স্থানীয় নির্বাচনে কনজারভেটিভের ভরাডুবি হলে কি সাধারণ নির্বাচনের তারিখ এগিয়ে নিয়ে আসবেন ঋষি সুনাক?
Dr Zaki Rezwana Anwar FRSA
অনেকে যা ভাবছেন তার চাইতে গুরুত্বপূর্ণ এবারের স্থানীয় নির্বাচন। ১০জন মেট্রো মেয়ার; প্রায় ৩০০০ জন কাউন্সিলর (বাউন্ডারি বদল হওয়াতে কাউন্সিলরের সংখ্যা বেড়ে গেছে); ৩৭ জন পুলিশ এন্ড ক্রাইম কমিশনার; সেই সাথে ২৫ জন লন্ডন এসেম্বলির সদস্যকে নির্বাচিত করা হবে ২ মে ২০২৪ সালের নির্বাচনে। এছাড়া ব্ল্যাকপুল সাউথে সংসদীয় উপনির্বাচন তো রয়েছেই। আমাদের মনে রাখতে হবে, এই ১০টি মেয়ারাল নির্বাচনের গুরুত্ব অনেক বেশী, কারণ নির্বাচিত এই ১০ জন মেয়ার মিলে প্রায় ২৫ বিলিয়ন পাউন্ডের দ্বায়িত্ব পাবেন যা একটি বিরাট বিষয় বটে।
ঋষি সুনাক যে এই নির্বাচনকে খুব গুরুত্ব দিচ্ছেন তা বোঝা যায়। গত দু’সপ্তাহে বিভিন্ন অঞ্চলে তাঁর সফর বেড়ে গিয়েছে। তিনি যে ক্যাম্পেইন করছেন ঠিক তা নয়, তবে বক্তৃতা দেওয়ার সংখ্যা বেড়ে গিয়েছে। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে সব মিলিয়ে যত বক্তব্য তিনি দিয়েছেন তার একটি বড় অংশই দিয়েছেন গত দু’সপ্তাহে। ঋষি সুনাক ডিসেবিলিটি বেনিফিট তথা সীক নোট নিয়ে কথা বলছেন, ইমিগ্রেশন ও রোয়ান্ডা বিষয় নিয়ে কথা বলছেন – অর্থাৎ তিনি বোঝাতে চাইছেন যে তিনি তার পরিকল্পনা বাস্তবায়নে সচেষ্ট। এসবের পেছনে সাধারণ নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার লক্ষ্যে খুব গুছানো ক্যাম্পেইন কিন্তু লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। কেন যাচ্ছে না- তার কারণ নিশ্চয়ই আমরা দেখব আমরা এই আলোচনার শূন্যের দিকে।
২০২৪ সালের আগে ২০২১ সালে স্থানীয় নির্বাচনের কথা আমাদের মনে থাকার কথা। তবে ২০২১ সালের রাজনৈতিক মুডের সঙ্গে ২০২৪ সালের রাজনৈতিক মুডের তুলনা করলে চলবেনা। ২০২১ সালে বরিস জনসন ক্ষমতায় থাকাকালে এমন কি লাল দেয়ালও নীল হওয়ার কারণ ছিল ভ্যাক্সিন রোল আউট। এটি সত্যি যে ভ্যাকসিন ও করোনায় অর্থনৈতিক প্রনোদোনা ভোটের ব্যাপারে কনজারভেটিভের পক্ষে গিয়েছে, এমন কি ভ্যাকসিন সফলতায় জনগণের মন থেকে সরকারের করোনা মোকাবেলায় প্রথম দিকের ব্যর্থতাকেও ভুলিয়ে দিয়েছে । ছোটবেলা থেকে শুনে আসছি ‘All’s well that ends well.’ তা-ই হয়েছিল ২০২১ সালে।
অনেকেই এই লোকাল ইলেকশনের ফলাফলের উপর দৃষ্টি সাঁটিয়ে রেখেছে এই ভেবে যে, হয়তো এই স্থানীয় নির্বাচন থেকে আসছে জাতীয় নির্বাচন কেমন হবে সে বিষয়ে একটা উপসংহার টানার জন্যে। তবে দেখা গেছে প্রতি ৪/৫ জনে একজন স্থানীয় নির্বাচনে যেভাবে ভোট দেয় সাধারণ নির্বাচনে সেভাবে ভোট দেয়না। স্থানীয় নির্বাচনে সাধারণত লোকাল ইস্যূগুলো যেমন: আবর্জনা পরিষ্কার, রাস্তাঘাট মেরামত – এ ধরনের অনেক ইস্যূই স্থান পায়, রাজনৈতিক আদর্শ, অর্থনীতি,অভিবাসন – এসব বিষয় এতটা স্থান পায়না। সে কারণেই লিবডেম সব সময়েই সাধারণ নির্বাচনের চাইতে স্থানীয় নির্বাচনে ভাল ফল করে। আসল কথা হচ্ছে, স্থানীয় নির্বাচনের ফলাফল সব সময় ধারণা দেয় ঠিক তখনকার পরিস্থিতির ব্যাপারে – ছ’মাস বা এক বছর পরের অবস্থা সম্পর্কে নয়।
২০২১ সালের ইলেকশনে বরিস জনসন যখন প্রধানমন্ত্রী ছিলেন তখনকার স্থানীয় নির্বাচনের সময়ে কনজারভেটিভ ছয় পয়েন্টে এগিয়ে ছিল। শুধু তাই নয়, ২০২১ সালে কোভিড ভেক্সিন রোল আউটের কারণে কনজারভেটিভের ভোটঅনেক বেড়ে গিয়েছিল। বরিস জনসন ইউ এর চাইতে দ্রুত গতিতে বৃটেনে সবার জন্যে ভ্যাক্সিনের ব্যবস্থা করার ঘটনা নিঃসন্দেহে প্রভাব ফেলেছিল। এখন স্থানীয় নির্বাচনের প্রাক্কালে কনজারভেটিভ জনমতে ২০ পয়েন্ট পিছিয়ে রয়েছে যা কিনা লিজ ট্রাসের দশ নম্বর ডাউনিং স্ট্রিটে স্বল্পকালীন অবস্থানের চাইতেও নীচে নেমে গিয়েছে।
লন্ডন মেয়ার ছাড়া বিশেষভাবে ওয়েষ্ট মিডল্যান্ড ও টিসভ্যালি – এই দু’টো অঞ্চলের কনজারভেটিভ মেয়ার গদিচ্যূত হন কিনা সেটির দিকে কনজারভেটিভের নজর থাকবে সব চাইতে বেশী। নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণার পর কনজারভেটিভের বয়ান কেমন হতে পারে? যদি ওয়েষ্ট মিডল্যান্ড ও টিসভ্যালিতে কনজারভেটিভের মেয়ার নির্বাচিত হয়ে যায় তাহলে কনজারভেটিভের বয়ান হবে, ‘এই দেখ, জনমত জরিপে বলা হচ্ছে আমরা ২০ পয়েন্টে পিছিয়ে রয়েছি, অথচ তিন বছর আগে জনগণ যেভাবে আমাদের উপর ভরসা রেখেছিল ঠিক সেভাবেই এখনো আমাদের উপর ভরসা রেখেছে।’ কাজেই ওয়েষ্ট মিডল্যান্ড ও টিসভ্যালি কনজারভেটিভের খড়কুটো হয় কিনা সেই আশায় তাকিয়ে রয়েছে কনজারভেটিভ। কনজারভেটিভের আরেকটি বয়ান হতে পারে যে, তাদের যতটা খারাপ করার কথা ছিল ততটা খারাপ করেনি। এখানে একটি বিষয় হল সব জায়গায় রিফর্ম পার্টি প্রার্থী দেয়নি। কাজেই বেশীরভাগ জায়গাতেই রিফর্ম কনজারভেটিভের ভোটে ভাগ বসাতে পারবেনা।
এখানে একটু বলে রাখা প্রয়োজন যে, লন্ডন সহ মেট্রো মেয়ারদের ক্ষেত্রে ব্যাক্তিগত ইমেজ ও ট্র্যাক রেকর্ডের কিছু ভূমিকা থাকে তবে যদি কোনো অন্চল একেবারে লালে লাল অথবা নীলে নীল হয়ে যায় তখন ব্যাক্তিগত ফ্যাক্টরগুলো একটু কম প্রভাব ফেলে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, বর্তমান লন্ডন মেয়ার সাদিক খানের ব্যাক্তিগত ফ্যাক্টরের কারণে এবারের নির্বাচনে এতটা ভাল করার কথা নয়, তবে লন্ডন যেহেতু এতটাই লেবার অঞ্চল সে কারণেই তৃতীয় বারের মত সাদিক খান বিজয়ী হয়ে যাবে বলে আমার ধারণা। তবে একটি বিষয় কি আমরা লক্ষ্য করেছি? লেবার কাউন্সিলরদের লিফলেটে যেভাবে কিয়ার ষ্টার্মারের ছবি এসেছে কনজারভেটিভের কাউন্সিলারদের লিফলেটে ঋষি সুনাকের ছবি সেভাবে আসেনি অর্থাৎ ঋষি সুনাককে সামনে রেখে নদীয়পার হওয়ার সম্ভাবনা যে নেই তা দলের সবাঈ বুঝতে পারছে।
এখন মিলিয়ন ডলার প্রশ্ন হচ্ছে, কনজারভেটিভের ভরাডুবি হোক বা সম্মানজনক পরজয় হোক – তার উপর কি সাধারণ নির্বাচনের তারিখ নির্ভর করবে? আমার বিশ্বাস এ দু’টোর একটিতেও সাধারণ নির্বাচনের তারিখের হেরফের হবে না। সাধারণ নির্বাচনের তারিখ নির্ধারণ করবেন একজন মানুষ – ঋষি সুনাক। আমরা হয়তো লক্ষ্য করেছি, গত কয়েক মাসে সাংবাদিকগণ ঋষি সুনাককে যে প্রশ্নটি বার বার করেছেন তা হচ্ছে, ‘নির্বাচন কবে?’ উত্তর পাওয়া যায় নি।
নির্বাচনের ফলাফলে ঋষি সুনামের কিছু আসে যায় না। কনজারভেটিভের ভরাডুবিতে ঋষি সুনাকের রাজনৈতিক ক্যারিয়ারের সমাপ্তি ঘটবে। তিনি হয়তো ফিরে যাবেন ক্যালিফোর্নিয়াতে বিলাসবহুল জীবনে অথবা ফাইন্যান্স সেক্টরে। আমাদের নিশ্চয়ই মনে আছে, ২০২২ সালের ২৫ অক্টোবরে ঋষি সুনাক প্রধানমন্ত্রীর দ্বায়িত্ব গ্রহণ করেন। ঋষি সুনাক সর্ব শক্তি দিয়ে চেষ্টা করবে তাঁর প্রধানমন্ত্রীত্বকে টেনে নভেম্বর পর্যন্ত নিয়ে যেতে। তাতে লাভ? তাতে ঋষি সুনাকের লাভ এই যে তিনি দু’বছর বৃটেনের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন (যদি পার্টি তাকে ছুঁড়ে ফেলে না দেয়)- এটি বলা যাবে এবং এই সময়ের মধ্যে বৃটেনকে তামাক মুক্ত দেশে পরিণত করতে আইন পাশ করার সময় পাবেন তিনি যাতে দু’দশক পরে যখন ইতিহাস লেখা হবে তখন যেনো লিখা হয় – এই সেই ভারতীয় বংশোদ্ভুত বৃটেনের প্রধানমন্ত্রী যিনি বৃটেনে তামাক বিরোধী আইন করেছিলেন। কত চমৎকার তার সাফল্য! ততদিন ঋষি সুনাক ঘড়ির কাঁটাকে টেনে তার প্রধানমন্ত্রীত্বকে দীর্ঘায়িত করবেন ও ততদিনে বৃটেনের কি কি ক্ষতি হল – সেদিকে ফিরে তাকাবার প্রয়োজন বা ইচ্ছে কোনোটিই ঋষি সুনাকের নেই।।
………………………………..
লেখক Dr Zaki Rezwana Anwar FRSA MBBS DTM&H, MS & PhD একজন চিকিৎসক, জনপ্রিয় সিনিয়র সংবাদ পাঠক ও কলামিস্ট।