ঋষি সুনাক বৃষ্টি বিধৌত হয়ে কেন জুলাইয়ে নির্বাচন দিলেন?

Published: 23 May 2024

Dr Zaki Rezwana Anwar FRSA

কনজারভেটিভকে বৃষ্টির পানিতে ভাসিয়ে দিয়ে ঋষি সুনাকের নির্বাচনের ঘোষণা দেওয়ার কারণগুলো বিশ্লেষণের দাবী রাখে। সেই বিশ্লেষণ সম্পূর্ণ হবেনা যদি আমরা আরো দু’টো প্রশ্নের উত্তর দাঁড় না করাই। প্রথম প্রশ্ন: এত গুঞ্জন সত্বেও ২ মে তে কেন তিনি নির্বাচন দিলেন না? দ্বিতীয় প্রশ্ন: ঋষি সুনাক কেনই বা অক্টোবর অথবা নভেম্বরে নির্বাচন দিচ্ছেন না?

ঋষি সুনাক বুঝে গেছেন, রোয়ান্ডা ইস্যূ নিয়ে যে জটিলতা দেখা যাচ্ছে তাতে রোয়ান্ডা বিল ইস্যূতে তাঁর ব্যর্থতা নিয়ে জনগণের সামনে দাঁড়াবার মত দৃঢ়তা তাঁর আর থাকছে না। সত্যি বলতে অবৈধ অভিবাসী প্রত্যাশী ভর্তি একটি উড়োজাহাজ আকাশে আদৌ উড়বে কিনা সে বিষয়ে সন্দেহের শেষ নেই। ঋষি সুনাকের সলজ্জ অভিলাষ ছিল অন্তত অবৈধ অভিবাসীদের নিয়ে প্রথম উড়োজাহাজটি জুনের শেষ সপ্তাহ থেকে জুলাইয়ের দ্বিতীয় সপ্তাহের মধ্যে আকাশে উড়বে। তর্কের খাতিরে যদি ধরেও নেই জুনের শেষের দিকে অর্থাৎ নির্বাচনের আগে কাঙ্ক্ষিত উড়োজাহাজটি আকাশে উড়াল দিল, তাহলেও বৃটেনের সিভিল সার্ভেন্টরা এমন কিছু করবেনা বা এমনভাবে সেই ঘোষণা দিবেনা যা নির্বাচনের ফলাফলকে প্রভাবিত করতে পারে – এটি নিয়ম বহির্ভূত একটি কাজ। অর্থাৎ রোয়ান্ডা ইস্যূর পেছনে জনগণের ট্যাক্সের বিলিয়ন পাউন্ড জলে ভেসে গেছে।

ওদিকে ভারতের সাথে ট্রেড ডিল যা বৃটেন ও ভারতের সাধারণ নির্বাচনের আগে সম্পন্ন করার কথা ছিল তাও শেষ পর্যন্ত ভালভাবে হয়ে উঠতে পারল না। তামাক মুক্ত বৃটেনের পরিকল্পনাও শেষ পর্যন্ত ঋষি সুনাকের নির্বাচনী ঘোষণার আগে সেরে ফেলা গেল না।

এরপর আসা যাক, মুদ্রাস্ফীতির বিষয়ে।  মাত্রই ঘোষণা এসেছে যে, বৃটেনে মুদ্রাস্ফীতি কমেছে। কাজেই ঋষি সুনাক এই সময়টিকে অপেক্ষাকৃত কম খারাপ মনে করছেন। মুদ্রাস্ফীতির ব্যাপারেও সরকার সাফল্য দাবী করতে পারেনা, কারণ মুদ্রাস্ফীতি কমলেও সরকারের টার্গেট অনুযায়ী কমেনি। সরকারের টির্গেট ছিল মুদ্রাস্ফীতি ২% এ নামিয়ে আনা আর বাস্তবে মুদ্রাস্ফীতি কমে দাঁড়িয়েছে ২.৩ % এ। এখানে আরো দু’টো বিষয়‌ বলে‌ রাখা ভাল। মুদ্রাস্ফীতি কমার অর্থ কিন্তু জিনিসপত্রের দাম কমা নয় বা জিনিসপত্রের দাম আর বাড়বে না – তাও নয়। মুদ্রাস্ফীতি কমার অর্থ হচ্ছে, যে হারে জিনিসপত্রের দাম বাড়ছিল সে হারে বাড়বে না।  এই মুদ্রাস্ফীতি তো এ বছরের প্রথম কোয়ার্টার অর্থাৎ এপ্রিলের মধ্যেই কমেছিল, তাহলে ২ মে তে কেন নির্বাচনের ঘোষণা দেওয়া হলনা? আসলে মুদ্রাস্ফীতি কমলেও এ বিষয়ে ঘোষণা এসেছে দু’একদিন আগে।

এর মধ্যে কনজারভেটিভের জন্যে আরেক মহা সঙ্কট এসে হাজির হয়েছে। এন এইচ এস এর ইতিহাসে জঘন্যতম কলঙ্কময় রিপোর্টটি ফাঁস হয়েছে দু’তিন দিন আগে। তাতে প্রকাশ করা হয়েছে, সত্তোর ও আশির দশকে এদেশে বিভিন্ন কারণে যাদের দেহে রক্ত দেওয়া হয়েছিল তাদের অনেকেই HIV (এইডস) দ্বারা আক্রান্ত হয়েছে এবং হিপাটাইটিস সি নামের মারাত্বক রোগে আক্রান্ত হয়েছিলে। রক্ত নেওয়ার কারণে প্রায় আটাশ হাজার লোক এ দু’টো ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছিলে এবং প্রায় আড়াই হাজার লোক অকারণে মৃত্যু বরণ করেছে। এর কারণ হচ্ছে, বৃটেনে রক্তদানের চর্চা কম থাকায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে রক্ত বা রক্তের কিছু উপাদান আনা হতো। যুক্তরাষ্ট্রে অনিয়ন্ত্রিতভাবে ড্রাগে আসক্ত ও HIV পজেটিভ লোকজনের কাছ থেকে নেওয়া রক্ত বৃটিশ সরকার গ্রহণ করত। সেই সময়ে যুক্তরাষ্ট্রে কালো বাজারে একটি কথা প্রচলিত ছিল, ‘Ooze for booze’ অর্থাৎ ‘রক্ত বিক্রি করে মাদক ক্রয় কর’।

বৃটিশ সরকার ও স্বাস্থ্য বিভাগ এই ব্লাড স্ক্যান্ডেলের বিষয়টি  বছরের পর বছর ধামাচাপা দিয়ে রেখেছে। ক্যাম্পেইনারদের অক্লান্ত পরিশ্রমের পর প্রায় ৪০ বছর পরে এই রিপোর্ট দু’দিন আগে প্রকাশিত হয়েছে। ঋষি সুনাক ভুক্তভোগী প্রত্যেককে দুই মিলিয়ন পর্যন্ত ক্ষতিপূরণ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। ধীরে ধীরে এ বিষয়টি যে আরো বেশী করে প্রকাশিত হবে তা ঋষি সুনাক ভালভাবেই আঁচ করতে পারছেন। প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী এত ক্ষতিপূরণ যে তাঁর সরকারের পক্ষে দেওয়া সম্ভব নয় তা তিনি জানেন। আরো কিছুদিন ক্ষমতায় থেকে এই অপারগতার বোঝা কেন তিনি নেবেন? তার চাইতে এ ঝামেলা পরবর্তী সরকারের স্কন্ধে চাপিয়ে দেওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ বলে মনে করেছেন তিনি। নির্বাচনের দামামা বেজে উঠলে মিডিয়ার মনোযোগ ‘ব্লাড স্ক্যান্ডেল’ থেকে সাময়িকভাবে  হলেও সরে আসবে।

আরো একটি বিষয় আমাদের ভুলে গেলে চলবেনা। জেরেমি হান্ট ট্যাক্স কাট সহ অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের সিদ্ধান্তকে টেনে শরৎকালীন বাজেট পর্যন্ত নিয়ে যাচ্ছেন, অথচ সেগুলো সামাল দেওয়ার মত ম্যানুভারিং স্পেস কনজারভেটিভ সরকারের নেই। কাজেই ব্লাড স্ক্যান্ডাল, পোষ্ট অফিস কেলেঙ্কারি, জেলে স্থানাভাবে অপরাধীদের গ্রেফতার বন্ধ রাখা – এসব নানা জটিলতা পরবর্তী সরকারের কাছে হস্তান্তর করে জনগণের কাছে কনজারভেটিভের মনে মনে প্রত্যাশা, ‘আমাদেরকে প্রধান বিরোধী দল হিসেবে রেখো আর পাঁচ বছর পর আবার ভোট দিও’ – ঋষি সুনাকের বৃষ্টি বিধৌত অবস্থায় অনেকটা অপারদর্শীর মত জীবনীশক্তি বিহীন বক্তৃতার প্রকৃত অর্থ আসলে তা-ই দাঁড়ায়। এক কথায় ঋষি সুনাকের হাতে আর কোনো কার্ড নেই যা দিয়ে তিনি খেলতে পারেন। অনেকটা ‘রাজা চেক’ এর অবস্থা এখন। কাজেই অনির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী গর্ডন ব্রাউনের মত টেনে টেনে নির্বাচনকে শেষ সীমায় নিয়ে ঋষি সুনাকের আর বিন্দুমাত্র লাভ নেই।

সর্বশেষ ইউগোভ এর জরীপ অনুযায়ী লেবার কনজারভেটিভের চাইতে ২৭ পয়েন্ট এগিয়ে রয়েছে। নির্বাচনের ঘোষণার সময় থেকে নির্বাচন – এই সময়টুকুতে কোনো দল কি এই ব্যবধান কমাতে পারে? এ ধরনের ব্যবধান কমানো সম্ভব – এমন উদাহরণ খোঁজার জন্যে তো বৃটেনের ইতিহাসের পথে বেশী পেছনে হাঁটতে হাঁটতে হয়না। ২০১৭ সালে বৃটেনে সাধারণ নির্বাচনের ঘোষণার সময় কনজারভেটিভ ও লেবার দলের মধ্যে জরীপে যে পার্থক্য ছিল নির্বাচন ঘনিয়ে আসলে সেই দূরত্ব অনেকটা কমে গিয়েছিল। কোনোভাবে কি সেরকম পরিস্থিতি এবার তৈরী হতে পারে? আমার ধারণা, ২০১৭ সালের পরিস্থিতি ২০২৪ সালে হবে না, কারণ ২০১৭ সালে জনমতে পিছিয়ে থেকেও যে দল দূরত্ব কমিয়ে এনেছিল সে দল অর্থাৎ লেবার দল ক্ষমতাসীন ছিল না। এখন যে দল জরীপে পিছিয়ে রয়েছে তারা ক্ষমতাসীন দল। তবে ঋষি সুনাক ও কিয়ার ষ্টার্মারের ব্যাক্তিগত জনপ্রিয়তার জরীপের দেখা যাচ্ছে, ৭২% মনে করে ঋষি সুনাক একজন ভাল প্রধানমন্ত্রী হবেন না আর ৫০% মনে করে কিয়ার ষ্টার্মার ভাল প্রধানমন্ত্রী হবেন না। কাজেই ব্যাক্তি ষ্টার্মারের জনপ্রিয়তা কিন্তু তেমন নেই। তবে এটি সত্যি যে, বর্তমান নির্বাচনী ব্যবস্থায়‌ সাধারণ নির্বাচন নেতার একেবারে ঠিক তূলনামূলক জনপ্রিয়তার পরীক্ষা নয়।

IPSOS এর এক জরিপে দেখা গেছে, এবারের সাধারণ নির্বাচনে যে তিনটি বিষয়কে জনসাধারণ প্রাধান্য দিচ্ছে সেগুলো হচ্ছে: অর্থনীতি, এন এইচ এস ও আবাসন। এই প্রত্যেকটি ক্ষেত্রেই জরীপে লেবার দল কনজারভেটিভের চাইতে এগিয়ে রয়েছে।

১০ নম্বর ডাউনিং স্ট্রিটের সামনে ভিজা কাপড়ে দাঁড়িয়ে ঋষি সুনাকের  জীবনীশক্তি বিহীন হঠাৎ করে শুরু হওয়া হঠাৎ করে শেষ হওয়া বক্তৃতার পরে টিয়ার ষ্টার্মারের দু’দিকে ইউনিয়ন জ্যাকের পতাকার মাঝখানে দাঁড়িয়ে বক্তব্যে বিষয়গত বিশেষ কিছু না থাকলেও কিছুটা ওজন ছিল। তবে টিয়ার ষ্টার্মারের বক্তব্যের সারমর্মে উল্লেখ করার মত বিশেষ কিছু নেই। মর্মার্থ এতটুকুই যে, পরিবর্তন আনার ক্ষমতা জনগণের হাতে এবং লেবারকে ভোট দাও কনজারভেটিভকে দূরে রাখার জন্যে। মূলত বৃটেনে লেবার যেন ধীরে ধীরে কনজারভেটিভ হয়ে উঠছে।  রাজনৈতিক আদর্শের দিক থেকে তাদের দূরত্ব খুব বেশী নেই। পররাষ্ট্র নীতির ক্ষেত্রে দু’দেশের  দৃষ্টিভঙ্গি মোটা দাগে একই রকম দেখা যাবে দু’একটি ছোটখাটো সংযোজন ছাড়া।

টিয়ার ষ্টার্মার থেকে শুরু করে ঋষি সুনাক ও  বরিস জনসন প্রত্যেকের তথাকথিত ‘প্লেজ’ এর মধ্যে বলা হয়ে আসছে যে, প্রত্যেকেই অবকাঠামোগত আমূল পরিবর্তন আনবে বা পাবলিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে ঢেলে সাজাবে। এই ঢেলে সাজানোর ‘মূলা’ আমাদের সামনে গত কয়েকজন দলনেতাই ঝুলিয়ে রেখে আসছেন, তবে কার্যত দু’এটটি ফ্রি পোর্ট উদ্বোধন ছাড়া তেমন কিছুই হয়নি। বরিস জনসনের রেল ও পরিবহন ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানোর প্রতিশ্রুতির কিছুই হয়নি; ঋষি সুনাকের এন এইচ এস-কে ঢেলে সাজানোর কিছুই হয়নি; এখন আবার টিয়ার ষ্টার্মারের প্রধান ‘নির্বাচনী মূলা’ গ্রেট বৃটেনের রেলওয়েকে ঢেলে সাজানোর প্রতিশ্রুতিও পূরণ করা সম্ভব হবেনা। কিয়ার ষ্টার্মারের তথাকথিত প্রতিশ্রুতিগলো পূরণ করতে অর্থ কোথা থেকে আসবে তার কোনো ব্যাখ্যা টিয়ার ষ্টার্মার দেন না। আসলে যেভাবে ঢেলে সাজানোর প্রতিশ্রুতি রাজনীতিবিদগণ দিচ্ছেন, সে রকম ঢেলে সাজানোর মত যথেষ্ট অর্থ বৃটেনের নেই। এই যে, টিয়ার ষ্টার্মার রেলওয়েকে পুনঃ: জাতীয়করণের কথা বলছেন – আমরা কি ভুলে গিয়েছি আপনি আমি যে রেলের বগিগুলোতে বসে যাতায়াত করি সেটির মালিক তো আমরা নই। রেলের বাড়তি আয় হলেও বগিগলোর ভাড়া হিসেবে লভ্যাংশ চলে যাবে ফ্রান্স ও ইটালীর কাছে।

সত্যি বলতে গত কয়েক টার্ম ধরে বৃটেনের রাজনীতি আসলে ইংরেজিতে যাকে বলে ‘gesture politics’ এ পরিণত হয়েছে। এখানে জনগণের মনোযোগ আকর্ষণের জন্যে কিছু কথা বলা হয় যার বাস্তবায়ন বৃটিশ জনগণ দেখতে পায়না। এই gesture politics থেকে এবার জনগণ রেহাই পাবে – সে আশা হয়তো দূরাশা।

……………………

লেখক Dr Zaki Rezwana Anwar FRSA, MBBS, DTM&H, MS & PhD একজন চিকিৎসক, জনপ্রিয় সিনিয়র সংবাদ পাঠক, সংবাদ বিশ্লেষক ও কলামিস্ট।