ক করে পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘দুর্ভোগ মাপে কম দানকারীদের জন্য। যারা লোকদের কাছ থেকে মেপে নেওয়ার সময় পূর্ণ মাত্রায় নেয় এবং যখন লোকদের মেপে দেয় বা ওজন করে দেয়, তখন কম দেয়। ’ (সুরা মুতাফফিফিন, আয়াত : ১-৩)
দালালির মধ্যে ক্রেতাকে প্রতারিত করাও নিষিদ্ধ। ইবনে ওমর (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) এক ক্রেতার ওপর দিয়ে অন্য ক্রেতার দরাদরি করতে নিষেধ করেছেন। ’ (বুখারি, হাদিস : ৬৯৬৩)
ক্রেতাদের বিপদে ফেলার উদ্দেশ্যে পণ্য মজুদ করাও নিষিদ্ধ। (তিরমিজি, হাদিস : ১২১০)
পরনিন্দার আসর বর্জন করা : বাজারে সাধারণত পরনিন্দার চর্চা বেশি হয়, যা জঘন্য অপরাধ। পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহ বলেন, ‘পেছনে ও সামনে প্রত্যেক পরনিন্দাকারীর জন্য দুর্ভোগ-ধ্বংস। ’ (সুরা হুমাজাহ, আয়াত : ০১)
পর্দা মেনে চলা : বাজারে গেলে চোখের গুনাহ বেশি হয়ে যায়, তাই সেখানে পর্দার ব্যাপারে সতর্ক থাকা আবশ্যক। পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহ বলেন, মুমিন পুরুষদের বলুন, তারা যেন তাদের দৃষ্টিকে নত রাখে। (সুরা নুর, আয়াত : ৩০)
আবার নারীদের ব্যাপারে ইরশাদ হয়েছে, ‘হে নবী, আপনি আপনার স্ত্রীদের, কন্যাদের ও মুমিন নারীদের বলুন, তারা যেন তাদের চাদরের কিয়দংশ নিজেদের ওপর টেনে দেয়। এতে তাদের চেনা সহজ হবে। ফলে তাদের উত্ত্যক্ত করা হবে না। আল্লাহ ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু। ’ (সুরা আহজাব, আয়াত : ৫৯)
আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) ওই আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেছেন, আল্লাহ তাআলা মুমিন নারীদের আদেশ করেছেন যখন তারা কোনো প্রয়োজনে ঘর থেকে বের হবে তখন যেন মাথার ওপর থেকে ওড়না/চাদর টেনে মুখমণ্ডল আবৃত করে। আর (চলাফেরার সুবিধার্থে) শুধু এক চোখ খোলা রাখে। (ফাতহুল বারি : ৮/৫৪, ৭৬, ১১৪)
কেনাকাটায় মধ্যমপন্থা অবলম্বন করা : হাদিস শরিফে ইরশাদ হয়েছে, ‘(রহমানের বান্দা তো তারাই) যারা অপব্যয়ও করে না, আবার কৃপণতাও করে না। তাদের পন্থা হয় এতদুভয়ের মধ্যবর্তী। ’ (সুরা : ফুরকান, আয়াত : ৬৭)