অযোধ্যার রাম মন্দিরও মোদিকে ফিরিয়ে দিল

Published: 6 June 2024

 Dr Zaki Rezwana Anwar FRSA

‘গর্তে পড়লে হাতি,

চামচিকেও মারে লাথি’

ভারতের অষ্টাদশ লোকসভার নির্বাচনের ফলাফল দেখে ঈশ্বর দূত (মোদীর ভাষ্য অনুযায়ী) নরেন্দ্র মোদির অবস্থাও অনেকটা সেরকমই মালুম হচ্ছে। ভারতের লোকসভায় আসন সংখ্যা ৫৪৩ ও সরকার গঠন করতে প্রয়োজন ২৭২ টি আসনের। ৫৪৩ এর দুই তৃতীয়াংশ অর্থাৎ ৩৫৯ আসন পেলে সংবিধান সংশোধন করার ক্ষমতা থাকে বিজয়ী দলের। নির্বাচনের আগে নরেন্দ্র মোদি যেভাবে শোরগোল তুলেছিলেন যে, বিজেপি এককভাবেই ৩৭০টি আসন পাবে এবং তারা সংবিধান পরিবর্তন করতে পারবে – বাস্তবে তা আর ঘটেনি। ফলাফলে দেখা গেল বিজেপি ৩৭০ এর ধারে কাছেও যেতে পারেনি। বিজেপি পেয়েছে ২৪০ আসন। অর্থাৎ গত দু’মেয়াদের মত এবার এককভাবে সরকার গঠন করার অভিলাষ অপূর্ণ রেখে মোদি সরকারকে সরকার গঠন করতে দ্বারস্থ হতে হল পল্টিবাজ রাজনীতিবিদ হিসেবে খ্যাত জিডিইউ- এর নীতিশ কুমার ও টিডিপি -এর চন্দ্রবাবু নাইডুর মত রাজনীতিবিদদের কাছে যাদের সাথে বিজেপির রাজনৈতিক মতাদর্শের বিভেদ রয়েছে। ফলশ্রুতিতে মোদি নির্বাচনে জনগণকে দেওয়া প্রতিশ্রুতির অনেক কিছুই পূরণ করতে পারবেন না। মোদি নীতিশ কুমার ও চন্দ্রবাবু নাইডুর স্কন্ধে ভর করে প্রধানমন্ত্রী হয়ে জহরুল লাল নেহেরুর মত তৃতীয়বারের মত‌ প্রধানমন্ত্রী হওয়ার স্বাদ গ্রহণ করবেন হয়তো।

বিজেপির কেন এরকম ফল হল এবং ঠিক এই বছরে ভারতের এই ফলাফল বিশ্বকে কি বার্তা দিচ্ছে – সে দিকে তাকানোর প্রয়োজন বোধ করছি।

চলুন আমরা দেখি, নরেন্দ্র মোদি গত দু’টো নির্বাচনে কিভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে সরকার গঠন করেছিলেন। আমাদের মনে থাকার কথা, ২০১৪ সালে মোদি কিন্তু এবারের মত নির্বাচনে হিন্দুত্ববাদের কার্ড খেলেন নি। ২০১৪ সালে মোদির শ্লোগান ছিল ‘স্যাবকা সাথ্ স্যাবকা বিকাশ’ অর্থাৎ সবাইকে সাথে নিয়ে সবার উন্নয়নের শ্লোগান তিনি দিয়েছিলেন। তখন কংগ্রেসের দূর্নীতির বিরুদ্ধে কথা বলেছিলেন তিনি, দূর্নীতিবাজদের বিদেশে পাচারকৃত অর্থ ফিরিয়ে আনার কথা বলেছিলেন।  তারপর ২০১৯ সালে দ্বিতীয়বার নির্বাচনে জাতীয়তাবাদের শ্লোগান তুলেছিললেন। তখনকার ঘটনাও আমাদের মনে থাকার কথা। ভারত শাসিত কাশ্মীরের পুলওয়ামায় এক হামলায় ৪০ জনের বেশী নিরাপত্তা রক্ষী নিহত হওয়ার পর ‘লাইন অফ কন্ট্রোল’ অতিক্রম করে পাকিস্তানের সীমানার ভিতরে হামলা করেছিল ভারত। দেশ রক্ষায় মোদি কত শক্তিশালী সেই ধারণা দিয়ে অর্থাৎ ২০১৯ সালে এক জাতীয়তাবাদী ধাক্কা দিয়ে মোদির বিজেপি এককভাবেই ৩০৩টি আসন পেয়ে এককভাবে সরকার গঠন করেছিল।

গত কয়েক বছরে মোদি ধীরে ধীরে নিজেকে এমনভাবে প্রকাশ করতে শুরু  করেছিলেন যে, তিনি ছাড়া বিজেপিতে তো নয়-ই এমনকি ভারতেও কোনো নেতা নেই। অটল বিহারী বাজপেয়ী যেবার নির্বাচনে হেরে গেলেন সেই নির্বাচনে শ্লোগান তোলা হল ‘ইন্ডিয়া শাইনিং’। তেমনি এবারের নির্বাচনে শ্লোগান তোলা হল ‘মোদি ম্যাজিক’। অর্থাৎ দলের উর্ধ্বে নিজেকে তুলে ধরতে চেয়েছিলেন মোদি। তবে মোদির হিন্দুত্ববাদের কার্ড সেভাবে কাজ করেনি। ভারতের বিপুল জনগোষ্ঠী যে অন্তত এখনো একেবারে ধর্মান্ধ হয় নি তা বোঝা গেল।

অপরদিকে ভারতের বেকারত্ব, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, প্রশাসনের দূর্নীতি ও রাজ্যের বঞ্চনা – এসবকেই হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছে কংগ্রেস। সেই সাথে সংবিধান বাঁচাও শ্লোগান তুলেছে কারণ মোদি ইঙ্গিত দিয়েছিলেন তিনি এককভাবে ৩৭০ টি আসন পেলে সংবিধান পরিবর্তন করে তাঁর পছন্দমত তথাকথিত হিন্দুত্ববাদ প্রতিষ্ঠা করে ভারতকে হিন্দু রাষ্ট্রে পরিণত করবেন।

ভেবে দেখুন, এবারের নির্বাচনে উত্তর প্রদেশে অযোধ্যার রাম মন্দির ইস্যুর পরেও মোদি ম্যাজিক কাজে আসল না। উত্তর প্রদেশে ২০১৪ ও ২০১৯ সালে বিজেপি সফলতা পেয়েছিল অথচ উত্তর প্রদেশের অযোধ্যার রাম মন্দির যে আসনে অর্থাৎ ফয়জাবাদে বিজেপি হেরে গিয়েছে। বহু বড় বড় হিন্দু ধর্মগুরুর মতে অসম্পূর্ণ মন্দিরে দেবতার প্রাণ প্রতিষ্ঠা করা হিন্দু শাস্ত্রের বাইরে। অথচ মোদি তা-ই করলেন, কারণ নির্বাচনের আগে তাঁকে কাজটি করতে হবে ব’লে। অনেক ধর্মগুরু তখন  মোদির সাথে যোগ দেওয়া থেকে বিরত থেকেছিলেন। ওদিকে দক্ষিণাঞ্চলে ধরাশায়ী হয়েছে বিজেপি। বুথ ফেরত সমীক্ষাকে উল্টে দিয়ে তামিল নাড়ুর ৩৯ টি আসনের সব ক’টি জিতে নিয়েছে কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন ইন্ডিয়া জোট।

একটু মনে রাখা প্রয়োজন, ভারতের রাজনীতিতে নীতিশ কুমারের পল্টীবাজ হিসেবে খ্যাতি রয়েছে। ইন্ডিয়া জোটের গোড়াতে যে কয়েকজন মূল হোতা ছিলেন তাদের অন্যতম হচ্ছেন নীতিশ কুমার যিনি পরে তিনি আবার বিজেপির দিকে ঝুঁকে পড়েছেন। অথচ নীতিশ কুমারের উদ্যোগেই ইন্ডিয়া জোট গঠনের প্রথম বৈঠকটি হয়েছিল পাটনায়। ওদিকে গত ১০ বছরের ট্র্যাক রেকর্ড মতে চন্দ্রবাবু নাইডুর অবস্থা হচ্ছে – সুবিধেমত কখনো তিনি কংগ্রেসের সঙ্গে, কখনো বিজেপির সঙ্গে। সরকারের কাছাকাছি থাকাটাই তাঁর পছন্দ।

১৯৮৪ সালে ইন্দিরা গান্ধীর প্রাণনাশের পর রাজীব গান্ধী যে সরকার গঠন করেছিলেন সেখানে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছিল তারা। তারপর ৩০ বছর ধরে সব সময়ই প্রধান দল অন্য দলের সাথে মিলে সরকার গঠন করেছিল। অর্থাৎ ৩০ বছর পর ২০১৪ সালে কংগ্রেসকে হারিয়ে মোদির বিজেপি দল ক্ষমতায় আসে। তবে গত ১০ বছরে একা আধিপত্যে দেশ শাসন করার পর এবার মোদির জন্যে একটি বড় ধাক্কা পেল ব’লে মনে হচ্ছে। মোদি যেভাবে ভিন্ন মতাদর্শের শরীকদের নিয়ে সরকার গঠন করতে যাচ্ছেন তেমন যে আগে হয়নি তা নয়। প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারী বাজপেয়ীও ভিন্ন মতাদর্শের শরীরকদের সাথে মিলে সরকার গঠন করেছিলেন। তবে এটা নিশ্চিত যে, ভারত আগামী কয়েক বছর বিশ্ব মিডিয়াতে সব সময় আলোচনায় থাকবে।

ballot box with flag of India isolated on white background

২০২৪ সালকে ইতিহাসের বৃহত্তম নির্বাচনী বছর বললে ভুল হবেনা। ভাবা যায় চার বিলিয়ন মানুষ অর্থাৎ  পৃথিবীর মোট জনগোষ্ঠীর প্রায় অর্ধেক ভোট দেওয়ার সুযোগ পাবে ২০২৪ সালে!  বৃটেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ভারত সহ মোট ৬৪ টি দেশ ও সেই সাথে ইউরোপীয় ইউনিয়নের জন্যেও ২০২৪ সালে নির্বাচনী বছর। কাজেই একই বছরে এতগুলো দেশে কারা ক্ষমতায় আসবেন তার উপর নির্ভর করছে আগামী অন্তত দু’এক দশক পৃথিবী কোন দিকে হেলবে।

ভারতে নির্বাচনের ফলাফলে পুরো পৃথিবীর ভবিষ্যৎ রাজনীতির জন্যে একটি ইঙ্গিত রয়েছে। বর্তমানে identity politic যেন পৃথিবীতে একেবারে জেঁকে বসার মত অবস্থার দিকে যাচ্ছে। Identity politics কোনো দল করে গায়ের রঙ দিয়ে, কেউ করে ধর্ম নিয়ে, কেউ বা উগ্র ডানপন্থী দর্শন দিয়ে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যেমন ট্রাম্পের identity politics হচ্ছে white supremacy অর্থাৎ শ্বেতাঙ্গরাই। শ্রেষ্ঠ। এমন কি ইউরোপের যে দেশগুলো অত্যন্ত  উদারপন্থী  হিসেবে পরিচিত ছিল যেমন ন্যাদারল্যান্ডস, সুইডেন সেসব দেশেও উগ্র ডানপন্থীরা ধীরে ধীরে মাথা চাড়া দিয়ে উঠছে। বর্তমানে Identity politics এ ভারত  সব সময়ই একটি উদামুসলমানইহরণ হিসেবে সামনে আসে এবং এবারের ভারতের নির্বাচন হচ্ছে একটি লিটমাস টেষ্টের মত। এই প্রথমবারের মত ভারতে মোদির বিজেপি identity politics কে নির্বাচনী ঢাল হিসেবে ব্যবহার করেছে। তবে মোদি যে হিন্দুত্ববাদের কথা বলে‌ সেখানেও সব হিন্দুদের তিনি অন্তর্ভুক্ত করেন নি, যেমন দলিতরাও তো হিন্দু কিন্তু তাদেরও গরুর চামড়া নিয়ে শিল্প কারখানায় কাজ করায় তাদের পিটিয়ে হত্যা করার ঘটনা ঘটেছে। অর্থাৎ মোদি শুধু হিন্দুদের একটি বিশেষ গোষ্ঠীকে সাথে নিয়ে তাঁর পছন্দমত হিন্দুত্ববাদ জনগণকে গিলাতে চেয়েছিলেন। শুধু  নয়, খৃষ্টান, বৌদ্ধদের যেমন তিনি তাঁর রাজনৈতিক আদর্শের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করতেন না, তেমনি হিন্দুদের একটি অংশকেও তিনি অন্তর্ভুক্ত করতেন না। শুধু মুসলমানদের তিনি অনুপ্রবেশকারী বলে ক্ষান্ত হন নি, ত্রিপুরায় খৃষ্টানদের উপর কি অত্যাচার করা হয়েছিল তা-ও আমরা দেখেছি।

এবারের নির্বাচনের ফলাফল প্রমাণ করল যে, এখনো ভারতের জনগণ অনেক সহিষ্ণু, এখনো ভারতের আপামর জনগণ ‌মোদির selective হিন্দুত্ববাদকে সমর্থন করেনা। মোদি যদি এভাবে বিজয়ী হতো তাহলে তা ভারতের গণতান্ত্রের জন্যে ক্ষতিকর হতে। কারণ মোদি যেভাবে একটা hype তুলেছিলেন সেভাবে যদি ৩৭০ টি আসন পেতেন, তাহলে সংবিধান পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে এমন সব আইন করতেন যা ভারত যে বৃহৎ গণতান্ত্রিক একটি দেশ – সেই সুনামটি দ্রুত হারাতে হতো। তবে আরও একটি সাধুবাদ ভারতের প্রাপ্য।  ভারতে এতগুলো সংখ্যালঘু গোষ্ঠী নিয়েও, বেকারত্ব সহ নানা সমস্যার মাঝেও ভারত প্রমাণ করল, কোনো দেশ যদি চায় তাহলে নির্বাচন সহী করতে পারে। এটিকে অবশ্যই ভারতের গণতান্ত্রের সৌন্দর্য বলতে হয়। যদিও ভারতের অনেক  প্রতিষ্ঠান থেকেই গণতন্ত্র  পালিয়ে গেছে তবু ভারতের মত একটি বৃহৎ দেশে এখনো নির্বাচন নিয়ে কোনো প্রশ্ন উঠেনা – যেটি বাংলাদেশ সহ অনেক দেশের জন্যে শিক্ষণীয়।

ভারতের পর মার্কিন  যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচন আর কয়েক মাস পরেই অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। জো বাইডেনের গাজা বিষয়ে আচরণের সমালোচনা আমরা অহরহই করছি। তবে ট্রাম্পের  identity politics অর্থাৎ  white supremacy এর কার্ড খেলার জালে কি মার্কিনী জনগণ ধরা দেবে নাকি ভারতের মতই শেষ দৃশ্য দেখা যাবে? মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনের ফল কি হবে আমরা জানি না, তবে ভারতের এই ফলাফল যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাপারে এই বার্তাটি দেয় যে, হয়তো পৃথিবীর বেশিরভাগ মানুষ এখনো identity politics কে সমর্থন করেনা – এই গ্রহের মানুষের মধ্য থেকে মানবতা নামক বিষয়টি এখনো পুরোপুরি হারিয়ে যায়নি।।

………………………….

লেখক Dr Zaki Rezwana Anwar FRSA, MBBS, DTM&H, MS & PhD একজন চিকিৎসক, জনপ্রিয় সিনিয়র সংবাদ পাঠক, সংবাদ বিশ্লেষক ও কলামিস্ট।