জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় ইসলাম
মুহাম্মদ মনজুর হোসেন খান
ইসলাম বলছে, তুমি যদি মনে কর আজই কেয়ামত হবে, তারপরও একটি গাছ লাগাও। জলবায়ু পরিবর্তনে পরিবেশের ওপর বিরূপ প্রভাব ও এর দায়-দায়িত্ব নিয়ে উন্নত ও অনুন্নত দেশগুলোর মধ্যে ব্যাপক বিতর্ক থাকলেও এটি যে এখন বিশ্বের প্রধান সমস্যা তা নিয়ে কারও দ্বিমত নেই।
বর্তমানে পরিবেশগত বিপর্যয়ের নানা অবস্থার মধ্যে আছে দূষণ, খাদ্যে বংশগত পরিবর্তনের প্রভাব এবং বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি। আর এগুলোর জন্য দায়ী হচ্ছে জলবায়ু পরিবর্তন। জলবায়ু পরিবর্তনের বলি হচ্ছে পৃথিবীর মানুষ এবং উদ্ভিদ।
পবিত্র কুরআনের সূরা আনআমের ১৪১ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেন, ‘আর তিনিই সৃষ্টি করেছেন এমন বাগানসমূহ যার কিছু মাচায় তোলা হয় আর কিছু তোলা হয় না এবং খেজুর গাছ ও শস্য, যার স্বাদ বিভিন্ন রকম, জায়তুন ও আনার যার কিছু দেখতে এক রকম, আর কিছু ভিন্ন রকম।
তোমরা তার ফল থেকে আহার কর, যখন তা ফলদান করে এবং ফল কাটার দিনেই তার হক দিয়ে দাও। আর অপচয় কর না। নিশ্চয়ই তিনি অপচয়কারীদের ভালোবাসেন না।’
আল্লাহর রাসূল (সা.) বলেন, ‘পৃথিবী একটি মসজিদ।’ মুসলিমরা যখন পৃথিবীকে মসজিদ মনে করে, তখন এটি পরিষ্কার ও শান্তিময় থাকে। একটি ক্ষণস্থায়ী জীবনের পথিক হিসাবে আমাদের স্রষ্টা আমাদের জন্য কিছু নির্দেশনা দিয়েছেন এবং পরিবেশকে রক্ষার জন্য কতগুলো প্রকৃতিগত পদ্ধতি বাতলে দিয়েছেন। মানুষ পৃথিবীতে আল্লাহর প্রতিনিধি।
আর এ পৃথিবীকে রক্ষার দায়িত্বও তাদের ওপর ন্যস্ত করেছেন। বর্তমানে পৃথিবীতে যে বিপর্যয় সৃষ্টি হয়েছে তার অন্যতম কারণ হলো-মানুষ আল্লাহকে ভুলে গেছে। তারা অবিশ্বাসী হয়ে অচেতন ও অবুঝ শিশুর মতো নিজেকেই নিজে আঘাত করছে এবং নিজেদের ধ্বংসের দিকে ধাবিত করছে।
পরিবেশের ওপর ইসলামের বিশ্বধারণা একটি এমন নীতি, যার কারণে ইসলাম দুনিয়াতে বিস্তার লাভ করেছে। অমুসলিমরা পরিবেশের সঙ্গে মুসলমানদের সৎ ও সহনশীল সম্পর্ক অবলোকন করতে পেরেছে এবং সেটিই তাদের ইসলামে দীক্ষিত হতে অনুপ্রাণিত করেছে।
ইসলামের সামাজিক ন্যায়নীতির যে ধারণা এটা মুসলমানরা শুধু মানুষের ক্ষেত্রেই বিবেচনা করেনি, বরং মুসলিম এলাকার প্রাণী, জীবজন্তু এবং উদ্ভিদের বেলায়ও প্রদর্শন করেছে। প্রতিটি বিষয়ে ইসলামের রয়েছে সুস্পষ্ট অবস্থান। আর ইসলামই হচ্ছে প্রথম ধর্ম ও সংবিধান যা দুনিয়ার অধিকার সম্পর্কে ঘোষণা দিয়েছে। আর পরিবেশ রক্ষার বিষয়টি পবিত্র কুরআন ও হাদিসের বিধান ও আইন দ্বারা সংরক্ষণ করেছে।
মহানবি (সা.) মক্কা ও মদিনাকে ইতিহাসে প্রথম প্রাকৃতিক সুরক্ষার বিষয় বলে ঘোষণা দিয়েছেন। এখানকার অধিবাসী এবং পর্যটকদের আঘাত করতে, দুর্ব্যবহার করতে নিষেধ করেছেন। মহানবি (সা.) বলেছেন, ‘(অকারণে) যদি কেউ একটি গাছ কাটে, আল্লাহ তাকে জাহান্নামে নিপতিত করবেন।’
পরিবেশগত সচেতনতা ইসলামে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আল্লাহ ও রাসূল (সা.) মুসলিমদের আধ্যাত্মিক এবং শারীরিকভাবে শান্তির সঙ্গে বসবাসের তাগিদ দিয়েছেন। ইসলাম প্রতিটি কাজ এবং বিধানে আল্লাহ মানুষকে দুনিয়ার বিভিন্ন উপকরণ যতটা সম্ভব কম ব্যবহার করতে এবং ভোগের ইচ্ছাকে যতটা পারা যায় নিয়ন্ত্রণ করতে নির্দেশ দেয়।
আর একজন মুসলিম যখন জানতে পারছে যে, মানুষের জীবন ক্ষণস্থায়ী, এমনকি একটি উড়ন্ত ডানার মতো, তখন সে পৃথিবীর সবকিছু ব্যবহারের ক্ষেত্রে খুব সচেতন হয়। আর সে সৎ জীবনযাপন ও ভালো কাজের মাধ্যমে আল্লাহর রহমত পাওয়ার চেষ্টা করে।
বর্তমান বিশ্বে ভোগবিলাসের এক উৎকট প্রতিযোগিতা চলছে বিভিন্ন দেশে। আর এতে দেশে দেশে তৈরি হচ্ছে তীব্র রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক সমস্যা। এ কথা অনেকেই জোর দিয়ে বলার চেষ্টা করছেন, এসব সমস্যার সমাধান একটাই। আর তা হলো, পরিবেশের যথাযথ সংরক্ষণ এবং একটি সহনশীল এনার্জি নীতিমালার প্রণয়ন এবং বাস্তবায়ন।
আল্লাহর নবি মুহাম্মাদ (সা.) সেই চৌদ্দশ বছর আগে উন্নত পরিবেশের নীতি ও শিক্ষার কথা ঘোষণা করেন। পরবর্তী সময়ে মুসলিম পণ্ডিত এবং শাসকরা সেই নীতিমালার আলোকে পরিবেশকে ঠিক রাখার যাবতীয় কৌশল গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করেন। উদাহরণ হিসাবে প্রাণীদের অধিকারবিষয়ক আল-সাখায়ির নীতির কথা বলা যেতে পারে। সাম্প্রতিককালেও পরিবেশের ওপর মুসলিমরা নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন।
১৯৯২ সালে ‘ইসলাম অ্যান্ড ইকোলজি’ শীর্ষক একটি গবেষণাপত্র প্রকাশ করেন ব্রিটিশ-পাকিস্তান এয়ারফোর্সের অফিসার ফাজলুন খান। তিনি ১৯৯৪ সালে ‘ইসলামিক ফাউন্ডেশন ফর ইকোলজি অ্যান্ড দ্য এনভায়রনমেন্ট’ নামে একটি পরিবেশবিষয়ক সংস্থা প্রতিষ্ঠা করেন।
এ প্রতিষ্ঠানের কাজ হলো- পরিবেশের ওপর ইসলামের শিক্ষার সম্প্রসারণ, এ শিক্ষার আলোকে মানুষের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি, শিক্ষার উপকরণ তৈরি এবং তা প্রচার ইত্যাদি।
আমরা জানি, ধর্ম মানব জীবনের ওপর একটি নৈতিক প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম। এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, ধর্ম সংস্কৃতি ও সভ্যতার একটি শক্ত ভিত্তি রচনা করতে পারে। তাই বর্তমানে বিশ্ব এমন একটি সুন্দর আদর্শের প্রত্যাশা করছে যার ওপর একটি নতুন এবং সুন্দর সভ্যতার জন্ম হতে পারে। ইসলাম একটি উন্নত বুদ্ধিবৃত্তিক এবং বিজ্ঞানসম্মত ধর্ম।
কুরআন ও হাদিসে পরিবেশ রক্ষায় ইসলামের বাস্তব এবং বিজ্ঞানসম্মত নীতিমালা রয়েছে। ইসলামের এ শিক্ষা মুসলমানরা তাদের দৈনন্দিন জীবনযাত্রায় পালন করে থাকে। মুসলমানরা তাদের দৈনন্দিন জীবনে পাঁচবার ওজু করেন এবং শরীর পবিত্র করেন। এতে পানি ব্যবহৃত হয়। কিন্তু ইসলাম এক্ষেত্রে অতিরিক্ত পানি ব্যবহারকে নিষিদ্ধ করেছে। মুসলমানরা প্রতিটি কাজে আল্লাহকে ভয় করে চলেন। আল্লাহ অপচয় এবং অপব্যয়কে নিষিদ্ধ করেছেন।
ফলে প্রাকৃতিক সম্পদ অতিরিক্ত ব্যবহার করা এবং নষ্ট না করার কারণে পরিবেশ ভালো থাকে। ইসলাম পানির উৎসে মলত্যাগ করে পানিকে নষ্ট কিংবা দূষিত করাকে নিষেধ করে পরিবেশের পক্ষে নীতি গ্রহণ করেছে। ইসলাম বলছে ‘তুমি যদি মনে কর আজই কেয়ামত হবে, তারপরও একটি গাছ লাগাও।’ সবুজ পরিবেশ রক্ষায় এর চেয়ে উত্তম আদর্শ আর কি হতে পারে!
শাব্দিক অর্থে ইসলাম মানে শান্তি ও সমৃদ্ধি। তাই ইসলাম শাশ্বত এবং ঐতিহাসিকভাবে সমাজ ও দেশ থেকে অশান্তি দূর করে শান্তি রক্ষা ও প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা পালন করছে। পরিবেশের বেলায়ও একই অবদান রাখছে ইসলাম।
লেখক : গবেষক, কলামিস্ট