বাংলাদেশের পৌনে ৩ লাখ কোটি টাকা ছাড়াল খেলাপি ঋণ
পোস্ট ডেস্ক :
সুশাসনের অভাব, অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনার কারণে খেলাপি ঋণে জর্জরিত বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাত। দীর্ঘদিন ধরে ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণ ক্রমবর্ধমানভাবে বাড়ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য বলছে, খেলাপি ঋণ প্রথমবারের মতো দুই লাখ ৮৪ হাজার ৯০০ কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে।
এই পরিসংখ্যান গত ১৬ বছরে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ব্যাপক কেলেঙ্কারি ও অনিয়মের শিকার হওয়া ব্যাংক সেক্টরের নাজুক অবস্থাকে তুলে ধরেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের সেপ্টেম্বর শেষে খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে ২ লাখ ৮৪ হাজার ৯৭৭ কোটি টাকা, যা বিতরণ করা ঋণের ১৬ লাখ ৮২ হাজার ৮২১ কোটি টাকার ১৬ দশমিক ৯৩ শতাংশ। শুধু তাই নয় গত ১৬ বছরের মধ্যে বিতরণ করা ঋণ ও খেলাপি ঋণের সর্বোচ্চ অনুপাত এটি।
তথ্য বলছে, গত বছরের জুন পর্যন্ত খেলাপি ঋণ ছিল ২ লাখ ১১ হাজার ৩৯১ কোটি টাকা। অর্থাৎ গত তিন মাসে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৭৩ হাজার ৫৮৬ কোটি টাকা।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) চাপে ব্যাংকগুলোর প্রকৃত তথ্য বেরিয়ে আসতে শুরু করেছে। এতদিন যা স্বার্থান্বেষী মহলগুলোর কারসাজিতে চাপা পড়েছিল। ভবিষ্যতে এর পরিমাণ আরো বাড়তে পারে। কারণ বিশেষ গোষ্ঠীর জন্য প্রণীত নীতিমালাগুলো এখনো বিদ্যমান রয়েছে।
যার সুফল ভোগ করছে একটি শ্রেণি। অতিরিক্ত সুবিধা দিয়ে যে ঋণগুলো নিয়মিত রাখা হয়েছে এই সুবিধা তুলে ফেললে খেলাপি ঋণের পরিমাণ আরো বাড়বে।
এরআগে, গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগের ১৫ বছরের শাসনের অবসান হয়। সেদিন গণঅভ্যুত্থানের মধ্যে পদত্যাগ করে দেশ ছাড়েন শেখ হাসিনা। মূলত তার পদত্যাগের পর ব্যাংক খাতের প্রকৃত তথ্য সামনে আসতে শুরু করেছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
২০০৮ সালের নির্বাচনে যখন আওয়ামী লীগ জয়লাভ করে ক্ষমতায় আসে তখন ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ২২ হাজার ৪৮০ কোটি টাকা। এরপর থেকে আওয়ামী সরকারের আমলে ব্যাংক খাতে অনিয়ম ও কেলেঙ্কারি বাড়তে থাকে। ফলে খেলাপি ঋণও ধারাবাহিকভাবে বাড়তে থাকে।
এদিকে সেপ্টেম্বর শেষে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ২৬ হাজার ১১১ কোটি টাকা, যা তাদের বিতরণ করা ঋণের ৪০ দশমিক ৩৫ শতাংশ।
অন্যদিকে বেসরকারি ব্যাংকগুলোতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৪৯ হাজার ৮০৬ কোটি টাকা, যা তাদের বিতরণ করা ঋণের ১১ দশমিক ৮৮ শতাংশ। বিদেশি ব্যাংকগুলোতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩ হাজার ২৪৫ কোটি টাকা বা বিতরণ করা ঋণের ৪ দশমিক ৯৯ শতাংশ এবং বিশেষায়িত ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৫ হাজার ৮১৩ কোটি টাকা।
খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অক্টোবর-ডিসেম্বর ত্রৈমাসিকে খেলাপি ঋণ আরো বাড়বে। কারণ তারা ধারণা করছেন, আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে প্রভাবশালী ব্যবসায়ী গোষ্ঠীগুলো ভুয়া দলিল ও অনিয়মের মাধ্যমে বড় অঙ্কের ঋণ নিয়েছিল। কিন্তু, সরকার পতনের পর এই ঋণের একটি অংশ খেলাপিতে পরিণত হবে।
তারা বলেন, শুধু এস আলম ও তার সহযোগীরা একাই ছয়টি ব্যাংক থেকে ৯৫ হাজার কোটি টাকার বেশি ঋণ নিয়েছে। ইতিমধ্যে এসব ঋণ মন্দ ঋণে পরিণত হওয়ার প্রক্রিয়ার মধ্যে রয়েছে।
ব্যাংক কর্মকর্তারা বলছেন, অস্থিতিশীল অর্থনৈতিক অবস্থাকে কারণ হিসেবে দেখিয়ে অনেকে ঋণ পরিশোধ করতে চান না। তাদের এই প্রবণতা মন্দ ঋণের বোঝা আরো বাড়াতে পারে।
রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর বিতরণ করা অধিকাংশ ঋণ অনিয়ম ও কেলেঙ্কারির মাধ্যমে নেওয়া হয়েছে, ফলে এসব ঋণ আদায় করা কঠিন হয়ে পড়েছে।
আইএমএফের ৪ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলারের ঋণ কর্মসূচির পরামর্শে খেলাপি ঋণের পরিমাণ কমানোর লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছিল সাবেক সরকার।
আগের সরকারের নির্দেশনা অনুযায়ী, ২০২৬ সালের মধ্যে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ ১০ শতাংশে নামিয়ে আনার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে বাংলাদেশ ব্যাংক। বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর জন্য লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল ৫ শতাংশ।