তিন দিকপালের কবিতা ও গান মানুষকে উজ্জীবিত করেছে'
খেলাঘর ইউকের উদ্যোগে রবীন্দ্র-নজরুল-সুকান্ত জয়ন্তী উদযাপন
নিলুফা ইয়াসমীন হাসান
লন্ডন: বাংলা সাহিত্যের তিন কান্ডারি – কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম ও বিপ্লবী কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য। তাঁদের কবিতা ও গান মানুষকে উজ্জীবিত করেছে| অসাম্প্রদায়িক চেতনার এই তিন দিকপালের সাহিত্য কর্ম নিয়ে ইউকে প্রবাসী খেলাঘর আসরের প্রাক্তন সদস্যরা আয়োজন করেছে ‘কবিত্রয়ী: চিন্তা চেতনায় মননে’, রবীন্দ্র -নজরুল-সুকান্ত জয়ন্তী অনুষ্ঠান|
‘আনন্দলোকে মঙ্গলালোকে বিরাজ সত্যসুন্দর মহিমা তব উদ্ভাসিত মহা গগন মাঝে’ কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এই গান সমবেত কন্ঠে পরিবেশনার মাধম্যে গত ৯ই জুন রোববার পূর্ব লন্ডনের ব্রাডি আর্টস সেন্টারে শুরু হয় মনোমুগ্ধ্কর ‘কবিত্রয়ী’র জয়ন্তী অনুষ্ঠান|
বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠানটির সঞ্চালনায় ছিলেন সৈয়দ জাফর, এরিনা সিদ্দিকী এবং ধনঞ্জয় পাল| অনুষ্ঠানের অন্যতম উদ্যোক্তা বিলেতের সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব সাহাবুদ্দিন বাচ্চু সূচনা বক্তব্যে বলেন, কেন যুদ্ধে ঝরে যাচ্ছে অগণিত শিশুদের প্রাণ, কেন ধর্মের নামে রক্তের হোলি খেলা হচ্ছে – এমনি হাজারো প্রশ্নের উত্তর খোঁজার জন্য খেলাঘর শিশুদের যুগিয়েছে রসদ। তাই স্বাভাবিকভাবেই খেলাঘরের সাথে বেড়ে উঠা শিশু-কিশোর পরবর্তীতে হয়েছেন প্রথিতযশা কবি, সাহিত্যিক, শিল্পী, চিন্তাবিদ, অর্থনীতিবিদ, রাজনৈতিক নেতা ও মানবাধিকার কর্মী। তিনি বলেন, বাঙ্গালীর কাছে রবীন্দ্র, নজরুল এবং সুকান্ত চির জাগরুক। এ তিন কবি বাংলা সাহিত্যে কেবল ঐতিহ্য হিসেবে নয়, ভবিষ্যতের পথ প্রদর্শক হিসেবেও বরণীয়। এদের একজন উদার মানবিকতাবাদের কবি, আরেকজন মেহনতী মানুষের মুক্তিতে বিশ্বাসী, স্বাধীনতা ও জাতীয় গণতান্ত্রিক সংগ্রামের কবি। অন্যজন সমাজতান্ত্রিক বাস্তবতার আদর্শে সর্বহারা শ্রেণীর বিপ্লবে বিশ্বাসী কবি। বলা চলে একই উজানে চলা নৌকার হাল ধরে থাকা তিন কাণ্ডারী|
নোবেল বিজয়ী কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সম্পর্কে আলোচনা করেন লেখক, কবি ও গবেষক ডঃ পল্টু রঞ্জন দত্ত| জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম এর সাহিত্য কর্ম চমৎকারভাবে তুলে ধরেন বাংলা একাডেমী পুরস্কারপ্রাপ্ত কবি ও সাহিত্যিক শামীম আজাদ| বাংলা সাহিত্যের মার্কসবাদী ভাবধারায় বিশ্বাসী এবং প্রগতিশীল চেতনার অধিকারী তরুণ কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যকে নিয়ে আলোকপাত করেন লেখক ও সমাজকর্মী এমদাদ তালুকদার এমবিই|
বিলেতের সুনামধর্মী শিল্পী গৌরী চৌধুরী ও গুণী শিল্পী শ্যামল চৌধুরীর সংগীত পরিচালনায় সমবেত ও একক গান পরিবেশন করেন মোস্তফা কামাল মিলন, নূরুল ইসলাম, সৈয়দা তামান্না, ইভা আহমেদ, শিবলু রহমান, হুমায়ুন ইলতুত, জান্নাত ইলতুত, অম্বিকা, শুভ্যাংগী এবং প্রিয়ম পুরকায়স্থ|
‘এই খানে খেলাঘর পেতেছি’ সমবেত কন্ঠে পরিবেশনের পর গৌরী চৌধুরীর পরিবেশনায় ‘তুমি কোন কাননের ফুল’, শ্যামল চৌধুরীর কন্ঠে ‘হিমালয় থেকে সুন্দরবন’ গান শ্রোতাদের মুগ্ধ করে রাখে| ‘নদীর নাম সই অঞ্জনা’ জান্নাত ইলতুত এর পরিবেশনা ছিল অসাধারণ| গৌরী চৌধুরী পরিচালিত গানের স্কুল সুরালয়ের শিক্ষার্থী অম্বিকা ও শুভ্যাংগীর দ্বৈত গাওয়া গান ‘অঞ্জলি লহ মোর সংগীতে’ ছিল উপভোগ্য। ক্ষুদে শিল্পী প্রিয়ম পুরকায়স্থ গেয়েছেন ‘গ্রাম ছাড়া ঐ রাঙা মাটির পথ’। প্রিয়মের গায়কিতে মুগ্ধ হয়ে দশর্করাও কন্ঠ মিলিয়েছেন। মোস্তফা কামাল মিলন, নূরুল ইসলাম, সৈয়দা তামান্না, ইভা আহমেদ, শিবলু রহমানও একক গান পরিবেশন করে দর্শকদের মুগ্ধ করেছেন| সুপ্তি পাল তার অসাধারণ নৃত্য শৈলীর মাধ্যমে নজরুলের ‘শ্যাম সুন্দর’ গানের সাথে নৃত্য পরিবেশন করেন।
গান, কবিতা, নাচ ও বিশিষ্ঠজনদের বক্তব্যের মাঝে ‘কবিত্রয়ী’র জয়ন্তী অনুষ্ঠানের তিন সঞ্চালক সৈয়দ জাফর, এরিনা সিদ্দিকী এবং ধনঞ্জয় পাল চমৎকারভাবে ধারা বর্ণনায় প্রকৃতি প্রেমিক কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম ও প্রগতিশীল চেতনার অধিকারী তরুণ কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যকে তুলে ধরেন| প্রাঞ্জল উপস্থাপনায় তাঁরা বলেন, রবীন্দ্রনাথ মূলত ছিলেন প্রকৃতি প্রেমিক কবি। প্রকৃতির মধ্যে দিয়ে মানব জীবনের সন্ধান করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথের গান, গল্প, নাটক, উপন্যাস, কাব্য সর্বত্রই প্রকৃতিকে ঘিরে।
কাজী নজরুল ইসলাম শুধু বিদ্রোহী কবি নন, ছিলেন প্রেমেরও কবি। চিরায়ত আদর্শভাব রোমান্টিকতা অতিক্রম করে নজরুল প্রেম ভাবনায় আনলেন বাস্তবতা। যে কারণে বাংলা গান তাঁর স্পর্শে হয়ে ওঠে আধুনিক।
সুকান্ত ভট্টাচার্য মাত্র একুশ বছর বয়স বেঁচে ছিলেন। সামান্য কয়েক বছরে লেখনীতে অশেষ খ্যাতি অর্জন করেছেন তিনি।
বাউল শিল্পী হুমায়ুন ইলতুত এর পরিবেশনায় সাংস্কৃতিক পর্ব সমাপ্ত হয়| তার গাওয়া ‘আমি কোথায় পাব তারে, আমার মনের মানুষ যে রে’ গানে দর্শক মুগ্ধ হয়ে করতালি দিয়ে উচ্ছাস প্রকাশ করেন |
এছাড়া, অনুষ্ঠানটিকে আরো প্রাণবন্ত করে তোলে রবীন্দ্র, নজরুল এবং সুকান্তের কবিতা আবৃত্তি| আবৃত্তি করেন যথাক্রমে সাহাব আহমেদ বাচ্চু, সৈয়দ ইকবাল ও লেনিন হক।
বাদ্যযন্ত্রে সহায়তা করেছেন শুভজিত সাহা, মিন্টু গোস্বামী ও হাসান। অনুষ্ঠানটি সম্পন্ন হয় সৈয়দ ইকবাল, মনজুর মোরশেদ ও মাহমুদ হাসান মিঠু্র সমাপনী বক্তব্যের মাধ্যমে।
খেলাঘরের প্রাক্তন সদস্যবৃন্দ সহ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন লন্ডনের বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ।