যেভাবে সাঈদীর উত্থান

Published: 17 August 2023

বিশেষ সংবাদদাতা :


নিজ এলাকা পিরোজপুরে প্রথম ওয়াজ মাহফিলে বক্তব্য রেখেছিলেন মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী। এরপর থেকে নিজ জেলার পাশাপাশি দেশের বিভিন্ন এলাকায় ওয়াজ নসিহত করতে থাকেন। ১৯৮৫ সালে ‘ইসলামী সমাজ কল্যাণ পরিষদ’ নামে সংগঠনের ব্যানারে চট্টগ্রামের প্যারেড মাঠে ৫ দিনব্যাপী একটি তাফসির মাহফিল অনুষ্ঠিত হয়। সেই সম্মেলনে তাফসির পেশ করেন সাঈদী। সেখানে হাজার হাজার মানুষ তাফসির শুনেন। মূলত সেই সম্মেলনের পর থেকে আর পেছনে তাকাতে হয়নি তাকে। দেশ-বিদেশে ছড়িয়ে পড়ে তার নামডাক। আর তার এই খ্যাতি ও জনপ্রিয়তাকে পুঁজি করে এই অঞ্চলে প্রভাব তৈরি করে জামায়াত।
নগরের চকবাজার এলাকায় অবস্থিত চট্টগ্রাম সরকারি কলেজের মাঠটি মূলত প্যারেড ময়দান নামে পরিচিত। বৃটিশ আমলে এই মাঠে গোরা বাহিনী প্যারেড বা কুচকাওয়াজ করতো। যে কারণে এটিকে ‘প্যারেড ময়দান’ বলা হতো।

চকবাজার, চন্দনপুরা, কাপাসগোলা, শুলকবহর, পাঁচলাইশ এলাকার বাসিন্দাদের কাছে বুকভরে শ্বাস নেয়ার এক টুকরো মুক্তাঙ্গন এটি।

এখানে বয়স্করা যেমন হাঁটতে আসেন, তেমনি তরুণ-কিশোররাও আসেন খেলাধুলা করতে। তবে জামায়াতসহ ধর্মপ্রাণ মানুষের একটি বড় অংশের কাছে এটি সাঈদীর তাফসিরুল কোরআন মাহফিলের মাঠ নামে পরিচিত। প্রতি বছর ৫ দিনব্যাপী এখানে চলতো মাহফিল। ২০০৬ সাল থেকে এখানে আর সাঈদীর মাহফিল না হলেও এই প্যারেড মাঠ এখনো ‘তাফসির মাঠ’ বলে পরিচিত।
জানা যায়, প্যারেডের ময়দানে সাঈদীর এই মাহফিলে কয়েক লাখ মানুষ অংশ নিতো। জামায়াত সমর্থকদের পাশাপাশি চট্টগ্রাম ও পার্শ্ববর্তী জেলা থেকে দলে দলে ধর্মপ্রাণ মানুষ ছুটে আসতেন এই মাহফিলে। জামায়াতবিরোধী বলে পরিচিত কওমি ও তরিকতপন্থি মানুষজনও সেই মাহফিলে অংশ নিতেন। ৫ দিনব্যাপী এই মাহফিল সাঈদীর আখেরি মোনাজাতের মাধ্যমে শেষ হতো। সেই মোনাজাতে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সিনিয়র নেতারাও শরিক হতেন। সাবেক এক ছাত্রলীগ নেতা মানবজমিনকে বলেন, ‘আমাদের বাপ-দাদারা সবাই আওয়ামী লীগ। আওয়ামী লীগ করার কারণে আমার পরিবার বিভিন্নভাবে হয়রানির শিকার হয়েছিল। আমি ছোটবেলায় আব্বার সঙ্গে দুইবার প্যারেড মাঠে সাঈদীর মাহফিলে গিয়েছিলাম। আব্বা সাঈদীর আখেরি মোনাজাত সহজেই মিস করতে চাইতেন না।’

দুবাই প্রবাসী ফটিকছড়ির বাসিন্দা মোহাম্মদ হুমায়ুন রশীদ বলেন,‘কৈশোরে বছরের একটা সময়ের জন্য অপেক্ষায় থাকতাম, কখন চট্টগ্রাম প্যারেড ময়দানে সাঈদীর মাহফিল হবে। নাজিরহাট-বিবিরহাট থেকে স্পেশাল বাস টেম্পু সার্ভিস দেয়া হতো। স্পেশাল বাড়তি ট্রেন শিডিউল থাকতো। জামায়াত, আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাসদ, বাসদ, বাম, ডান ৩৬ রকমের সকল দলের লোকজন দলে দলে ছুটে যেতো প্যারেড ময়দানে। এমনকি অন্য ধর্মাবলম্বীরাও যেতো। বছরের ওই একটা সময় সকলে রাজনৈতিক পরিচয় ভুলে শুধু কোরআনের বাণী শুনতে যেতো।’

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ২০ বছর ধরে চলা এই তাফসীর মাহফিলে অর্ধসহস্রাধিক অমুসলিম মুসলমান হয়েছিলেন। সাঈদীর এই মাহফিলকে ঘিরে এই এলাকায় জামায়াত শিবিরের আধিপত্য বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে গড়ে ওঠে বিভিন্ন সংগঠন। বিশেষ করে সাঈদীর মাহফিল আয়োজন করা সংগঠন ‘ইসলামী সমাজকল্যাণ পরিষদ’র ব্যানারে চট্টগ্রামে গড়ে ওঠে স্কুল, মাদ্রাসা, হাসপাতালসহ অর্ধশত প্রতিষ্ঠান। ২০০৬ সাল থেকে প্রশাসনের বাধায় সাঈদীর এই তাফসীর মাহফিল বন্ধ থাকলেও বিভিন্ন কার্যক্রম চালাচ্ছিল এই সংগঠন। তবে চলতি বছরের ৩০শে মে প্যারেড মাঠ সংলগ্ন এই সংগঠনের কার্যালয় গুঁড়িয়ে দেয় জেলা প্রশাসন। এদিকে গত সোমবার রাতে সাঈদীর মৃত্যুর খবর প্রচার হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পুরো চট্টগ্রামেই আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। মাঠে কেউ না আসলেও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে জামায়াত শিবির সমর্থকদের পাশাপাশি সাঈদী ভক্তরা শোক প্রকাশ করতে থাকেন। অনেকে সাঈদীর এই পরিণতির জন্য সরকারের বিরুদ্ধে নানা মন্তব্য করেন। এরমধ্যে মঙ্গলবার নগরের জমিয়তুল ফালাহ ময়দানে সাঈদীর গায়েবানা জানাজার ঘোষণা দেয়া হয়। তবে পুলিশের বাধায় শেষ পর্যন্ত এটি পণ্ড হয়ে যায়। সেখানে পুলিশের সঙ্গে বিচ্ছিন্নভাবে সংঘাতে জড়ায় জানাজা পড়তে আসা মুসল্লিরা। পরে সেখান থেকে ১৫ জনকে আটক করা হয়।

চট্টগ্রাম নগর শিবিরের সাবেক সভাপতি মোহাম্মদ জোবায়ের বলেন, ‘আমরা শান্তিপূর্ণভাবে গায়েবানা জানাজা পড়তে চেয়েছিলাম। তবে পুলিশ বিনা উস্কানিতে মুসল্লিদের ওপর হামলা চালিয়েছে ও নামাজ পড়তে দেয়নি। তাদের হামলায় বেশ কয়েকজন সাধারণ মুসল্লি আহত হয়েছে। আর অনেককে তারা আটক করে নিয়ে গেছে। আমরা আপাতত গায়েবানা জানাজা কর্মসূচি স্থগিত করেছি। এখন হুজুরের জন্য দোয়া মাহফিল কর্মসূচি নেয়া হয়েছে।’ জানা যায়, জমিয়তুল ফালাহ ময়দানে জানাজা না হলেও সাতকানিয়া, লোহাগাড়া, বাঁশখালী, বোয়ালখালীসহ বিভিন্ন স্থানে জানাজার নামাজ অনুষ্ঠিত হয়েছে। এরমধ্যে কক্সবাজারের চকরিয়ায় পুলিশের গুলিতে জানাজা পড়তে আসা এক বৃদ্ধের মৃত্যু হয়েছে।

চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের উপ-কমিশনার (দক্ষিণ) মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, আমরা সর্বোচ্চ সতর্ক অবস্থানে ছিলাম। এরমধ্যে তারা কোনো রকমের অনুমতি নেয়া ছাড়া কাজির দেউড়ি মোড়ে জমায়েত হতে থাকে। সেখান থেকে তারা পুলিশের ওপর হামলা চালায়। এতে পুলিশের কয়েকজন সদস্য আহত হয়। পরে বাধ্য হয়ে আমরা অ্যাকশনে যাই এবং জামায়াত শিবিরের কয়েকজনকে আটক করেছি।