অন্তরের অসুখ নির্ণয়ের পদ্ধতি
জাওয়াদ তাহের
আমাদের শরীর যেভাবে অসুস্থ হয় তেমনি আমাদের অন্তরও বিভিন্ন ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়। আর এই অন্তরের ব্যাধি মানুষকে ধীরে ধীরে অধঃপতনের দিকে নিয়ে যায়। এ জন্য একজন মানুষের কর্তব্য প্রথমেই তার নিজের এসব ব্যাধি নির্ণয় করা। যখন সে তার ব্যাধি নির্ণয় করে নেবে, তখন এসব মহামারি থেকে পরিত্রাণ লাভ করতে পারবে।
এসব ব্যাধি নির্ণয় করার জন্য প্রথমেই নিজের প্রবল আগ্রহ লাগবে। যে আগ্রহ তাকে ধীরে ধীরে এ থেকে উত্তরণের পথ দেখাবে।
আল্লাহ তাআলা যখন কোনো বান্দার কল্যাণ চান, তখন তাকে তার নিজের দোষ-ত্রুটি দেখিয়ে দেন। আর মানুষ যখন নিজের দোষ-ত্রুটি সম্পর্কে সতর্ক থাকবে, তখন অন্য কারো দোষ-ত্রুটি নিয়ে আলোচনা করার সুযোগ পাবে না। নিম্নে আমরা নিজের দোষ-ত্রুটি জানার কিছু পদ্ধতি আলোচনা করব—
এক. নিজেকে কোনো আল্লাহওয়ালা সম্মানিত ব্যক্তির কাছে সোপর্দ করে দেওয়া। যিনি অন্তরের ত্রুটি সম্পর্কে অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন। এমন ব্যক্তিদের কাছে মাঝেমধ্যে যাওয়া; আত্মার ব্যাধি নিরাময়ের জন্য। তিনি যদি কোনো পদ্ধতি বলে দেন, তাহলে সেভাবেই মেনে চলা। তবে এমন আল্লাহওয়ালা বুজুর্গকে খুঁজে পাওয়া দুষ্কর হলেও, আমার আত্মার ব্যাধির জন্য আমাকে নিজে খুঁজে নিতে হবে। সাহাবায়ে কেরাম রাসুল (সা.)-এর কাছে নিজেকে সোপর্দ করে দিয়েছেন। আর রাসুল (সা.) তাদের বিভিন্ন পদ্ধতিতে সংশোধন করেছেন। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘তিনিই উম্মিদের (আরব জাতি) মধ্যে তাদেরই একজনকে রাসুল করে পাঠিয়েছেন, যে তাদের সামনে তাঁর আয়াত তিলাওয়াত করবে, তাদের পরিশুদ্ধ (অভ্যন্তরীণ দোষ থেকে পবিত্র) করবে এবং তাদের কিতাব ও হিকমতের শিক্ষা দেবে, যদিও তারা এর আগে সুস্পষ্ট গোমরাহিতে নিপতিত ছিল। ’ (সুরা : জুমুআ, আয়াত : ২)
দুই. সত্যবাদী, দ্বিনদার বন্ধু গ্রহণ করা। নিজের যাবতীয় কাজের জন্য তাকে পর্যবেক্ষক হিসেবে মেনে নেওয়া। যে বন্ধু আমার মন্দ অভ্যাসগুলো প্রত্যক্ষ করবে এবং আমাকে সুন্দরভাবে সতর্ক করবে। আর ভালো অভ্যাসের ব্যাপারেও উৎসাহ প্রদান করবে। আবু হুরাইরা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘এক মুমিন অন্য মুমিনের জন্য আয়নাস্বরূপ এবং এক মুমিন অন্য মুমিনের ভাই। তারা একে অপরের ক্ষতি করা হতে রক্ষা করে এবং তার অনুপস্থিতিতে তাকে রক্ষা করে। ’ (সুনানে আবুু দাউদ, হাদিস : ৪৯১৮)
কোরআনেও আল্লাহ তাআলা ভালো বন্ধু গ্রহণ করার কথা বলেছেন। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘হে মুমিনরা, আল্লাহকে ভয় করো এবং তোমরা সত্যবাদীদের সঙ্গে থাকো। ’ (সুরা : তাওবা, আয়াত : ১০৩)
এ জন্য ওমর (রা.) বলতেন, আল্লাহ ওই ব্যক্তির ওপর দয়া করুন, যিনি আমাদেরকে আমাদের দোষ দেখিয়ে দেন। (ইহয়াউ উলুমিদ্দিন)
এ ক্ষেত্রে যে আমার দোষ দেখিয়ে দেবে, তার প্রতি বিন্দুমাত্র রাগ করা যাবে না; বরং তার প্রতি কৃতজ্ঞ থাকতে হবে যে সে তাকে একটি বিপদ থেকে রক্ষা করেছে। কারণ আমাদের শরীরে কাপড়ের নিচে যদি কোনো বিষাক্ত জিনিস থাকে, আর তা যদি কেউ দেখিয়ে দেয় তাহলে আমি তার প্রতি আজীবন কৃতজ্ঞ থাকব। তেমনি আত্মার ব্যাধি এই বিষাক্ত জিনিসের মতোই।
তিন. শত্রুর কাছ থেকে নিজের ত্রুটি জানার চেষ্টা করা। কারণ বন্ধু অনেক সময় তোষামোদি হিসেবে অনেক কিছুই বলে দিতে পারে। কিন্তু যে শত্রু আছে, সে প্রকৃত জিনিস বলতে দ্বিধা করবে না। এ জন্য তার বলা কথা আমলে নিয়ে চিন্তা করলে, নিজের দোষ খুঁজে পাওয়া যাবে।
চার. সাধারণ মানুষের সঙ্গে চলাফেরা করা। এটিও নিজের দোষ জানার মাধ্যম। কারণ তাদের মাঝে যেসব মন্দ অভ্যাস দেখা যাবে, তা থেকে নিজেকে বিরত রাখা। এভাবেই দেখা যাবে ধীরে ধীরে নিজের যত আত্মিক ব্যাধি রয়েছে তা দূর হয়ে যাবে।
এর পাশাপাশি প্রতিনিয়ত আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করা যে হে আল্লাহ, তুমি আমাকে আমার আত্মার ব্যাধি থেকে পরিত্রাণ দাও। যেসব ব্যাধিতে আমি আক্রান্ত হয়ে আছি, সেগুলোকে চিহ্নিত করার তাওফিক দান করো।
উম্মতের মধ্যে সাহাবায়ে কেরাম (রা.) ও তাবেঈন থেকে বর্তমান যুগের বুজুর্গ পর্যন্ত, যিনি যা অর্জন করেছেন তা কেবল কোরআন ও সুন্নাহর নিয়ম অনুসরণ করেই অর্জন করেছেন। তবে এসব বুজুর্গরা যেমন নামাজ, রোজা, হজ, জাকাত ইত্যাদি আমলের প্রতি যত্নবান ছিলেন, তেমনি সত্যপথে চলা, ইখলাস বা নিষ্ঠার সঙ্গে আমল করা, বিনয়, ধৈর্য, শোকর, আল্লাহর ওপর আস্থা ও বিশ্বাস, দুনিয়াবিমুখতা ইত্যাদির প্রতিও অত্যন্ত যত্নবান ছিলেন। তাঁরা যেমন মিথ্যা, প্রতারণা, চুরি, অশালীন চলাফেরা ইত্যাদি গুনাহকে ভয় করতেন এবং তা থেকে বেঁচে থাকতেন, তদ্রুপ অহংকার ও গর্ব, অপরকে অপমান ও হেয় করা, ক্ষমতা ও সম্পদের মোহ, লোভ, কৃপণতা ইত্যাদি আধ্যাত্মিক রোগ ও গুনাহকেও হারাম মনে করতেন এবং তা থেকে বেঁচে থাকার সর্বাত্মক চেষ্টা করতেন।