বৃটেন কি ধীরে ধীরে  ইউরোপের উত্তর কোরিয়া হয়ে যাচ্ছে?

Published: 25 April 2024

 Dr Zaki Rezwana Anwar FRSA

দু’বছর আগে বৃটিশ সরকার রোয়ান্ডার সাথে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করেছিল যেটিতে উল্লেখ করা হয়েছিল, যারা অবৈধভাবে ইংলিশ চ্যানেল পাড়ি দিয়ে ইউকেতে আসবে তাঁদের একটি ওয়ান ওয়ে টিকেট কেটে কিগালিতে (রোয়ান্ডার রাজধানী) পাঠিয়ে দেওয়া হবে। পাঁচ বছরের এই চুক্তিতে বলা হয়েছে ইংলিশ চ্যানেল পাড়ি দিয়ে ইউকেতে আসা অভিবাসন প্রত্যাশীরা মধ্য আফ্রিকার দেশে রেফিউজি ষ্টেটাস পেতে পারে অথবা রোয়ান্ডা সরকার তাদের অন্য কোনো তৃতীয় নিরাপদ দেশে পাঠিয়ে দিতে পারবে। বৃটিশ সরকারের ভাষায় এই ব্যবস্থা নৌপথে বৃটেনে অবৈধ অভিবাসীদের আসা বন্ধ করবে।

আমাদের মনে থাকার কথা, ইংলিশ চ্যানেল পাড়ি দেওয়া বৃটেনে অভিবাসন প্রত্যাশীদের নিয়ে প্রথম ফ্লাইটটি ২০২২ সালের জুন মাসে রোয়ান্ডার উদ্দেশ্যে উড়ে যাওয়ার ঠিক আগে একেবারে নাটকীয়ভাবে রানওয়ে থেকে ঐ ফ্লাইটটি আইনী বাঁধার মুখে বাতিল করতে বাধ্য হয় বৃটিশ সরকার। ক্যাম্পেইনাররা বৃটেনের এই সিদ্ধান্তকে নির্দয়ের মত আচরণ বলে অভিহিত করে এবং সেই সাথে সুপ্রিম কোর্টও একে আইন বর্হিভূত বলে রায় দেন। শুধু তাই নয়, সেটি ইউরোপিয়ান কনভেনশন অফ হিউম্যান রাইটস এর লঙ্ঘন বলেও কথা উঠেছিল – বিশেষ করে যেখানে রোয়ান্ডা এমন একটি দেশ যেখানে মানবাধিকারের বিষয়টি একেবারেই গুরুত্ব পায়না। তারপর ঋষি সুনাক এমার্জেন্সি লেজিস্লেশনের মাধ্যমে ঘোষণা দেয় যে, রোয়ান্ডা একটি নিরাপদ দেশ!  ব্র্যাক্সিট পরবর্তী বৃটেনের ডমেষ্টিক ল’ অনুযায়ী এই অমানমিক কাজটি করতে পেরেছেন ঋষি সুনাক। বৃটিশ ডমেষ্টিক ল’ ঋষি সুনাককে সুরক্ষা দিলেও এখনো ক্যাম্পেইনাররা চাইলে এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে তারা কনজারভেটিভ সরকারকে আবারো কোর্টে নিতে পারে। জাতিসংঘের একজন বিশেষজ্ঞ বলেছেন, যে এয়ার লাইন্স এই অভিবাসন প্রত্যাশীদের বহন করে নিয়ে যাবে সেই এয়ার লাইন্সকে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্যে দায় নিতে হবে।

অবশেষে নানা সমালোচনা ও নানা আইনী বাধা পেরিয়ে পার্লামেন্টে রোয়ান্ডা বিল পাশ হয়ে গেছে। ঋষি সুনাকের ভাষায় আগামী ১০/১২ সপ্তাহের মধ্যেই প্রথম উড়োজাহাজটি বৃটেনে অভিবাসন প্রত্যাশীদের নিয়ে রোয়ান্ডার পথে রওনা দেবে। প্রশ্ন হচ্ছে, এটি কি আসন্ন নির্বাচনে সুনাকের ভাগ্য সুপ্রসন্ন করে দেবে? একটুকু বলা যায় যে, নির্বাচনের আগে সুনাকের জন্যে রোয়ান্ডা বিল-ই হচ্ছে মোটামুটি ভাবে শেষ কার্ড। অল্প সংখ্যক ভোটারের কাছে রোয়ান্ডা বিল ইস্যূ গুরুত্ব পেলেও বর্তমান জনমত জরীপে কনজারভেটিভ লেবার পার্টি থেকে এতটাই পিছিয়ে রয়েছে যে, এসব রোয়ান্ডা বিলে নির্বাচনের ফলাফলের তেমন যে কোনো পরিবর্তন হবেনা এটি বোঝার জন্যে গণিতবিদ হওয়ার প্রয়োজন পড়ে না। লেবার পার্টি ক্ষমতায় আসলে এ সিদ্ধান্তের উল্টো পথে হাঁটবে লেবার এবং এই রোয়ান্ডা বিলকে বাতিল করবে লেবার পার্টি।

কনজারভেটিভ সরকারের জন্যে যা চরম উদ্বেগের কারণ তা হচ্ছে, যদিও জরীপে দেখা গেছে যে, নির্বাচনী ইস্যূ কী কী তা জানতে চাইলে অনেকগুলো  ইস্যূর ভেতর অভিবাসন ইস্যূটি আসে, কিন্তু যখন আরো গভীরভাবে বিশ্লেষণ করা হয়েছে যে, কনজারভেটিভের ভোট কেন কমছে বা  ২০১৯ সালে যারা কনজারভেটিভকে ভোট দিয়েছিলেন তাদের অনেকেই কেন এখন আর কনজারভেটিভকে ভোট দিতে চান না, তখন এই প্রশ্নের উত্তরে জনগণ বলেছে, অর্থনৈতিক মন্দা, মর্গেজ সুদের হারের উর্ধ্বগতি, এন এইচ এস-এ চিকিৎসা সুবিধা পেতে বিলম্ব হওয়া, প্রয়োজনে পুলিশকে পাশে না পাওয়া – ইত্যাদি কারণে তাঁরা আর কনজারভেটিভকে ভোট দিতে চান না। তখন কিন্তু জীবন ধারণের জন্যে প্রয়োজনীয় বিষয়গুলো ছাপিয়ে অভিবাসন ইস্যূ সামনে আসে নি।

কনজারভেটিভ সরকারের জন্যে এখন সমস্যা হচ্ছে, সরকার যদি এন এইচ এস-এর ওয়েটিং লিষ্ট কমিয়েও ফেলে যেভাবে ন্যাশনাল ইন্সিওরেন্স কমিয়েছে তাহলেও ভোটাররা বলতেই পারে, যে সমস্যা কনজারভেটিভ সরকার নিজেই তৈরী করেছে, নির্বাচনের ঠিক আগ মুহূর্তে তার সামান্য নিরসন করে জনগণের কাছে ভোট চাওয়াটা জনগণের দৃষ্টিতে কনজারভেটিভের পক্ষ থেকে জনগণের কাছে অনেক বড় একটি চাওয়া। শেষ মুহূর্তে এসে সরকার ট্যাক্স একটু কমিয়েছে, অথচ তারাই ট্যাক্স বাড়িয়েছিল। সরকার তাদের টার্মের শেষে এসে বলছে এখন তারা নৌকা যোগে আসা অভাবাসন প্রত্যাশীদের  ব্যাপারে কাজ করছে অথচ তারা ক্ষমতায় থাকা অবস্থাতেই নৌকা করে আসা অভিবাসীদের সংখ্যা বেড়ে গিয়েছিল। গত ৪/৫ বছরে সরকারের কার্যকলাপের রেকর্ড এবং ফলশ্রুতিতে জনগণের ভোগান্তি ভোটাররা শেষ মুহূর্তে এসে ভুলে যাবেনা বা জনগণ আর সরকারকে ‘বেনিফিট অফ ডাউট’ দেবে বলে মনে হয় না।

ঋষি সুনাকের ভাষ্য অনুযায়ী, জুলাই মাসে আদৌ কোনো অভিবাসন প্রত্যাশী নিয়ে উড়োজাহাজ আকাশে উড়বে কিনা বা উড়লেও কতজন অভিবাসন প্রত্যাশীকে সত্যিকার অর্থে রোয়ান্ডা নিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে – এ বিষয়ে যথেষ্ট সন্দেহের অবকাশ রয়েছে। যদি ইউকেতে নির্বাচনের আগেই বহু সংখ্যক অভিবাসন প্রত্যাশীদের নিয়ে যাওয়া হয় এবং ঋষি সুনাক যদি দাবীও করেন যে নৌকা করে আসা অভিবাসন প্রত্যাশীদের ব্যাপারে জনগণকে দেওয়া তাঁর প্রতিশ্রুতি তিনি বাস্তবায়ন করেছেন – তারপরও নির্বাচনের পর কিয়ার ষ্টার্মারই হতে যাচ্ছেন ১০ নম্বর ডাউনিং স্ট্রিটের বাসিন্দা। ঋষি সুনাক যদি দাবীও করেন মে, তিনি অভিবাসন সংক্রান্ত তার পলিসির বাস্তবায়ন করেছেন তবুও সেই কৃতিত্ব নিয়েও জরীপে লেবার দলের সাথে কনজারভেটিভের যে পার্থক্য তা কাটিয়ে উঠা সম্ভব হয়ে উঠবে না।

আসলে অভিবাসন নিয়ন্ত্রণে আনা ঋষি সুনাকের উদ্দেশ্য নয়, উদ্দেশ্য হচ্ছে, নির্বাচনের আগে জরীপ মতে তলিয়ে যাওয়া অবস্থান থেকে একটু উত্তরণের চেষ্টা মাত্র। বৃটিশ জনগণের জীবন মান উন্নত করার কোনো সদ্বিচ্ছা এখানে নেই – এটি শুধুই নির্বাচনের আগে একটি  রাজনৈতিক কূটচাল। এই নির্বাচনে কনজারভেটিভের খেলা প্রায় শেষ।

এটাও সত্যি যে, বর্তমানে কনজারভেটিভ সংখ্যাগরিষ্ঠ হলেও হাউজ অফ কমন্সে কনজারভেটিভ কিন্তু বন্ধু হারা। সে কারণেই নির্বাচনে লেবার পার্টি যদি সংখ্যা গরিষ্ঠ বিজয় অর্জন না-ও করে সেক্ষেত্রে তারা লিবারেল ডেমোক্র্যাট ও এসএনপি-র সাথে মিলেও সরকার গঠন করতে পারবে। অন্যদিকে কনজারভেটিভ লিবারেল ডেমোক্র্যাক বা এস এন পি-র কাছ থেকে সেই সহযোগিতা আশা করতে পারেনা। সুতরাং লেবার সংখ্যা গরিষ্ঠতা না পেলেও কিয়ার ষ্টার্মার-ই যে পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী তা এক প্রকার বলে দেওয়া যায়। ঋষি সুনাক যে নির্বাচনে বিজয়ের আশায় রোয়ান্ডা বিল কার্ড খেলছে – এমনটিও নয়। কনজারভেটিভের একবারে যেন ভরাডুবি না হয় সেজন্যেই হয়তো ঋষি সুনাকের এই রোয়েন্ডা পরিকল্পনা বাস্তবায়নে তড়িঘড়ি চেষ্টা, বিশেষ করে কনজারভেটিভের যেসব ভোটার রিফর্ম ইউকে-কে সমর্থন দেওয়া শুরু করেছে তাঁদের নিজেদের দলে ফিরিয়ে আনার জন্যেই নির্বাচনের আগ মুহূর্তে রোয়েন্ডা পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে আদা জল খেয়ে লেগেছে ঋষি সুনাক।

রোয়ান্ডা বিলের পেছনে জনগণের করের টাকা থেকে  যে ৫০০ মিলিয়ন পাউন্ড খরচ হয়েছে সেই অর্থ বৃটেনে আবাসনের কাজে লাগানো যেতো অথবা স্বাস্থ্য খাতে ব্যবহার করা যেত। এর বাইরেও বৃটিশ জনগণের প্রদত্ত ট্যাক্স থেকে লক্ষ লক্ষ পাউন্ড খরচ হবে  প্রত্যেক অভিবাসন প্রত্যাশীর  জন্যে । এই যে, আমাদের প্রদত্ত ট্যাক্সের অর্থ রোয়ান্ডাতে পাঠানো হবে এটার অডিট-ই বা করবে কে?

বাস্তব সত্য হল,বিশাল বয়োবৃদ্ধ জনগোষ্ঠীর দেশ বৃটেনে ট্যাক্স কমিয়ে ও একই সাথে অভিবাসন কমিয়ে বৃটেনের অর্থনীতির চাকা কে সচল রাখা দুরূহ কাজ।

ঋষি সুনাকের ভাষ্য অনুযায়ী জুলাই থেকে অভিবাসন প্রত্যাশীদের রোয়ান্ডা পাঠানো শুরু হলেও নির্বাচনের আগে  বড় জোর কয়েক শ’ অভিবাসন প্রত্যাশীকে পাঠানো হবে যেখানে  শুধু গত বছরেই ৩০ হাজার অভিবাসী নৌকা যোগে বৃটেনে এসেছে এবং তার আগের বছর ৪৫ হাজার অভিবাসী নৌকা যোগে বৃটেনে এসেছে।

পৃথিবী জানে কোনো কারণ দর্শানো ছাড়াই কত সাংবাদিক রোয়ান্ডার জেলে বন্দী রয়েছেন‌। বৃটিশ সরকার যদি সত্যিই  মনে প্রাণে বিশ্বাস করত যে রোয়ান্ডা একটি নিরাপদ দেশ তাহলে এই চুক্তি স্বাক্ষরের পরেও কেনো  জীবন নাশের হুমকির মুখে রোয়ান্ডার অভিবাসীকে বৃটেনে আশ্রয় নিতে হয়?

রোয়ান্ডায় সরকারের সমালোচনা করা, এমন কি অরাজনৈতিক লোকজনও মন খুলে কথা বলতে পারেনা জেলের ভয়ে। রোয়ান্ডার বিখ্যাত গায়ক কিজিটো মিহিগো এক সময়ে সরকার পক্ষের খুবই  সুনজরে ছিল কিন্তু যখন তিনি তাঁর গানে রোয়ান্ডার গণহত্যার কথা বলেছেন তখনই তাঁকে জেলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে এবং পরবর্তীতে তিনি আত্মহত্যা করেছেন বলে তাঁর মরদেহ জেল থেকে বের করা হয়েছে। খুব বেশী দিন আগের কথা নয়, একজন উর্ধ্বতন বৃটিশ কর্মকর্তা বলেছিলেন, রোয়ান্ডায় মানবাধিকার বলতে কিছু নেই। তিনি রোয়ান্ডায় গুম ও আইন বহির্ভূত হত্যার কথাও উল্লেখ করেছিলেন। তবে স্যুয়েলা ব্রেভারম্যান রোয়ান্ডার সাথে চুক্তি স্বাক্ষরের পর থেকেই বৃটিশ সরকারের সুর পাল্টে যায়। যে দেশের প্রেসিডেন্ট ২০১৭ সালে অবিশ্বাস্য ৯৯% ভোট পায় এবং এই জুলাই মাসের নির্বাচনে তিনি চতুর্থবারের মত প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হতে যাচ্ছেন সেই রোয়ান্ডা একটি একদলীয় স্বৈরাচারী রাষ্ট্র যেখানে রাষ্ট্র প্রধান বিরোধীদলীয় নেত্রীকে ৮ বছর জেলে বন্দী করে রেখেছিলেন।

অষ্ট্রেলিয়া নারু দ্বীপে যেভাবে অভিবাসীদের নির্বাসিত করে রেখেছে, অভিবাসন প্রত্যাশীদের প্রত্যাশীদের নিয়ে অনেকটা  তেমন একটি ঘটনার পুনরাবৃত্তি করতে যাচ্ছে বৃটেন। ছোটবেলা থেকে বৃটেনকে একটি মানবিক দেশ হিসেবেই জানতাম। বিশ্ববাসী যখন শোনে বৃটেন বলছে রোয়ান্ডা একটি নিরাপদ দেশ এবং যখন বৃটেনে অভিবাসন প্রত্যাশীদের রোয়ান্ডার মত দেশে পাঠিয়ে দেবার হুমকি দেওয়া হয়, তখন বৃটেন সম্পর্কে বিশ্বের কী ধারণ হয়? রোয়ান্ডা বিলের আইনে পরিণত হতে যাওয়ার ঘটনায় বিশ্বের কাছে ইউকের মানবিক দেশ হিসেবে যে সুনাম ছিল তার উপর একটি কালিমা পড়ে গেল।  কনজারভেটিভের রোয়ান্ডা স্কীম ব্র্যাক্সিট বৃটেনের অধোগমনের  আরো একটি মাইল ফলক। ইদানিং মনে এ প্রশ্নটির উদয় হয় – তবে কি ইউকে ধীরে  ধীরে ইউরোপের উত্তর কোরিয়া হয়ে যাচ্ছ?

………………………………………………………………………..

লেখক Dr Zaki Rezwana Anwar FRSA, MBBS, DTM&H, MS & PhD একজন চিকিৎসক, জনপ্রিয় সিনিয়র সংবাদ পাঠক ও কলামিস্ট।