রোহিঙ্গা সঙ্কটের অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যত
Dr Zaki Rezwana Anwar FRSA
বাংলাদেশের জন্যে এ মুহূর্তে যে ক’টি সমস্যা রয়েছে সেগুলোর অন্যতম হচ্ছে রোহিঙ্গা সঙ্কট। এই সঙ্কটের প্রভাব পড়ছে বাংলাদেশশের অর্থনীতি, রাজনীতি, নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্বের উপর এবং এই সমস্যা যে জটিল থেকে জটিলতর হবে – তা সহজেই বলা যায়। কেন আমরা এতদিনে এ সঙ্কটের সমাধান করতে পুরোপুরি ব্যর্থ হলাম; এ সমস্যার সমাধানের পথে কোন কোন বিষয় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল এবং এখন আমাদের করণীয় কি – এসব প্রশ্নের উত্তর খোঁজা জরুরী।
আমাদের মনে থাকার কথা ২০১৬ সালে মিয়ানমার মিলিটারি জান্তাদের দ্বারা অবর্ণনীয় অত্যাচার ও গণহত্যার পরে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে প্রবেশের পরে কফি আনান কমিশনের রিপোর্ট প্রকাশ করা হয়েছিল। এই রিপোর্ট প্রকাশ করার দু’দিনের মাথায় আর্সার হামলা দমনের নামে সব চাইতে বড় নৃশংসতা ঘটাল মায়ানমার সেনাবাহিনী। গ্রামের পর গ্রাম পুড়িয়ে কোনো বাড়ীঘরের অস্তিত্ব রাখা হয়নি এবং রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেওয়ার লক্ষ্যে তাঁদের বসত বাড়ীর খবর নিয়ে পরিচয়ের সত্যতা যাচাই করার যে বিষয়টি ছিল তাও করা তখন অসম্ভব হয়ে পড়েছে – এই অজুহাত মিয়ানমার আমাদের সামনে হাজির করল।
প্রশ্ন হল এর পরে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে কি কোনো ধরনের জোরালো পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছিল? সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অবশ্য জাতিসংঘে ৫টি পয়েন্টের কথা উল্লেখ করেছিলেন যেখানে ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছিল যে, রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তার আশ্বাস দিয়ে ফিরিয়ে নিতে হবে ও ভবিষ্যতে যেনো আবার বাংলাদেশে তাঁদের অনুপ্রবেশ না ঘটে তার বন্দোবস্ত করতে হবে। অথচ পরে কোনো এক অদৃশ্য কারণে চুক্তি করার সময় বাংলাদেশ সরকার সে পয়েন্টগুলোর দিকে মোটেও জোর দেয়নি। বিভিন্ন সময়ে রোহিঙ্গা সঙ্কটের সমাধানের জন্যে বুদ্ধিমত্তা, সাহস, দেশপ্রেম ও সার্বভৌমত্বের পরিচয় দিয়ে আমাদের পররাষ্ট্রনীতি কতটুকু ভূমিকা রাখতে পেরেছে? রোহিঙ্গা ইস্যুতে সর্বশেষ চুক্তিটিও অত্যন্ত খারাপ একটি চুক্তি ছিল।
রোহিঙ্গা ইস্যু কোনো সাধারণ রিফিউজি সমস্যা নয়। বাংলাদেশের উচিত ছিল শুরুর দিকে যখন পুরো বিশ্ব মিয়ানমারের প্রতি নিন্দা জানাচ্ছিল তখন লোহা গরম থাকতেই মায়ানমারকে গণহত্যাকারী হিসেবে চিহ্নিত করে আন্তর্জাতিক ক্রিমিনাল কোর্টে নেওয়ার চেষ্টা করা। অথচ আমরা এটিকে রিফিউজি সমস্যা বানিয়ে দ্বিপাক্ষিক আলোচনা শুরু করলাম। শুধু চীনের দেওয়া ফর্মুলা অনুযায়ী বার বার একই ভুল করা হয়েছে। অবাক কান্ড হল, চীনের সহায়তায় মিয়ানমার দ্বারা সৃষ্ট যে সমস্যা তার সমাধান করতে বাংলাদেশ চীনেরই দ্বারস্থ হয়েছিল। শুধু কি তা-ই? মিয়ানমারের যে সামরিক জান্তা বাংলাদেশকে এহেন বিপর্যয়ের মধ্যে ফেলে দিল তাদের সামরিক মহড়া দেখতে মিয়ানমারে সফর করল বাংলাদেশ। ভারত ও পাকিস্তান সেই মহড়ায় যেতে পারে, তাদের যাওয়ার কারণ রয়েছে কিন্তু বাংলাদেশশের সেখানে যোগ দেওয়ার কি প্রয়োজন ছিল?
গোড়ার প্রশ্ন হচ্ছে, মিয়ানমার কেন বাংলাদেশের সাথে এমন আচরন করল? কারণ মিয়ানমার তা করতে পেরেছে। মিয়ানমার দেখেছে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির মধ্যে কোনো muscle power নেই, বাংলাদেশশের পেছনে কোনো শক্তিশালী মিত্র নেই। আমরা লক্ষ্য করলে দেখব আজকের বিশ্বে অনেক দেশের পেছনেই শক্তশালী মিত্রদেশ যয়েছে। সিঙাপোর,কসোভো, ইসরাইল ও তাইওয়ান এ দেশেরগুলোর পেছনে যুক্তরাষ্ট্র রয়েছে। মিয়ানমার আরো দেখেছে এই অঞ্চলে চীন তার সাথে রয়েছে, এমনকি বাংলাদেশ যাকে বন্ধুরাষ্ট্র হিসেবে মনে করে সেই ভারতও বাংলাদেশের পরিবর্তে গণহত্যাকারী মিয়ানমারের পাশে দাঁড়িয়েছে।
মিয়ানমার জানে বাংলাদেশ কিছুই করতে পারবেনা। তাই রোহিঙ্গা বিষয়টি মিয়ানমারের প্রায়োরিটির মধ্যে পড়ে না। মিয়ানমার যখন প্রথমবার বাংলাদেশের আকাশ সীমা লঙ্ঘন করল তখন বাংলাদেশ কোনো জোরালো পদক্ষেপ নিল না, দ্বিতীয়বারও কিছু করলনা, তৃতীয়বার বাংলাদেশের আকাশসীমা লঙ্ঘন করার পর বাংলাদেশ ঐ বিমানটিকে ভূপাতিত করতে পারত। তাহলে মিয়ানমারকে একটা বার্তা দেওয়া হত, কিন্তু আমরা মিয়ানমারকে প্রকারান্তরে এমন ইঙ্গিত দিয়েছি যে, আমাদের সাথে যা খুশী করা যেতে পারে। এমন কি তখন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন দ্বায়িত্বশীল কর্মকর্তা মিডিয়াতে এসে বলেছিলেন, “মায়ানমার আমাদের চিরদিনের প্রতিবেশী, তাই তাদের সাথে রূঢ় আচরণ করা যাবেনা।” সকলের সাথে বন্ধুত্ব, কারো সঙ্গে শত্রুতা নয় – এমন কবিতার মত পররাষ্ট্রনীতি দিয়ে আর যাই হোক দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষা করা যায়না।
আসলে আমরা মাঝে মাঝে খুব সহজ, সস্তা ও ভাসা ভাসা বিশ্লেষণ করে থাকি। এর একটি উৎকৃষ্ট উদাহরণ হল, ভারত বাংলাদেশের চারিদিকে ঘিরে আছে, আমরা ভারতের পেটের মধ্যে ঢুকে আছি ইত্যাদি। অথচ আমরা যদি একটু জুম আউট করি তাহলে দেখতে পারব ভারতও কিন্তু তার চির শত্রু পাকিস্তান ও চীন দিয়ে পরিবেষ্টিত রয়েছে।
ফায়ার পাওয়ার ইনডেক্সে বাংলাদেশ মিয়ানমারের চাইতে বেশ নীচে অথচ ২৫ বছর আগেও বাংলাদেশশের অবস্থা এই জায়গায় ছিল না। যদিও বাংলাদেশের রয়েছে বিশাল জনশক্তি। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের নৌবাহিনী সেন্ট মার্টিন দ্বীপ পার হয়ে বহুদূর যেতে পারত। তখন মিয়ানমারের সাহস হত না কিছু করার। এরপরে আমরা যখন কু- রাজনীতি নিয়ে নিজেদের মধ্যে ব্যস্ত তখন মিয়ানমার তাদের সামরিক শক্তি বৃদ্ধি করেছে বহু গুণ। এখন মিয়ানমার সেন্ট মার্টিনের অংশীদারত্ব দাবী করে এবং দু’বার সেন্ট মার্টিনকে তাদের মানচিত্রের মধ্যে ঢুকিয়েও ফেলেছিল। বলা বাহুল্য, যদি যুদ্ধ লেগে যায় তাহলে মিয়ানমারের প্রথম টার্গেট হবে সেন্ট মির্টিন দ্বীপ ও বান্দরবান। আমরা তার জন্যে কতটুকু প্রস্তুত?
সামরিক শক্তি বৃদ্ধির উদ্দেশ্য যে যুদ্ধে লিপ্ত হওয়া তা নয়, সামরিক শক্তি বৃদ্ধি যুদ্ধ ঠেকাতও সাহায্য করে। ফ্রেডরিক উইলিয়ামস বলেছেন, “Diplomacy without arms is like music without instruments.” তাই তো আমরা দেখি একজন মার্কিন কূটনীতিকের কাজ যতটা সহজ, একজন বাংলাদেশী কূটনৈতিকের কাজ ততটা সহজ নয়। এর কারণ হচ্ছে, মার্কিন কূটনীতিক জানেন তাঁর রয়েছে সামরিক শক্তি।
একদিকে চীন তার স্বার্থ নিশ্চিত করতে মিয়ানমারের মিলিটারি জান্তাকেও অর্থ সরবরাহ করে, ওদিকে NUG বা ন্যাশনাশ ইউনিটি গভর্নমেন্টকেও অর্থ সাহায্য করে। কাজেই এখানে চীনের বিনিয়োগ রয়েছে। চীনের কাছে বাংলাদেশের চাইতে মিয়ানমারের কৌশলগত গুরুত্ব বেশী। চীন মিয়ানমারের উপর দিয়ে পাইপ লাইন দিয়ে সরাসরি বঙ্গোপসাগরে প্রবেশের সুযোগ পাচ্ছে এবং রাখাইনে গভীর সমুদ্র বন্দর করে বঙ্গপোসাগরে সমুদ্র জলসীমার খনিজ দাবী করতে তার আর বাধাও থাকছেনা। অন্যদিকে বাংলাদেশকে ভারত অথবা মিয়ানমারের উপর দিয়ে বঙ্গোপসাগরে প্রবেশের সুযোগ দিতে হত চীনকে।
জরুরী প্রশ্নটা হচ্ছে, ভারত বাংলাদেশের বন্ধুরাষ্ট্র হওয়া সত্বেও ভারত কেন বাংলাদেশের পাশে দাঁড়াল না? ভারতের কালাদান প্রজেক্টের জন্যে ভারতের মিয়ানমারকে প্রয়োজন। কালাদান প্রজেক্টে রুটটি কোলকাতা হয়ে বঙ্গোপসাগর হয়ে বঙ্গপোসাগরে মিয়ানমারের সিতওয়া বন্দর হয়ে কালাদান নদী হয়ে মিয়ানমারের উপর দিয়ে পালেতওয়া হয়ে ভারতের সেভেনে সিস্টার্সের মীজোরাম পর্যন্ত গিয়েছে। শিলিগুঁড়ি যা চিকেন নেক হিসেবে পরিচিত সেটিকে বাইপাস করে ভারতের মূল ভূখণ্ডের সাথে সেভেনে সিসটার্সের সাথে যোগাযোগের জন্যে ভারত এই বিনিয়োগ করেছে যাতে চীন কখনো চিকেন নেক আক্রমণ করলে ভারতের সেভেন সিসটার্স যেন ভারতের মূল ভূখন্ড থেকে আলাদা না হয়ে যায়। চীনের সাথে ভারতের সীমান্তে বৈরীতা থাকলেও মায়ানমারকে চীন ও ভারত উভয়েই সাহায্য করছে। এ সাহায্য যে তারা মিলেমিশে এক সাথে করছে তা নয়, এটি তারা করছে আলাদাভাবে বা সমান্তরালভাবে।
অতি বাস্তব কথা হল, এ যুগে আমরা একটি নৈরাজ্যকর পৃথিবীতে বাস করছি যেখানে সবাই যেভাবে পারে নিজের স্বার্থ দেখে চলে। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে যতক্ষণ সমস্যাটা একার থাকে ততক্ষণ কারো মাথা ব্যাথা থাকে না। আমরা আমাদের মাথা ব্যাথাকে অন্যের জন্যে কিছুটা হলেও মাথা ব্যাথা করে তুলতে পারিনি। আমাদের সমস্যা হচ্ছে, আমরা বলছি রোহিঙ্গা ইস্যু একটি আন্তর্জাতিক সমস্যা। এটি একটি ভুল কথা। এটা কারো সমস্যা না, চীনের না, ভারতের না মিয়ানমারের সমস্যাও না। এই সমস্যা কারো প্রায়োরিটির মধ্যে পড়েনা। কারণ, এটিকে আমরা অন্যের সমস্যা করে তুলতে ব্যর্থ হয়েছি। যতক্ষণ আমরা আমদের এই সমস্যাকে সীমান্তের ওপারে পাচার করতে না পারব ততক্ষণ এ সমস্যা আমাদেরই বয়ে বেড়াতে হবে।
আমরা শান্তিপূর্ণভাবে রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান চাইতে পারি কিন্তু যা হবার নয় তা প্রত্যাশা করে লাভ নেই। এ ধরনের সমস্যার সমাধানপ শান্তিপূর্ণভাবে হয় না। কিছুটা সংঘাত হয়েই থাকে। সেই সংঘাতের জন্যে আমাদের সামরিক প্রস্তুতি কতখানি রয়েছে? সব চাইতে যে অশনিসংকেত আমি দেখতে পাচ্ছি তা হচ্ছে, বাংলাদেশ যদি রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠাতে না পারে তাহলে দু’দিন পরে আসামের মুসলমানদের যখন বাংলাদেশে ঠেলে দেওয়া হবে তখন বাংলাদেশ তা কিভাবে ঠেকাবে? রোহিঙ্গাদের রাখলে আসামের মুসলমানদের ঠেকাবেন কোন যুক্তিতে? তাই বাংলাদেশকে আর দেরী না করে এসব বিষয়ে ভাবতে হবে।
এবার সমীকরণে যুক্তরাষ্ট্রকে আনা যাক। যুক্তরাষ্ট্রের প্যাসিফিক ষ্ট্র্যাটেজি থেকে ইন্দো-প্যাসিফিক ষ্ট্র্যাটেজির দিকে ঝুঁকে পড়ার কারণ হল, তাইওয়ানের চারপাশে জলসীমার উপর আধিপত্য ও মালাক্কা ষ্ট্রেইটের ব্যাপারে চীনের যে লক্ষ্য সেটি অনেকাংশে আন্তর্জাতিক জলনীতির লঙ্ঘন তো বটেই, পাশাপাশি এই বলয়ে মার্কিন আধিপত্যের জন্যেও এটি হুমকির কারণ। এদিকে রোহিঙ্গা ইস্যুতে সংঘাতের সৃষ্টি হলে বাংলাদেশের জন্যে এই অঞ্চলে ভারত ও চীনকে পাবেনা বাংলাদেশ । তাই বলে যুক্তরাষ্ট্রকেও যে আমদের অনাদিকাল ফ্রি রাইড দিয়ে যেতে হবে – বিষয়টা এমনও নয়। বিষয়টা হচ্ছে, যতটুকু ও যতদিন আমাদের প্রয়োজন হয়। পররাষ্ট্র নীতি একটি dynamic বিষয়। আমরা ছোট দেশ বলে আমাদের এমন মনে ধারণাটি পোষন করা মানায় না – এ কথাটা ঠিক নয় বরং দেশের স্বার্থে ও পরিবর্তনশীল ভূ-রাজনীতির গতি প্রকৃতির পরিবর্তনের সাথে সাথে বাংলাদেশকেও সেভাবে চলতে হবে। দ্বিতীয়ত বিশ্বযুদ্ধের পরে মিত্র শক্তিগুলো অনেকে বন্ধু থেকে অ-বন্ধু হয়েছে আবার বিপরীত বলয়ের দেশগুলো কৌশলগত কারণে অনেকেMy কাছে এসেছে। সেজন্যেই কূটনীতি-বিদ্যাতে বলে, “Foreign policy is a matter of cost and benefit, not theology” অর্থাৎ পররাষ্ট্রনীতি হচ্ছে, ব্যয় ও সুবিধে বিশ্লেষণের বিষয়, কোনো ধর্ম-বিদ্যা নয়।
………………….
লেখক Dr Zaki Rezwana Anwar FRSA, MBBS, DTM&H, MS & PhDএকজন চিকিৎসক, জনপ্রিয় সিনিয়র সংবাদ পাঠক, রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও কলামিস্ট।