রমজানের শেষ দশ রাত : ইবাদতে একনিষ্টতা আল্লাহর কাছে সবচেয়ে প্রিয় 

Published: 25 March 2025

শায়খ সৈয়দ আনিসুল হক 

আমরা পবিত্র রমজানের শেষ দশ রাতে প্রবেশ করছি। যে রাতগুলোর মধ্যে লাইলাতুল কদর থাকতে পারে । আমি একটি বিষয় খুবই গুরুত্বের সাথে তুলে ধরতে চাই- যা প্রতিটি ইবাদতকে আল্লাহর কাছে অত্যধিক প্রিয় করে তোলে: তা হলো একনিষ্টতা বা ইখলাছ । এটি আমাদের আল্লাহর সঙ্গে সম্পর্কের মূল ভিত্তি।

কথাগুলো বলেছেন ইস্ট লন্ডন মসজিদের সিনিয়র ইমাম ও খতীব সৈয়দ আনিসুল হক । তিনি ২১ মার্চ শুক্রবার জুমার খুতবা উপস্থাপন করেছিলেন । খুতবার শুরুতে তিনি সহিহ মুসলিম এবং অন্যান্য নির্ভরযোগ্য হাদিস সংকলনে পাওয়া বিখ্যাত একটি হাদিস উপস্থাপন করেন । হাদিসটি হলো: কিয়ামতের দিন প্রথম বিচার করা হবে তিন ব্যক্তির। তারা হলেন একজন শহীদ, একজন আলিম এবং একজন দানশীল ব্যক্তি । বাহ্যিকভাবে, তাদের তিনজনের কাজগুলো মহৎ মনে হয়। যেমন শহীদের জীবন উৎসর্গ করা, আলেমের জ্ঞান ছড়িয়ে দেওয়া এবং দানশীল ব্যক্তির দান-সদকা করা । কিন্তু যখন তারা আল্লাহর সামনে দাঁড়াবে, তখন প্রকাশ পাবে যে, তাদের আমল আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য ছিল না; বরং মানুষের প্রশংসা লাভের উদ্দেশ্যে ছিল।

এরপর আসে সেই হাদিসের সবচেয়ে ভয়ংকর অংশ: তাদের প্রত্যেককে মুখ থুবড়ে জাহান্নামে টেনে নিয়ে যাওয়ার আদেশ দেওয়া হবে।

যে সৎকর্মগুলো তাদের উচ্চ মর্যাদায় পৌঁছে দিতে পারত, সেগুলোই তাদের ধ্বংসের কারণ হয়ে দাঁড়াল। কেন? কারণ তাদের ইখলাস বা একনিষ্ঠতা ছিল না। তাদের নিয়ত ছিল বিকৃত; যা একমাত্র আল্লাহর জন্য হওয়া উচিত ছিল। কিন্তু তারা তা করেছিলো সামাজিক খ্যাতি, স্বীকৃতি এবং প্রশংসা লাভের জন্য।

রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন: “নিশ্চয়ই, সকল কাজ নিয়তের উপর নির্ভরশীল এবং প্রত্যেক ব্যক্তি তার নিয়ত অনুযায়ী প্রতিদান পাবে।” (সহিহ আল-বুখারি, সহিহ মুসলিম)

একনিষ্ঠতা কেবল লোক দেখানো কাজ পরিহার করার নাম নয় । এটি এমন এক অবস্থা, যেখানে আমাদের হৃদয় সম্পূর্ণভাবে আল্লাহর সন্তুষ্টির সঙ্গে নিবেদিত থাকবে ।

ইমাম ইবনুল কাইয়্যিম (রহ.) বলেন: “একাগ্রতা ছাড়া আমল হলো সেই পথিকের মতো, যে নিজের থলিতে বালু বহন করছে। এটি শুধু একটি বোঝা, তা কোনো উপকারে আসে না।”

ইমাম ফুদাইল ইবন ‘ইয়াদ (রহঃ) বলেন: “সবচেয়ে উত্তম আমল হলো সেই আমল, যা সবচেয়ে বেশি একাগ্রচিত্তে ও সঠিক পন্থায় করা হয়। তাকে জিজ্ঞেস করা হলো, “এর অর্থ কী?”

তিনি বললেন, “যদি কোনো আমল আন্তরিক হয় কিন্তু সঠিক পন্থায় না হয়, তবে তা কবুল হবে না। আর যদি তা সঠিক হয়, কিন্তু আন্তরিক না হয়, তবে তাও কবুল হবে না। আমল হতে হবে একাগ্রচিত্তে শুধুমাত্র আল্লাহর জন্য এবং সঠিক সুন্নাহ অনুযায়ী।”

একনিষ্ঠতা একটি বিরামহীন প্রচেষ্টা

একনিষ্ঠতা কেবল একবার অর্জন করলেই চিরস্থায়ী হয়ে যায় না। এটি হৃদয়ের একটি অবিরাম প্রচেষ্টা । শয়তান কখনো বিশ্রাম নেয় না। সে সর্বদা আমাদের প্রশংসা অর্জনের দিকে, খ্যাতি পাওয়ার দিকে, নেতৃত্ব লাভের আকাঙ্ক্ষার দিকে প্রলুব্ধ করতে চায়।

একজন প্রখ্যাত তাবেয়ি সুফিয়ান আত-থাওরি (রহ.) বলেন: “আমি কখনো আমার কোনো বিষয়ের সঙ্গে এত সংগ্রাম করিনি, যতটা আমার নিয়তের সঙ্গে করতে হয়ে। প্রতিবার এটি আমার ওপর পরিবর্তিত হয়ে যায়।”

এমনকি রাসূলুল্লাহ (সাঃ) আমাদের রিয়া (লোক দেখানো আমল) থেকে আল্লাহর নিকট আশ্রয় চাইতে শিখিয়েছেন। তাঁর একটি দু‘আ ছিল: “হে আল্লাহ, আমি জেনে শুনে তোমার সঙ্গে শরিক করা থেকে তোমার কাছে আশ্রয় চাই, এবং যা আমি না জেনে করেছি, তার জন্য তোমার ক্ষমা প্রার্থনা করি।” (মুসনাদ আহমদ)

আল-হাসান আল-বাসরি (রহ.) বলেন: “আল্লাহ সেই বান্দার প্রতি রহম করুন, যে কোনো কাজ করার আগে থেমে নিজেকে প্রশ্ন করে, ‘আমি এটা কেন করছি?’”

আমরা এমন এক যুগে বাস করছি, যেখানে আমাদের ইবাদত প্রকাশ করা স্বাভাবিক হয়ে গেছে। কিন্তু আমাদের মনে রাখা দরকার—সেরা আমল হয়তো সেইগুলোই, যা একমাত্র আল্লাহ ছাড়া কেউ দেখে না। ইমাম আল-গাযালি (রহ.) বলেন: “ইখলাস বা একনিষ্ঠতা হলো অন্তরের সমস্ত অপবিত্রতা থেকে পরিশুদ্ধ হওয়া, যাতে এটি কেবল আল্লাহর সঙ্গে সংযুক্ত থাকে।”

এখন, যখন আমরা একনিষ্ঠতার কথা বলছি, তখন আমরা কি আমাদের হৃদয় গাজা ও ফিলিস্তিনের দিকে ফিরিয়ে নেব না? গত কয়েক দিনে ৬০০-এর বেশি নিরপরাধ মানুষ পুরুষ, নারী, শিশু নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে । যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘিত হয়েছে। জীবন ধ্বংস করা হয়েছে। কষ্ট দেওয়া হয়েছে।

কিন্তু আমরা বিস্মিত নই। কারণ এটাই জালিমদের পথ—তারা চুক্তি ভঙ্গ করে, তারা নির্মমভাবে হত্যা করে। কিন্তু তাদের সময়ও আসবে।

আল্লাহ আমাদের রমজানের রাত, রোজা, সালাত কবুল করুন। আল্লাহ মজলুমদের বিজয় দান করুন। আল্লাহ তাঁর বান্দাদের অন্তরে ইখলাস (একনিষ্ঠতা) দান করুন। আমীন।

শায়খ সৈয়দ আনিসুল হক : সিনিয়র ইমাম, ইস্ট লন্ডন মসজিদ এন্ড লন্ডন মুসলিম সেন্টার