কিয়ার ষ্টার্মার বিজয়ী হলেও ইতিহাস কেন তাঁকে ক্ষমা করবেনা

Published: 4 July 2024

Dr Zaki Rezwana Anwar FRSA

আমার এক বন্ধু বলছিলেন, এবারের নির্বাচনে কোনো সাসপেন্স নেই, কোনো হৃদকম্পন নেই, কারণ ফলাফল তো জানা-ই আছে – বিপুল সংখ্যা গরিষ্ঠতা পেয়ে লেবার দল জিতবে এবং ১০ নম্বরের নতুন বাসিন্দা হচ্ছেন কিয়ার ষ্টার্মার। আমি বলব আমার বন্ধুর মত যারা বিষয়টিকে দেখেন তারা বৃহৎ চিত্রটিই মিস করে ফেলেন। আমি মনে করি, শতাব্দীর একটি গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচন ২০২৪ সালের এই নির্বাচন। আজ থেকে বেশ কয়েক দশক পরে ইতিহাসবিদরা এই নির্বাচন নিয়ে নানাভাবে পর্যালোচনা করবে; গবেষণা করবে; কারো পি এইচ ডি -র থিসিসও হতে পারে এই নির্বাচন, কারণ এই নির্বাচন বদলে দিতে শুরু করবে বৃটেনের রাজনীতির ল্যান্ডস্কেপ!

সর্বশেষ বিভিন্ন জরিপে বলা হচ্ছে, লেবার দল প্রায় ৪০০টির মত আসন পাবে। তা-ই যদি হয় তাহলে বলা যায় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এবার লেবার সবচাইতে সংখ্যা গরিষ্ঠতা পাবে। মেগাপোল অনুযায়ী কনজারভেটিভ যদি ৫০ থেকে ১৫০ টি আসন পায় তা হবে কনজারভেটিভের প্রতিষ্ঠা লগ্নের পর থেকে সব চাইতে খারাপ ফলাফল – কনজারভেটিভের ঐতিহাসিক পরাজয়! তাহলে কি ১০০ বছর আগে যেভাবে লিবারেল‌ দলের অবলুপ্তি ঘটেছিল কনজারভেটিভও সে পথেই হাঁটছে অথবা কনজারভেটিভের কী মেটামরফোসিস হয়ে এমন এক নতুন  রূপে আবির্ভূত হবে যার সঙ্গে আদি কনজারভেটিভের আদর্শের কোনো মিল খুঁজে পাওয়া যাবে না?

এ যুগের একজন তুখোড় লেখক ও দার্শনিক ম্যালকম গ্ল্যাডওয়েল বলেছিলেন, ‘রাজনীতিতে সাফল্যের প্রথম ফ্যাক্টর হচ্ছে, রাজনীতির  cycle এর সঠিক বিন্দুতে সঠিক সময়ে অবস্থান করা’। কিয়ার ষ্টার্মারের আসন্ন বিজয় আমাকে সেই উক্তিটি মনে করিয়ে দিচ্ছে। কিয়ার ষ্টার্মারই হতে যাচ্ছেন বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী তাতে আর‌ দশজনার‌ মত আমারও কোনো সন্দেহ নেই। ১৯৯৭ সালে টনি ব্লেয়ার যে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছিলেন তার চাইতেও বেশী সংখ্যাগরিষ্ঠতা  কিয়ার ষ্টার্মারের ভাগ্যে জুটে যাবে। তবে মনে‌ রাখতে হবে, এবারের নির্বাচনের জনগণের মূলমন্ত্র হচ্ছে, কাকে চাই তার চাইতে বড় কথা কাকে চাই না। কনজারভেটিভ খেদাও মন্ত্র নিয়ে বিভিন্ন মতাদর্শের ভোটাররা জড়ো হচ্ছেন ষ্টার্মার ক্যাম্পে। এদের সবাই কিন্তু লেবারকে ভোট দেবেননা, এন্টি কনজারভেটিভের পক্ষে ভোট দেবেন। বলা যায়, কিয়ার ষ্টার্মারের জন্যে কনজারভেটিভের পক্ষ থেকে এ এক প্রীতি উপহার। ১৯৯৭ সালে টনি ব্লেয়ারের তখনকার মতাদর্শ ও পরিকল্পনায় মুগ্ধ হয়ে এবং নেতা হিসেবে টনি ব্লেয়ারের ক্যারিসমা দেখে তাঁকে হিরো হিসেবে দেখে যে গণজোয়ার সৃষ্টি হয়েছিল, কিয়ার ষ্টার্মারকে ঘিরে জনগণের মনে সেই enthusiasm নেই। কাজেই ষ্টার্মার বিজয়ী হবেন কিন্তু হিরো হবেন না।

এবার কনজারভেটিভকে দ্বিতীয় স্থানে বা প্রধান বিরোধী দল হিসেবে টিকে থাকার জন্যে শেষ পর্যন্ত লিবডেমের সাথে যুদ্ধে রীতিমতো হিমশিম খেতে হবে, কারণ কনজারভেটিভকে বিদায় করবার‌ জন্যে লেবার ও লিবডেমের অনেক সমর্থক ট্যাকটিকাল ভোটিং করবে এবং জরিপ বলছে, ইউকের নির্বাচনের ইতিহাসে এবারই সব চাইতে বেশী সংখ্যক ট্যাকটিকাল ভোটিং হবে।  IPSOS এর জরিপে  বলা হয়েছে প্রতি পাঁচজনে একজন বলেছে, তাঁরা এমন দলকে ভোট দিবে যাদেরকে তারা যে ঠিক সমর্থন করেন এমন নয় তবে ঐ আসনে কনজারভেটিভকে হারানোর সম্ভাবনা যে দলের সব চাইতে বেশী তাকেই তাঁরা ভোট দেবেন। শুধু  তাই নয়, যেখানে লেবার প্রচারণা কমালে লিবডেমের জয়ের সম্ভাবনা বেড়ে  যায় সেরকম ৮০ টি আসনে লেবার দল তেমন ক্যাম্পেইন করছেনা।  সেজন্যেই দেখা যাবে লিবডেম  দক্ষিণাঞ্চলে কনজারভেটিভের থেকে আসন ছিনিয়ে নেবে, ওদিকে উত্তরাঞ্চলের Red Wall  আসনগুলো যেগুলো  ‘Get Brexit Done’ শ্লোগান দিয়ে কনজারভেটিভ দখলে নিয়েছিল লেবার সেগুলো পুনরুদ্ধার করবে। এছাড়া ২০১৯ সালে অনেক আসনে চরম ডানপন্থী নাইজেল ফারাজের দল প্রার্থী দেয়নি, এবার তারা ঐসব এলাকায় প্রার্থী দিয়েছে। ফারাজের দল অবশ্য first past the post নিয়মের কারণে বেশী আসন পাবেনা ঠিকই কিন্তু কনজারভেটিভের ভোটের সংখ্যা কমিয়ে দেবে।

দু’দিন পরই হতে যাওয়া বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী টিয়ার ষ্টার্মারের জঘন্যতম কাজটি দিয়ে লিখা শেষ করব, তবে তার আগে ষ্টার্মারের আরো একটি ইচ্ছাকৃত বা অনিচ্ছাকৃত ভুলের কথা বলতে চাই। কনজারভেটিভ যে ভুলটি করেছিল লেবার সেই একই ভুল করছে আরও মাত্রা বাড়িয়ে।

আমাদের মনে থাকার কথা,, ২০১০ সাল থেকে ২০১৯ সালে কনজারভেটিভ তার ঝুলিতে যে ভোটারদের জড়ো করেছিল তারা কারা? একবার মধ্যবিত্ত পেশাজীবী; আবার লেবার ও ইউকিপ থেকে দলছুট কিছু ভোটার; তারপর বয়স্ক ও লীভ ভোটার – অর্থাৎ তাঁদের রাজনৈতিক মতাদর্শ ছিল ভিন্ন,  অর্থনৈতিক ও মূল্যবোধও ছিল ভিন্ন। কাজেই এই কুড়িয়ে যোগাড় করা ভোটারদের কনজারভেটিভের গ্লু দিয়ে আটকে রাখা সম্ভব হয়নি। ‌তাঁরা দ্রুত ছিটকে পড়ছে – এটাই স্বাভাবিক ঘটনা। কনজারভেটিভ তো একেক নির্বাচনে একেক গোষ্ঠীকে ভোটার হিসেবে টেনে নিয়েছে। লেবার কিন্তু তার চাইতে এক ডিগ্রি বাড়িয়ে কিছু করেছে। লেবার এবার একই সময়ে বিভিন্ন গোষ্ঠীকে টেনে নিয়েছে যা এক অর্থে বিপজ্জনক।

এবার যারা লেবারকে ভোট দেবেন তাঁরা ভিন্ন মতাদর্শের মানুষ, তারা এক ছাতার তলায় এসেছে শুধু টোরী খেদাও sentiment থেকে। তাদের চাওয়া পাওয়া ভিন্ন। একটি ঢেউ আসলে কালক্ষেপন  না করে তাঁরা ভেসে যাবে অন্য কোথাও।  যারা একই মতাদর্শে বিশ্বাসী না, সে ধরনের ভোটাররা খুবই volatile হয়। লেবার যে লিবডেমের সাথে অপ্রকাশিত কোয়ালিশন করেছে যা শুধু কনজারভেটিভকে নি:শেষ করার জন্যে করা হয়েছে, সেই লিবডেম যে লেবারের ম্যানিফেস্টো পূর্ণ করতে বাধা হয়ে দাঁড়াবে না – তা-ই বা কে বলতে পারে! যে নাইজেল ফারাজের সাথে অপ্রকাশিতভাবে প্যাক্ট করে অর্থাৎ ফারাজকে বহু আসনে প্রার্থী দেওয়া থেকে বিরত রেখে বিপুল ভোটে বরিস জনসন ২০১৯ সালে বিজয় পেল, সেই নাইজেল ফারাজই যে ক’বছরের মাথাতেই কনজারভেটিভকে ছিঁড়ে ফেলতে লেগে যাবে তা কী বরিস জনসন জানতেন? এবার কিয়ার ষ্টার্মার যে লিবডেমের সাথে অপ্রকাশিত প্যাক্ট করে কনজারভেটিভ কে ধূলিসাৎ করছে সেই লিবডেম যে বছর না ঘুরতেই লেবারের ম্যানিফোষ্টো বাস্তবায়ন করতে বাধা দেবে না – তার কি নিশ্চয়তা আছে? লিবডেম ও লেবারের ম্যানিফেষ্টোর পার্থক্যগুলোর দিকে লক্ষ্য করলে তা বুঝতে অসুবিধা হবার কথা নয়। লেবার যে নির্বাচনের আগে লিবডেমের সাথে মিলে sand castle তৈরীর করছে – তা ভেসে যাবে এক ঢেউয়ে। আমরা যেন এক sand castle রাজনীতির আবর্তে পড়ে গেলাম যেখানে একটা ঢেউয়ে sand castle ভেসে যায় খুব দ্রুত।

এবারের নির্বাচনে  ঘৃণ্যতম একটি কাজ করেছে টিয়ার ষ্টার্মার। এটা তো আমাদের জানা আছে কীভাবে কনজারভেটিভ নাইজেল ফারাজকে অনুসরণ করে ধীরে ধীরে কেবল ডানে সরে যাচ্ছিল যার মাশুল তারা দিচ্ছে এই নির্বাচনে। কিন্তু বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাবে জেনেও পুরো প্রাক নির্বাচনী  ও নির্বাচনী প্রচারণার সময় একবারও টিয়ার ষ্টার্মারের মুখে কী শোনা গেছে যে, ফারাজ যা করছে তা চরম রেসিজম? ষ্টার্মারের মুখে কখনো কী  আমরা শুনেছি  যে, বৃটেন একটি বহুজাতিক দেশ এবং নাইজেলের বক্তব্য অ-বৃটিশ; বৃটিশ মূল্যবোধের সাথে এটি যায় না; ফ্রান্সে যা ঘটছে, জার্মানিতে যা ঘটছে – আমাদের বৃটেনের  মাটিতে তা ঘটতে দেওয়া যাবেনা? প্রতিদিন নাইজেল ফারাজের মুখে রেসিষ্ট মন্তব্য শুনেও কিয়ার ষ্টার্মারও এ ব্যাপারে টু শব্দটি করেননি বরং সুযোগ বুঝে সংখ্যালঘু বাংলাদেশীদের উদ্দেশ্য করে অভিবাসন বিরোধীদের একটু সন্তুষ্ট করার চেষ্টার সুযোগ হাতছাড়া করেননি।

প্রশ্ন হচ্ছে, উগ্র ডানপন্থীর আবির্ভাব কী ইউকেতে এই প্রথম? অতীতে কী কখনো বৃটেন এ ধরনের উগ্র ডানপন্থীকে মোকাবেলা করেনি? ১৯৬৮ সালে যখন কনজারভেটিভ দলের শ্যাডো ডিফেন্স সেক্রেটারি ইনক পাওয়েল তাঁর River of Blood বক্তৃতায় চরম racist বক্তব্য রাখেন তখন কাল বিলম্ব না করে এডওয়ার্থ হিথ পাওয়েলকে দলচ্যূত করেন। নাইজেল ফারাজকে ইনক পায়েলের প্রোটোটাইপ বলা যায়। নাইজেল ফারাজ প্রকাশ্যে ইনক পায়েলের প্রশংসা করেছেন। এই নির্বাচনে কৃতকর্মের ফল হিসেবে ঋষি সুনাকের বিদায় ঘন্টা বাজছে, তাই বলে এত মানুষের ম্যান্ডেট নিয়ে নিশ্চিত বিজয়ের অপেক্ষায় ষ্টার্মারের কী কোনোই দায় ছিল না? কোন্ ধরনের বৃটেন তিনি গড়তে চান? যেভাবে প্রত্যক্ষভাবে নাইজেল ফারাজের পার্লামেন্টে প্রবেশের পথ খোলাসা করে দিয়েছেন কিয়ার ষ্টার্মার ইতিহাস কী এজন্যে তাঁকে ক্ষমা করবে? ক্ল্যাকটনে লেবার দল থেকে যে তরুণ সম্ভাবনাময় প্রার্থী ছিল, নাইজেল ফারাজ ঐ আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার সিদ্ধান্ত নিলে ফারাজের বিজয় নিশ্চিত করতে কিয়ার ষ্টার্মার নিজে আদেশ দিয়েছেন সেই লেবার প্রার্থী যেন ঐ এলাকা থেকে সরে দাঁড়ান। শুধু তা-ই নয়, ফারাজের নির্বাচনী এলাকায় যেন লেবারের কোনো ক্যাম্পেইন না হয়, কোনো লিফলেট বিলি না হয় এবং ঐ আসনের জন্যে লেবারের পক্ষে যেন সামাজিক মাধ্যমেও কোনো প্রচারণা না হয় সে ব্যাপারেও নির্দেশ দিয়েছেন। এক কথায় চরমপন্থীদের বৃটেনের রাজনীতিতে আনুষ্ঠানিকভাবে যিনি সুযোগ করে দিয়ে বৃটেনের বহু দিনের রাজনীতির  ল্যান্ডস্কেপটাই পাল্টে দিলেন তিনি এই কিয়ার ষ্টার্মার! ষ্টারমারের, এবারের নির্বাচনের শ্লোগান হচ্ছে, change এবং turn the page কিন্তু পাতা উল্টিয়ে এ কোন্ পৃষ্ঠায় আমরা পড়ছি এ প্রশ্ন আসবে এবং বার বার আসবে।।

……………………..

লেখক Dr Zaki Rezwana Anwar FRSA একজন চিকিৎসক, জনপ্রিয় সিনিয়র সংবাদ পাঠক, বিশ্লেষক ও কলামিস্ট।