“বাংলাদেশের মুদ্রাস্ফীতির কারণ বিশ্লেষণ ও প্রয়োজনীয় পদক্ষেপসমূহ”

Published: 31 May 2024

ড. ফজলে এলাহী মোহাম্মদ ফয়সাল


মুদ্রাস্ফীতির যদি বিরাট আকার ধারন করে তবে প্রকৃত পক্ষেই অর্থনীতিক-সামাজিক দৃষ্ঠিকোন থেকে চিন্তার বিষয়। কোন দেশের জি.ডি.পি বৃদ্ধি, বেকারত্ব হ্রাস, আয়স্তর বৃদ্ধি ইত্যাদি কারণে কিছু পরিমান মুদ্রাস্ফীতি হতেই পারে। রাজস্বনীতি, মুদ্রানীতি, নোট ইস্যু, বাজার নিয়ন্ত্রন প্রভৃতিভাবে যদি অতিমাত্রার মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রন করা না যায় তবে দরিদ্র, মধ্যবিত্ত, নির্দিষ্ট আয়ের জনগণের মাঝে ব্যাপক সমস্যা তৈরী করে থাকে। একটি গবেষনাধর্মী রিপোর্ট দেখা গেছে, দরিদ্র শ্রেনির জনগন যেমন- রিকশা চালক, দিনমজুর, গৃহ পরিচারিকা ইত্যাদি পেশায় জড়িত জনগন অনেক সময় মুদ্রাস্ফীতির প্রভাবে তাদের আয়স্তর বাড়াতে সক্ষম হয়ে থাকেন। বিপদের সম্মুখীন হন নির্দিষ্ট সীমিত আয়ের জনগন। দরিদ্র ও কর্মে অক্ষম বয়স্ক জনগন মুদ্রাস্ফীতির কারণে ভয়াবহ পরিস্থিতির সম্মুখীন হন। ২০২২ সালে দেশে মুদ্রাস্ফীতির পরিমান ছিলো ৭.৭%। বিশ^ ব্যাংকের পূর্বাভাস অনুযায়ী এ অর্থবছরে মুদ্রাস্ফীতির ৯.৬% হতে পারে। এ বছরের জানুয়ারী ও ফেব্রুয়ারী মাসে মুদ্রাস্ফীতির পরিমান ১০% এর কাছাকাছি। অনেকে মনে কারণ প্রকৃত মুদ্রাস্ফীতির পরিমান আরও বেশী। এ মুদ্রাস্ফীতির নিয়ন্ত্রন করা সম্ভব না হলে উন্নয়ন ও বিনিয়োগ বাধাগ্রস্থ হবে। অতিমাত্রায় মুদ্রাস্ফীতির ফলে জনগনের ক্রয়ক্ষমতা হ্রাস পায়। সঞ্চয় ও বিনিয়োগ হ্রাস পায় এবং সুদের হার বৃদ্ধি পেয়ে থাকে এবং এর ফলে বিনিয়োগরে মুনাফা হ্রাস পেয়ে থাকে। খাদ্যদ্রব্য ও অন্যান্য দ্রব্যের মূল্যের অস্বাভাবিক বৃদ্ধির ফলে অর্থনৈতিক কর্মকান্ড ব্যাহত হয়। জানুয়ারী মাসে বাংলাদেম খাদ্যজাত দ্রব্যে মুদ্রাস্ফীতির পরিমান ছিলো ৯.৫৬%। মুদ্রাস্ফীতির কারণে প্রধানত দরিদ্র জনগনবিভিন্ন উপায়ে খাত ভিত্তিক ব্যয় সংকোচনে বাধ্য হয়ে থাকেন। একটি গবেষনাধর্মী রিপোর্ট অনুযায়ী মুদ্রাস্ফীতিরকারণে স্বল্প আয়ের জনগনের মাঝে ৩১% জনগন খাদ্য অভ্যাসে পরিবর্তন এনে থাকেন। ২৪% জনগন সঞ্চিত অর্থব্যয় করে থাকেন এবং ১৫% দরিদ্র জনগন খাদ্য ছাড়াও অন্যান্য সামগ্রীর ব্যয় সংকোচন করতে বাধ্য হয়ে থাকেন। মুদ্রাস্ফীতির কারনে শহর অঞ্চলে দরিদ্র জনগন গ্রাম অঞ্চলের জনগনের তুলনায় বেশী মাত্রায় সমস্যার সম্মুখীন হয়ে থাকেন।

বাংলাদেশের মুদ্রাস্ফীতির কারনগুলো নিয়ে আলোচনা করতে গেলে বেশ কয়েকটি কারণ চিহ্নিত করা যায়। এদের মধ্যে বেশ কয়েকটি মৌলিক কারণ রয়েছে যেগুলো দীর্গমেয়াদী পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন ছাড়া মুদ্রাস্ফীতির নিয়ন্ত্রন করা দূরূহ ব্যাপার। আমাদের দেশ মূলত আমদানী নির্ভর দেশ। আমাদের দেশের রপ্তানীর তুলনায় আমদানীর পরিমান বেশী। ২০২১ সারে বাংলাদেশের বাণিজ্য ঘাটতির পরিমান ছিলো প্রায় ২ লাখ ৯৩ কোটি টাকা এবং ২০২২ সালে বাণিজ্য ঘাটতির পরিমান ছিলো প্রায় ৪ লাখ ৬ হাজার কোটি টাকা। ২০২১-২০২২ অর্থ বছরে বাংলাদেশের আমদানীর পরিমান ছিলো ৮ লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকা এবং রপ্তানীর পরিমান ছিলো ৪ লাখ ৭ হাজার কোটি টাকা। বাংলাদেশ বেশীর ভাগ পন্য আমদানী করে থাকে যথাক্রমে চীন, ভারত, সিঙ্গাপুর, মালোয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, জাপান, দক্ষিণ-কোরিয়া প্রভৃতি দেশ থেকে। ২০২১-২০২২ অর্থ বছরে চীন ও ভারত থেকে বাংলাদেশের পণ্য আমদানীর পরিমান ছিলো প্রায় ২ লাখ ৯ হাজার কোটি টাকা এবং ১ লাখ ৪৯ হাজার কোটি টাকা। ২০২১-২০২২ অর্থ বছরে আমেরিকাতে রপ্তানীর পরিমান ছিলো প্রায় ৮২ হাজার কোটি টাকা। এ ছাড়াও বাংলাদেশ যে সকল দেশে পন্য রপ্তানী করে থাকে তাদের মাঝে জার্মানী, যুক্তরাজ্য, স্পেন, ফ্রান্স ইত্যাদি রাষ্ট্র অন্যতম। দেশের মোট রপ্তানীর প্রায় ৮০% এসে থাকে পোশাক খাত থেকে। মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রনের জন্য রপ্তানীর খাত ও পরিমান বৃদ্ধি প্রয়োজন। এ জন্য প্রয়োজন দেশীয় ও বৈদেশিক বিনিয়োগ ও উৎপাদন বৃদ্ধি। ২০২২-২০২৩ অর্থ বছরের প্রথম ১১ মাসে সরকারের বাজেট ব্যয়কে সহায়তা করার জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মাধ্যমে
৭০ হাজার কোটি টাকা মুদ্রন করতে হয়েছিলো। অর্থের মাল্টি প্লাইয়ার ইফেক্টের কারণে এর পরিমান হতে পারে
প্রায় ৩ লাখ ৫০ হাজাপর কোটি টাকা। এটি মুদ্রাস্ফীতির একটি কারণ হতে পারে। অবশ্য অবকাঠামোগত উন্নয়ন
হলে ভবিষ্যতে আয়স্তর ও উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে আশা করা যেতে পারে।আন্তর্জাতিক বাজারে ডলারের মুল্য বৃদ্ধি এবং টাকার অবমূল্যায়ন দেশের মুদ্রাস্ফীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ। টাকার অবমূল্যায়ন হ্রাসে প্রয়োজন টাকার চাহিদা বৃদ্ধি করা এবং এর জন্য প্রয়োজন রপ্তানী বৃদ্ধি। এছাড়াও আমাদের দেশের সাথে যে সকল দেশের বানিজ্যিক সম্পর্ক বেশী যেমন চীন, ভারত, সিঙ্গাপুর, জাপান, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানী প্রভৃতি দেশে যদি সুদের হার, মুদ্রাস্ফীতি, প্রাকৃতিক বিপর্যয়, যুদ্ধ ইত্যাদি দেখা যায় তবে এর মাধ্যমে বাংলাদেশের অর্থনীতি এবং মুদ্রার যান প্রভাবিত হতে পারে। রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে বিশ^বাজারে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে এবং বাংলাদেশের অর্থনীতি প্রভাবিত হচ্ছে। কোন কারনে খাদ্যশস্য, তেলের দাম প্রভৃতি বৃদ্ধি পেলে পন্যের উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি পায় এবং এর ফলে পরিবহন, বিক্রয়মূল্যসহ অন্যান্যভাবে বিভিন্ন অন্যান্য দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পেয়ে থাকে। দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রের জন্য শিল্পের সাথে সাথে কৃষিতে উৎপাদন বৃদ্ধি একান্ত প্রয়োজন। কৃষি জমির সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করা একান্ত প্রয়োজন। খাদ্য-শস্যসহ অন্যান্য দ্রব্যের দাম বৃদ্ধি পেলে প্রতিষ্ঠানগুলো মজুরী বৃদ্ধি করতে বাধ্য হয়ে থাকে এবং এর প্রভাবে উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি পায়। আন্তর্জাতিক বাজারের কাঁচামালের দাম বৃদ্ধির ফলে উৎপাদিত দ্রব্যের দাম বৃদ্ধি পায়। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মাধ্যমে নোট ইস্যু যদি দেশীয় উৎপাদনের সাথে সমন্বয়হীন হয় তবে মূদ্রাস্ফীতি হয়ে থাকে। দেশীয় উৎপাদনের তুলনায় অতিরিক্ত নোট ইস্যু করা হলে মুদ্রাস্ফীতি দেখা দেয় অথবা কম নোট ইস্যু হলে ব্যবসা-বানিজ্য ও বিনিয়োগ বাধাগ্রস্থ হয়। সুতরাং কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নোট ইস্যু ও জি.ডি.পি এর সমন্বয় প্রয়োজন। রাজস্বনীতির সাথে দেশীয় উৎপাদনের সমন্বয় জরুরী। কর সংগ্রহ এবং বিভিন্ন খাতে অর্থ বন্টন এবং বিভিন্ন উন্নয়নমূখী প্রোগ্রাম বৃদ্ধি জি.ডি.পি এর সাথে যদি সমন্বয়হীন হয় তবে মুদ্রাস্ফীতি হতে পারে। মুদ্রানীতির মাধ্যমে অর্থের সরবরাহ এবং মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা যায়। মুদ্রানীতি বা মনিটারী পলিসির বিভিন্ন পন্থার মাধ্যমে অর্থের সরবরাহ নিয়ন্ত্রের মাধ্যমে মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রন করা সম্ভব। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সংকোচনমূলক মুদ্রানীতির মাধ্যমে মুদ্রাস্ফীতি কিছুটা নিয়ন্ত্রনে আনা সম্ভব হলেও এতে সঞ্চয়, বিনিয়োগ এবং উৎপাদন ও উন্নয়ন বাধাগ্রস্থ হবার সম্ভাবনা রয়েছে। মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রনে সতর্কতার সাথে রাজস্বনীতি ও মুদ্রানীতির প্রয়োগ প্রয়োজন। অন্যথায় বেকারত্ব বৃদ্ধি পেতে পারে এবং আয়স্তর কমে যেতে পারে। দীর্ঘমেয়াদী মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রনে বাজেট ঘাটতির জন্য স্বল্প ব্যয়ে বৈদেশিক ঋণ সংগ্রহ প্রয়োজন। দেশে বৃহৎ শিল্প প্রতিষ্ঠান তৈরীর মাধ্যমে উৎপাদন ও রপ্তানী বৃদ্ধি পেলে টাকার মান ও মুদ্রাস্ফীতির নিয়ন্ত্রন সম্ভব। প্রবাসীগন কর্তৃক প্রেরিত রেমিট্যান্স আমাদের বিনিয়োগ বৃদ্ধিতে ও অর্থনীতি শক্তিশালী করতে সহায়তা করবে এবং আন্তর্জাতিক বাজারে টাকার মান বৃদ্ধি পাবে। অনেক সময় ব্যবসায়ীগণ সিন্ডিকেটের মাধ্যমে কৃত্রিম সংকট তৈরী এবং অবস্থা অনুযায়ী পণ্যের সরবরাহের মাধ্যমে পন্যের দাম বৃদ্ধি করে প্রচুর অবৈধ মুনাফা অর্জন করে থাকেন। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়, সিলেট শহরের টুকের বাজারে সবজির মূল্য কেজি প্রতি ৩০/৪০ টাকা হলেও বন্দর এলাকার লালবাজারে সে সব সব্জি ৬০/৭০ টাকায় বিক্রয় করতে দেখা যায়। এছাড়াও মাছ, মুরগীর, মাংস প্রভৃতির দাম বৃদ্ধি করতে সিন্ডিকেট ব্যবসায়ীগণ সফল হয়ে থাকেন। বাজার মনিটরিং এবং নিয়ন্ত্রন বৃদ্ধি করা প্রয়োজন। এছাড়াও অবৈধ অর্থের বিভিন্ন মুখী বিনিয়োগের কারনে জমিসহ অন্যান্য দ্রব্যের দাম ও বৃদ্ধি পেয়ে থাকে। কোন কোন ক্ষেত্রে দেখা যায় কোন দৃব্যের দাম বৃদ্ধি পেলে ভোক্তাগন ভবিষ্যতে আরও মুল্য বৃদ্ধির সম্ভাবনার কথা চিন্তা করে ক্রয়ের পরিমান বৃদ্ধি করে থাকেন। এতে দ্রব্যমুল্য বৃদ্ধি পায়। এক্ষেত্রে ভোক্তাগনের সচেতনতা বৃদ্ধি করা প্রয়োজন। বর্তমানে বিকাশ, নগদ প্রভৃতির মাধ্যমে অর্থ সহজেই এক স্থান থেকে অন্য স্থানে স্থানান্তরিত হচ্ছে। এতে সবাই সহজেই পন্য দ্রব্য ক্রয়-বিক্রয় করতে পারছেন। অর্থের গতিশীলতা বৃদ্ধির কারনেও মুদ্রাস্ফীতি পরিলক্ষিত হয়ে থাকে। প্রায় ১৫/১৬ বছর পূর্বে যে বাসাটির ভাড়া ছিলো ৫ হাজার টাকা বর্তমানে সে বাসাটির ভাড়াটি প্রায় ১৫/১৬ হাজার টাকা। যে এলাকায় যেতে সি.এন.জি-তে ৫০ টাকা খরচ হতো তা বর্তমানে ১৫০/১৬০ টাকা। আটার প্রতি কে.জি-এর মূল্য ২০/২২ টাকা থাকলেও বর্তমানে প্যাকেট আটা প্রতি কে.জি প্রায় ৫৫/৬০ টাকায় বিক্রি হতে দেখা যায়। দুই তিন বছর আগে উচ্চ মাধ্যমিকের একজন ছাত্রকে পদার্থ বিজ্ঞান এবং গনিত পড়ানোর জন্য একজন শিক্ষককে ৪/৫ হাজার টাকা দিতে হলেও সিলেট শহরে বর্তমানে দিতে হচ্ছে প্রায় ৭/৮ হাজার টাকা। ১৫ বছর পূর্বে যে পরিবারটির মাসিক খরচ ছিলো ৩০/৩৫ হাজার টাকা ছিল, বর্তমানে সে পরিমাণ খরচের জন্য একটি পরিবারের প্রয়োজন প্রায় ৮০/৯০ হাজার টাকা। আমাদের দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের জন্য মুদ্রাস্ফীতির কারণ বিশ্লেষণ এবং অতিমাত্রায় মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রনে দীর্ঘমেয়াদী এবং দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহন একান্তভাবেই প্রয়োজন।
#
অধ্যাপক
ব্যবসায় প্রশ্রাসন বিভাগ
শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ^বিদ্যালয়,
সিলেট।