আমার শ্বশুর: মাওলানা নুমান (রহিমাহুল্লাহ)

Published: 24 May 2023

মুজিবুর রহমান

১৬ই মে ২০২৩ রাত ৮:২৫ মিনিটে, আমারশ্বশুর লন্ডনের নিউহ্যাম ইউনিভার্সিটি হাসপাতালে মারা যান। ইন্না লিল্লাহি ওয়াইন্না ইলাইহি রাজিউন

তিনি ছিলেন, হাফেজ মাওলানা আজাদউদ্দিন নুমান গোলমোকাপনি।  তিনি দীর্ঘ ৩০ বছর ধরে লন্ডনের আইল অফডগস-এর মদিনা মসজিদের প্রধান ইমামও খতিব ছিলেন।  তার পিতা বাংলাদেশের একজন সুপরিচিত আলেম ছিলেন, মহিউসুন্নাহ হযরত মাওলানা ফখরুদ্দিনসাব (রহিমাহুল্লাহ), বাংলাদেশের সিলেটের ওসমানী নগরের গোলমোকাপনে ৭০+ বছর বয়সী জামিয়া দারুস-সুন্নাহ মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠাতা।  তাঁর শ্বশুর শায়খুলহাদিস মাওলানা হুসাইন আহমদ বারাকুতি (রহিমাহুল্লাহ),যিনি বাংলাদেশের সিলেটের গোলাপগঞ্জের একজন সুপরিচিত আলেম ছিলেন।

তিনি অল্প কথার মানুষ হলেও নীতিবান, স্বাধীন, জ্ঞানী ও গুনী ছিলেন।  তিনি তাঁরগ্যাজেট এবং মিষ্টি পছন্দ করেছেন।  তিনি নাতি-নাতনিদের ভালোবাসতেন এবং তাদের হাতে মিষ্টি তুলে দিতেন!

তিনি দরিদ্র ও অসহায়দের  জন্য অত্যন্তচিন্তাশীল ছিলেন, বিশেষ করে যারা বাংলাদেশের, তাদের সহায়তা প্রদানের জন্য বিশেষ উপায় স্থাপন করেছিলেন।  বার্ধক্য, অসুস্থতা, শয্যাশায়ী হওয়া সত্ত্বেও তহবিল সংগ্রহ এবং অভাবীদের মধ্যে তাবিতরণ নিশ্চিত করতে তৎপর ছিলেন।

মানুষজন এখনো মনে রেখেছে কোরআন তেলাওয়াতের ক্ষেত্রে উনার স্মৃতিশক্তি কতপ্রখর ছিল। তিনি কোন ভুল না করেতারাবীহ ইমামতি করতেন। আমি তার পিছনে তারাবীহ নামায পড়ার সম্মান পেয়েছি।তাজবীদ গুলোকে কেন্দ্র করে স্পষ্ট ভাবে তিলাওয়াত করতেন।৩০ বছরের অধিক সময় ধরে তারাবিহের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন এবং ৯০ দশকের গোড়ারদিকে ইস্ট লন্ডন মসজিদের ইমাম ছিলেন।

এরপর তিনি আইল অফ ডগসে মদিনাজামে মসজিদে ইমাম নিযুক্ত হন। সেইসময়ে ডকল্যান্ডের একমাত্র মসজিদ, যা একটি পাব থেকে মসজিদে  রূপান্তরিত হয়েছিল। যারা উনাকে চিনতেন,এই


রকমযাদের সাথেই কথা বলেছি উনারা প্রায়ই বলতেন যে, এই মসজিদের জন্য তিনিকতটা নিবেদিত প্রাণ ব্যক্তি ছিলেন।উনার অনেক ছাত্রদের সাথে জানাযায় দেখা হয়েছিল এবং বার বার বলছিল কিভাবে উনার সাথে তাদের আরবির হাতে খড়ি (আলিফ,বা,তা) হয়েছিল।

এসবেরও আগে, তিনি যুক্তরাজ্যেরস্কানথর্পে একজন ইমাম ছিলেন এবংযাদেরকে সেইসময়  পড়িয়েছিলেন তারাএখন বাবা-মা এমনকি দাদা-দাদিও হয়েউঠেছেন! তিনি গত বছর কয়েক দিনেরজন্য স্কানথর্পে গিয়েছিলেন, লন্ডনের বাইরে  এটাই ছিল তাঁর শেষ সফর। সেখানেতিনি তাঁর ছাত্র, তাদের পরিবার এবং আত্মীয়দের সাথে সাক্ষাৎ করে আসেন।

২০১৯ সালের রমজানে আমি খাতমুল কোরআনে অংশ গ্রহণ করার তাগিদ পেয়েছি। গভীর রাতে থাকা সত্ত্বেও, আমি মসজিদে গিয়ে নামাযে অংশগ্রহন করতাম।আলহামদুলিল্লাহ এবং কদরুল্লাহ এটাইছিল উনার নেতৃত্বে শেষ তারাবীহ, কারণকোভিড-১৯ এর পরেই আঘাত হেনেছিল।  তিনি সবসময় দু’আর আগে একটি সুন্দরবক্তৃতা দিতেন এবং তার সাথে তারাবীহ পরিচালনাকারী তরুণ হাফেজদের প্রশংসা করতেন।

আমি এবং আমার স্ত্রী সে বছর হজ্বে গিয়েছিলাম। তিনি এবং আমার শাশুড়ি আমাদের বিদায় দিতে ভোর ৫টার দিকে আমাদের বাড়িতে আসেন।  তিনি আমাদের অনেক পরামর্শ দিয়েছিলেন পাশাপাশি দুআ করতেও উৎসাহিত করেছিলেন।

আলহামদুলিল্লাহ তার ছোট মেয়ের সাথে আমার বিয়ে হয়েছে। তিনি আমাদের নিকাহসেই মসজিদে করিয়েছিলেন যেখানে তিনিইমাম ছিলেন। আলহামদুলিল্লাহ এই শুভকাজের জন্য আমরা উনার থেকে ভালো কাউকেই পেতাম না। আমি তাঁর কাজদেখে  বিবাহ সম্পর্কে অনেক কিছু শিখেছি। উনি আমার শাশুড়ির সাথে যেমন  আচরণ করতেন তা অনেক সুন্দর ছিল। তাদের অনেক বয়স সত্ত্বেও একজন আরেকজনের সাথে খুনসুটি করতেন এবং এমন এক দম্পতি ছিলেন যারা কখনো একে অপরের প্রতি ভালবাসা এবং যত্ননেওয়া থেকে বিরত থাকেননি, যা এখন আমাদের অনেক যুবক দম্পতির মাঝেও দেখা যায় না।

তিনি এমন একটি পরিবার থেকে উঠে এসেছেন যেখানে অনেক জ্ঞানী গুনী ব্যক্তিআর হাফেজরা ছিলেন। আমি এগুলির কোনটি অর্জন করতে না পারলেও, তিনি আমাকে কখনই ছোট করেননি। একবার কেউ তাকে বলেছিল যেতার দামান্দ (আমি) আলিম নন;  তিনি উত্তর দিয়েছিলেন, ”আচ্ছা সে ​​একজন আলিমের মতো পোশাক পরে!” আমি প্রায়ই ভাবি কেন তিনি নিজের পটভূমি থাকা সত্ত্বেও আমাকে তাঁর মেয়ের জন্য বেছে নিলেন। আলহামদুলিল্লাহ, বিয়ের আগেও আমি প্রায়ই উনার পিছনে নামাজ পড়তাম,এবং তখনও জান তাম না আমি উনার জামাতা হবো।

তিনি কখনো আমাদের বিয়েতে হস্তক্ষেপ করেননি।  আমার স্ত্রীর সাথে তার একটি সুন্দর সম্পর্ক  ছিল।  তিনি তাকে সুন্দর  একটি নাম ধরে ডাকতেন এবং রাত গভীর হলেও তার সাথে প্রতিদিন কথা বলতেন।

কোভিড পজিটিভ হওয়ার পর থেকেই তারস্বাস্থ্য খারাপ হতে শুরু করে। এর সাথে একাধিক হাসপাতালে যাওয়া  এবং ডাক্তারদের অ্যাপয়েন্টমেন্ট শুরু হয়। ২০২২ সালের জুলাই থেকে তিনি লিভারের রোগের জন্য হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন। স্বাস্থ্য ভালো না জেনেও কখনো  অস্থিরহননি। মৃত্যু নিয়েও চিন্তিত ছিলেন না। তিনি সর্বদা আল্লাহর প্রশংসা এবং আল্লাহর উপর ভরসা করতেন।উনার সামনে থেকে বিদায় বেলায় সবাইকে সবসময়ই ‘ফি আমানিল্লাহ’ বলার অভ্যাস ছিল উনার। মারা যাওয়ার আগের দিন,আমাকে এবং আমার স্ত্রীকেও অন্তত ৫/৬  বার বলেছিলেন। তিনি আমাদের জন্য দোয়া  করেছেন জেনে আমি অনেকবল পেয়েছি এবং এটাই আমাদের তাঁরকাছ থেকে শুনা শেষ কথা ছিল।

হাসপাতালে তাকে দেখার জন্য আমাদের ডাকা হয়েছিল, কারণ উনার শারীরিক অবস্থা ভাল ছিল না।ডাক্তারদেরও কোন চিকিৎসা করার মতো অবস্থা ছিলনা, শুধুমাত্র উনাকে একটু আরাম দেয়ারচেষ্টা করছিলো তারা। বুঝতেই পারছেন এইসময়টা একটা পরিবারের জন্য কতটাকঠিন ছিল, কিন্তু আমি তাকে সাধুবাদ জানাই এমন সন্তান সন্ততি লালন-পালনকরার জন্য এবং এমন একজন স্ত্রী রেখে যাওয়ায় জন্য যারা সকলেই আল্লাহর উপর  তাওয়াক্কুল ছিলেন। এটা ছিল আল্লাহর কুদরতি, হাসপাতালে থাকার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে তিনি আল্লাহর কাছে ফিরে যাবেন।

তিনি যখন শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তখন আমি উপস্থিত ছিলাম। তাঁর নাড়ি চেককরে, শ্বাসকষ্টের কোনো চিহ্ন খুঁজে না পেয়েহতভম্ব হয়ে পড়েছিলাম, তবুও বুঝলাম তিনি চলে গেছেন। পরে চিকিৎসক এসেতার মৃত্যু নিশ্চিত করেন।

আমার শ্বশুরের গোসলে শরীক হওয়ার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল। খুব খারাপ লেগেছিল যখন উনাকে গোসল পরিচালনা কারীদের সাথে গোসলের রুমে শোয়ানো অবস্থায় দেখেছিলাম। উনারা তাঁকে খুবসুন্দর করে এবং অনেক মর্যাদার সাথে গোসল করিয়ে দিয়েছিলেন। আমি তাঁর ছেলের সাথে তাঁকে কবরে নামানোর জন্যও গিয়েছিলাম। সেই কবরে  অনেক শান্তিঅনুভব করেছিলাম। আমিও এই রকমকবরে আসব, আমার নিজের সময় নিয়েচিন্তা করলাম। এটা ছিল কারও কবরে নামার আমার প্রথম অভিজ্ঞতা  সুবহানআল্লাহ।

তিনি একজন ভাল মানুষ ছিলেন। তারসাথে পরিচিত হওয়ার যদিও ৫ বছর (তিনি মে মাসে মারা গেছেন, একই মাসে আমি ২০১৮ সালে বিয়ে করেছি), ছিল তা স্বত্তেও আমি আল্লাহকে ধন্যবাদ জানাই আমাকে এই মহান ব্যক্তির পরিবারের অংশ হতে দেওয়ার জন্য।  বিবাহের মাধ্যমে আমাদের একটি পারিবারিক বন্ধন হয়েছে এবং ইনশাআল্লাহ তা পরকালে জান্নাতুল ফেরদাউসে আমাদের পরিচিতির কারণহবে, আল্লাহর রহমতে।

তার উপর আল্লাহর ফযল ও রহমতনাজিল হোক।

আল্লাহ তায়ালা তাঁর গুনাহ সমূহ  মাফকরুন, তাঁর মর্যাদা উন্নীত করুন, তাকে জান্নাতুল ফেরদৌস দান করুন, তাঁর কবরকে জান্নাতের বাগান থেকে একটি বাগান করুন এবং আল্লাহ তায়ালা চিরকাল তাঁর প্রতি সন্তুষ্ট থাকুন।

আল্লাহ তায়ালা উনার পরিবারকে ধৈর্য্যদান করুন এবং আমাদের সকলকে এটিকেশিক্ষা হিসাবে গ্রহণ করার এবং আমাদের পরবর্তী মৃত্যুকে স্মরণ করার তৌফিক দানকরুন। আমীন।