যে স্বপ্নের জন্য শিক্ষার্থীরা জীবন দিয়েছে, তা বাস্তবায়ন করবোই : প্রধান উপদেষ্টা
বিশেষ সংবাদদাতা :
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, নতুন করে প্রতিজ্ঞা করতে হবে, যে স্বপ্নের জন্য শিক্ষার্থীরা জীবন দিয়েছে, সেই স্বপ্ন বাস্তবায়ন করবোই। এর থেকে আমাদের বের হওয়ার সুযোগ নেই।
রোববার (৯ সেপ্টেম্বর) দুপুরে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে মতবিনিময়কালে ড. মুহাম্মদ ইউনূস এ কথা বলেন। সরকার গঠনের পর ছাত্রদের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক প্রথম বৈঠক ছিল এটি।
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, যে স্বপ্ন বাস্তবায়নে ছাত্ররা জীবন দিল, আমাদের যোগ্যতা-ক্ষমতা না থাকতে পারে কিন্তু সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নের প্রতিজ্ঞা থেকে আমাদের সরে যাওয়ার সুযোগ নেই। আমরা সেই স্বপ্ন বাস্তবায়ন করবোই।
তিনি বলেন, যখনই হাসপাতালে আহতদের দেখতে যাই তখনই কষ্ট পাই। তরুণ ছেলে-মেয়েরা কীভাবে ছিন্নভিন্ন হয়ে পড়ে আছে। কারও মাথা আঘাত, কারও হাত-পা চলে গেছে। এ সময় রংপুরে নিহত আবু সাঈদের প্রসঙ্গ টেনে ড. ইউনূস বলেন, রংপুরে একজন তাজা তরুণ মরলো। ফুটফুটে একটা ছেলে। কীভাবে তাকে প্রাণ হারাতে হলো।
আহত আরেক শিক্ষার্থীর স্মৃতিচারণ করে বলেন, ছেলেটির পা কেটে ফেলা হয়েছে। সে ক্রিকেটপাগল। ক্রিকেটার হতে চেয়েছিল। আমাকে দেখে জিজ্ঞেস করে স্যার আমি ক্রিকেট খেলবো কীভাবে? পা নেই, কিন্তু মাথা থেকে ক্রিকেট যাচ্ছে না। এ সময় আবেগতাড়িত হয়ে পড়েন প্রধান উপদেষ্টা। বলেন, যতবার দেখি এসব, ততবারই একটি প্রশ্ন মাথায় জাগে এই বাংলাদেশ আমরা বানিয়েছিলাম? কালকে একটা হাসপাতালে গেলাম, আবার সেই দৃশ্য। তরুণ প্রাণ, অনেকের মাথার খুলি উড়ে গেছে। অনেকের শরীরে গুলি রয়ে গেছে। বেঁচে আছে।’
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, যতবার শুনি, যতবার দেখি, আবার নতুন করে প্রতিজ্ঞা করতে হয়, যে স্বপ্নের জন্য তারা প্রাণ দিয়েছে সেই স্বপ্নকে আমরা বাস্তবায়ন করব। এটা থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই।
তিনি বলেন, আমি সাক্ষাতের সময় যে দৃশ্য দেখছি সেটা তো সবাই দেখছে না। যারা হাসপাতালে আসছেন তারা হয়তো অনুধাবন করতে পারছে। মানুষকে জানাতে হবে, বোঝাতে হবে। কী নৃশংসতা ছিল।
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, তরুণরা অকাতরে প্রাণ বিলিয়ে দিয়েছে বলেই বাংলাদেশ আজ এ পর্যায়ে এসেছে। তাদের ত্যাগের বিনিময়ে দেশ গড়ার যে সুযোগ পাওয়া গেছে- এ সুযোগের সর্বোচ্চ সদ্ব্যবহার করতে হবে।
ড. ইউনূস বলেন, বাংলাদেশকে এমনভাবে গড়তে হবে যাতে বিশ্বে সম্মানিত রাষ্ট্রের মর্যাদা পায়। দেশ গড়ার যে কাজ তরুণরা শুরু করেছে, সে সুযোগ কোনোভাবে নষ্ট হলে সর্বনাশ হবে বলেও মন্তব্য করেন প্রধান উপদেষ্টা।
শিক্ষার্থীদের বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা চুপচাপ বসে থাকবে না বলে মন্তব্য করে তিনি বলেন, এতদিন চুপচাপ শুয়ে শুয়ে স্বপ্নের মধ্যে আনন্দ সহকারে লুটপাট করে যাচ্ছিল। তাদের স্বপ্ন শিক্ষার্থীরা ভেঙে দিয়েছে। তারা কী এখন চুপচাপ বসে থাকবে? মোটেও না। খুব চেষ্টা করবে, তোমাদের দুঃস্বপ্নের মধ্যে লুকিয়ে দেওয়ার জন্য। তারা চেষ্টার ত্রুটি করবে না। যেটা শুরু করছো, সেই কাজ সমাপ্ত না হওয়া পর্যন্ত এখান থেকে বেরিয়ে যেও না।
ড. ইউনূস বলেন, বাংলাদেশের জন্ম থেকে এই সুযোগ আর আসেনি। শিক্ষার্থীদের দেখছি আর ভাবছি, কী একটা স্বপ্ন আমাদের সামনে, জাতির সামনে তোমরা নিয়ে এসেছ। যে সুযোগ তোমরা আমাদের হাতে তুলে দিয়েছ, এটা যেন হাতছাড়া না হয়। এই সুযোগ হাতছাড়া হলে বাংলাদেশ আর রাষ্ট্র থাকবে না। এটা শুধু রাষ্ট্র না, পৃথিবীর সম্মানিত রাষ্ট্রে যেন পরিণত হয়।
ছাত্র-জনতাকে সজাগ থাকার আহ্বান জানিয়ে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, এতদিন চুপচাপ শুয়ে-বসে স্বপ্নের মধ্যে এরা ছিল। আর শান্তিতে আনন্দ সহকারে লুটপাট করে যাচ্ছিল। হঠাৎ করে তোমরা বের হলে। তারা কি চুপচাপ বসে থাকবে? খুব চেষ্টা করবে আবার তোমাদের দুঃস্বপ্নের মধ্যে ঢুকিয়ে দেওয়ার জন্য। যাতে তারা শান্তিতে আবার তাদের রাজত্ব চালাতে পারবে। তারা চেষ্টার ত্রুটি করবে না।
ড. ইউনূস বলেন, কাজেই যে কাজ শুরু করেছো, এই কাজ সমাপ্ত না হওয়া পর্যন্ত এর থেকে বেরিয়ে যেও না। তাহলে সব নষ্ট হয়ে যাবে।
বাংলাদেশের জন্ম থেকে রাষ্ট্র সংস্কারের সুযোগ এমন সুযোগ আর আসে নাই মন্তব্য করে প্রধান উপদেষ্টা বলেন,বাংলাদেশের জন্ম থেকে আজ পর্যন্ত এই সুযোগ আর আসে নাই। এই সুযোগ তোমরা আমাদের হাতে তুলে দিয়েছো। এই সুযোগ যেন হাতছাড়া না হয়।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে পাওয়া রাষ্ট্র সংস্কারের সুযোগ প্রসঙ্গে ড. ইউনূস বলেন, এই সুযোগ হাতছাড়া হলে বাংলাদেশের আর কোন ভবিষ্যৎ থাকবে না। এটা কোনো রাষ্ট্র আর থাকবে না। কাজেই এটা যেন শুধু রাষ্ট্র না, পৃথিবীর সম্মানিত রাষ্ট্র হিসেবে পরিণত হয়।
বাংলাদেশকে বিশ্বে অনন্য রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যের কথা জানিয়ে তিনি বলেন, যেহেতু তরুণরা এটার (বাংলাদেশের) হাল ধরেছে, এ কারণেই এটা অনন্য। অনন্য একটা দেশ আমরা তৈরি করতে চাই। দুনিয়ার মানুষ এটা এসে দেখে যাবে। তোমাদের কাছে শিখতে আসবে, তোমাদেরকে নিয়ে যাবে। বলবে কি মন্ত্র দিয়ে তোমরা এটা করেছো।
বৈষম্য-অবিচার-লুটপাটের বিরুদ্ধে তরুণদের সংস্কারের চেতনা ধরে রাখার আহ্বান জানিয়ে ড. ইউনূস বলেন, এই মন্ত্র হয়তো তোমরাও টের পাচ্ছ না। মন্ত্রটা কীভাবে এলো। এটা একটা বিরাট মন্ত্রের মতো কাজ করেছে। এই মন্ত্রকে ধরে রাখবে। এই মন্ত্র যদি শিথিল হয়ে যায়, আমাদের কাজ শেষ করতে পারবো না। সেই দুঃখ যেন আমাদের দেখতে না হয়।
অন্তর্বর্তী সরকার ছাত্র-জনতার স্বপ্ন থেকে দূরে সরে গেলে স্মরণ করিয়ে দেওয়া আহ্বান জানিয়ে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, তোমরা নিজ নিজ চিন্তায় অনড় থাকো। যে যত পরামর্শ দিক এটা থেকে বেরিয়ে আসার। এই পরামর্শ তোমরা গ্রহণ করো না। তোমাদের চিন্তা স্বচ্ছ, তোমাদের চিন্তা সঠিক।
ড. ইউনূস বলেন, আমাদেরকে স্মরণ করিয়ে দেবে যদি আমরা এই স্বপ্ন থেকে দূরে সরার কোন কাজ করি। আমাদের কারো কোন ইচ্ছে নাই এই স্বপ্নের বাইরে যাওয়ার। স্বপ্ন বাস্তবায়ন করাই হবে সার্বক্ষণিক কাজ। তবে কোনো কারণে যদি আমরা সীমা অতিক্রম করি কোথাও, আমাদের সঙ্গে সঙ্গে জানিয়ে দিও।