AI ও সাংবাদিকতা: বর্তমান ও ভবিষ্যৎ

Published: 24 April 2025

Dr Zaki Rezwana Anwar FRSA

ছোটবেলায় আমরা অনেকেই ‘The Genie Out of the Bottle’ গল্পটা পড়েছি। গল্পে এক জেলে মাছ ধরতে গেলে তাঁর জালে একটি বোতল ধরা পড়ে। বোতলের মুখ খুলতেই বোতল থেকে বেরিয়ে আসে এক দৈত্য! জেলে বহু চেষ্টা করে দৈত্যেকে আবার বোতলের মধ্যে ভরে ফেলতে সক্ষম হয়। আপনি পছন্দ করেন আর না-ই করেন  Artificial Intelligence বা AI একবার বোতল থেকে বেরিয়ে গেছে, রূপকথার গল্পের জেলের মত AI-কে আপনি আর বোতলে ভরে ফেলতে পারবেন না। জীবনের বহু ক্ষেত্রেই  AI এর প্রভাব পড়ছে এবং এর প্রভাব আগামী দিনগুলোতে আরো বাড়বে। কাজেই AI ভাল কি মন্দ – এটি এখন আর কোনো প্রশ্ন হওয়া উচিত নয়। এখন প্রশ্ন হওয়া উচিত এই AI – কে আমরা কীভাবে আমাদের প্রয়োজন অনুযায়ী ব্যবহার করতে পারি।

অনেক সেক্টরই বুঝে উঠতে পারছেনা যে,  AI এর দ্রুত সম্প্রসারণে তারা কি শঙ্কিত হবে নাকি আশাবাদী হবে? সাংবাদিকতাও এর ব্যতিক্রম কিছু নয়। ঠিক এ কারণেই এ বছর বিশ্ব প্রেস স্বাধীনতা দিবসের প্রতিপাদ্য হচ্ছে: ‘Reporting in the Brave New World – The Impact of Artificial Intelligence on Press Freedom and the Media’।এই প্রতিপাদ্য থেকেই বোঝা যাচ্ছে সাংবাদিকতা তথা মিডিয়ার উপর AI –  এর প্রভাব বর্তমান বিশ্বকে কতটা ভাবিয়ে তুলেছে।

AI কে সঠিকভাবে ব্যবহার করলে এটি হতে পারে মানুষের বুদ্ধিমত্তার জন্যে একটি স্বয়ংক্রিয় যন্ত্র যা দিয়ে আগে প্রচুর সময় ব্যয় করে যেসব কাজ মানুষের হাতে করতে হত সেগুলো অনেক দ্রুত সম্পন্ন করে সাংবাদিকতার কাজ সহজ করা যেতে পারে। আমরা হয়তো ভেবে দেখছিনা, আমরা কিন্তু বেশ কয়েক বছর ধরে AI ব্যবহার করে আসছি। যেমন ধরুন, আমরা অনেকেই AI ব্যবহার করে transcription (প্রতিলিপি) এর কাজ করছি। কোনো একটি অডিও বা ভিডিওর কথাগুলো মুহূর্তের মধ্যে ছাপা হয়ে যাওয়ার যে ব্যবস্থা তা আমরা অনেকেই কাজে লাগাচ্ছি। যেমন ধরুন, আমি গাড়ী চালাচ্ছি বা টিউবে ভ্রমণ করছি, এমন সময় হঠাৎ পত্রিকায় যে কলামটি লিখব বলে ভাবছি সেটি সম্পর্কে একটি আইডিয়া মাথায় আসলে মোবাইলে ভয়েস রেকর্ড করে নিলে পরে তা আমি ছাপার অক্ষরে পেতে পারি। একজন বিশ্বনেতা বক্তৃতা শেষ করার সঙ্গে সঙ্গেই mp3 ফাইল থেকে ছাপার অক্ষরে পুরো বক্তৃতাটি পেয়ে যাই আমরা। এতে অর্থেরও সাশ্রয় হচ্ছে। তাছাড়া ছবির ডেটা যেমন ধরুন,  প্রসিডেন্ট বাইডেনের পোডিয়ামে দাঁড়িয়ে বক্তৃতা দেওয়ার ছবি কিংবা নির্বাচনী প্রচারণার সময় ডোনাল্ড ট্রাম্পের লাল টুপি পরা ছবি পেতে আগে অনেক সময় লেগে যেতো, এখন AI কে কাজে লাগিয়ে  মুহূর্তের মধ্যেই তা পাওয়া সম্ভব।

এটা মনে রাখতে হবে যে, AI কে সাংবাদিকতায় কখনোই সরাসরি একটি সত্যের বিকল্প হিসেবে ব্যবহার করা উচিত নয়। AI – এর তৈরী করা কোনো কন্টেন্টকে আমরা সরাসরি প্রচার করে দিলে সেটিকে কোনো সাংবাদিকতা বলা যাবে না, বিশেষ করে যদি তা ঘটনার বয়ানকেই পরিবর্তন করে দেয় তাহলে একজন সাংবাদিক ও দুষ্টু চক্রের সাথে জড়িত একজন লোকের মধ্যে কোনো পার্থক্য থাকবে না। এমনটি করলে তাঁকে আর সাংবাদিক বলা যাবে না।

তবে যে কথাটি নিয়ে এখনো তেমন আলোচনা হচ্ছেনা অথচ এটিই সবচাইতে আলোচনার বিষয় হওয়া উচিত তা হচ্ছে, ‘জেনারেটিভ এআই। জেনারেটিভ এআই হচ্ছে এমন একটি AI যা টেকস্ট, ছবিসহ কন্টেন্ট বা খবর যা একজন মানুষের নির্দেশে তৈরী হয়ে যায়। আদেশ পেলে জেনারিটিভ এআই ফর্দমত তাকে যা বলা হবে তা-ই তৈরী করে দেবে এবং তাঁর সাথে আপনি কথাবার্তাও বলতে পারবেন। আমাদের মনে থাকার কথা ২০২৩ সালের মার্চ মাসে সামাজিক মাধ্যমে ছবিসহ ডোনাল্ড ট্রাম্পের গ্রেফতার হওয়ার সংবাদটি কিভাবে প্রচার পেয়েছিল।

এআই জেনারেটেড ফেক সংবাদ যদি মূলধারার মাধ্যমে প্রচার করা  হয় তাহলে দেশ তথা পৃথিবীময় গলযোগের সৃষ্টি হতে পারে। আরো একটি বিপজ্জনক ব্যাপার হবে যদি একজন বিশেষজ্ঞের কথা বা কন্টেন্ট নিয়ে সেটিকে পরিবর্তন করে গণমাধ্যমে প্রচার করা হয় তাহলে সেই তথ্যকে অনেকেই বিশ্বাস করে বিভ্রান্ত হবে। ধরা যাক জিম ক্রেমারের কথা। তিনি যুক্তরাষ্ট্রে CNBC তে Mad Money র উপস্থাপক যিনি হেজ ফান্ড ম্যানেজার ছিলেন, গেল্ডম্যান সেক্সে উচ্চ পদে কর্মরত ছিলেন এবং Get Rich Carefully বইয়ের লেখক। এখন তাঁর কোনো একটি কন্টেন্ট নিয়ে সেটিকে পরিবর্তন করে প্রচার করা হলে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থ বাজারে এমন বিভ্রান্তির সৃষ্টি হতে পারে যাতে শুধু যুক্তরাষ্ট্র নয় সমগ্র বিশ্বের অর্থ বাজারে বিপত্তি নেমে আসবে। তেমনি বৃটেনে মার্টিন লুইস যিনি সব সময় মিডিয়াতে অর্থনৈতিক উপদেশ দেন তাঁর কোনো বক্তব্যকে তুলে নিয়ে যদি পরিবর্তন করে প্রচার করা হয় তাহলে কী পরিণতি হতে পারে! অর্থাৎ এ ধরনের অপকর্মের প্রভাব বাস্তব জীবনে অপরিসীম। আগে এডিটরিয়েল টীমের প্রচুর সময় ব্যয় করে এ ধরনের ফেক নিউজের সত্যতা যাচাই করতে হতো। এখন এই সত্যতা যাচাইয়ের কাজটিও AI করে দিতে পারে অত্যন্ত দ্রুত।

AI সংবাদ কক্ষের ব্যয়কে অনেকাংশে কমিয়ে দেয়। Fox, CNBC বছরে তাদের সংবাদ কক্ষের পেছনে ২.৫ বিলিয়ন ডলার খরচ করে। এদিকে চ্যানেল ওয়ান নামে একটি নতুন এআই জেনারেটেড  চ্যানেল চালু হয়েছে যেখানে প্রযোজক, সম্পাদক, ক্যামেরা পার্সন ও সংবাদ পাঠক সবই এআই জেনারেটেড। তাতে ব্যায়বহুল প্রযুক্তির খরচও কমিয়ে আনা হয়েছে। এই AI জেনারেটেড চ্যানেলটি বর্তমানে বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যম থেকে সংবাদ চিত্র ও সংবাদ সংগ্রহ করে এবং এআইকে নির্দেশ দেয় তাঁদের সংবাদের কাঠামো কেমন হবে, সংবাদের ষ্টাইল কেমন হবে, কোন্ সংবাদ পরিবেশনায় কীরকম ভয়েস ওভার  লাগবে।

একদিকে যেমন  AI দ্বারা তৈরী মিসইনফরমেশন, ফেইক নিউজ,পক্ষপাতদুষ্ট সংবাদ, নজরদারির অভাব – সবকিছু সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে এক বিরাট হুমকি হিসেবে দাঁড়িয়েছে, অন্যদিকে অনুসন্ধানী রিপোর্টিং-এর মান বাড়ানোর ক্ষেত্রে AI সাহায্যকারীর ভূমিকা পালন করতে পারে। এর একটি সাম্প্রতিক উদাহরণ মনে করা যেতে পারে। সম্প্রতি ‘দ্যা নিউইয়র্ক টাইমস’- এর গাজার  উপর অনুসন্ধানী রিপোটটি করা সম্ভব হয়েছিল AI – এর সাহায্যে। AI – এর মাধ্যমে গাজার যেসব জায়গায় ইসরায়েলীদের বোমা বর্ষণের ফলে গর্ত হয়ে গিয়েছিল সেগুলো ছবির মাধ্যমে ধরা পড়েছিল।এভাবে যে কোনো কারণে যেসব জায়গায় স্বশরীরে যাওয়া সম্ভব হয়না সেসব জায়গার তথ্য উদ্ধার করে অনুসন্ধানী রিপোর্ট করা সম্ভব।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, AI কি তাহলে একটি প্রতিস্থাপনকারী প্রযুক্তি? আমি মনে করি AI  প্রতিস্থাপনকারী নয়, বরং সাহায্যকারী প্রযুক্তি। AI আগের কাজের পদ্ধতি বা মানুষের কর্মপ্রবাহকে প্রতিস্থাপিত করবে কিন্তু মানুষকে প্রতিস্থাপিত করবে না। মানুষের দ্বারা এটি মনিটর করা, মানুষের এমন সম্পৃক্ততা থাকতেই হবে যাতে আমরা নিশ্চিত হতে পারি যে AI সঠিকভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। সাংবাদিকদের জন্যে AI এর উপকারিতা অনেক। যে কাজগুলো আগে সময় লাগিয়ে বেশ কয়েকজন মিলে করত তা এখন এআইকে দিয়ে অল্প সময়ে করিয়ে নেওয়া সম্ভব। একটি বড় লেখার সারাংশ তৈরী করা, একটি মিটিং এর পরে সেটির উপসংহার তৈরী করা, একটি ছবিকে আপস্কেল করে গ্রহীতাদের কাছে আবেদন সৃষ্টি করা – এ কাজগুলো এআই ছাড়া করতে প্রচুর সময়ের প্রয়োজন হয়। তবে বিষযবস্তু সম্পর্কে ধারণা না রেখে হঠাৎ করে শূন্যের মধ্যে এআই এর কন্টেন্ট ব্যবহার করা উচিত নয়। তাহলে সাংবাদিকরা নিজেরাই নিজেদের এমন একটি পর্যায়ে নামিয়ে নিয়ে আসবে যেখানে তারা নিজেরাই প্রমাণ করবে যে তারা একটি যন্ত্রের চাইতে উন্নতমানের কিছু নয় – সেক্ষেত্রে তারা নিজেরাই নিজেদের চাকরী যন্ত্রের হাতে তুলে দেবে। সংবাদ মাধ্যমে কিছু লোক যেমন চাকরী হারাবে তেমনি নতুন করে কিছু পদ তৈরী হবে। তবে বোদ্ধা সাংবাদিকের গুরুত্ব থাকবেই। কাজের সুবিধার জন্যে যতই AI ব্যবহার করা হোক না কেন সংবাদের একটি জারিনীলিষ্টিক মূল্য থাকতে হবে। AI কোনো শর্টকাট সাংবাদিকতা নয়।

সাংবাদিকদের কি  AI -কে ভয় পাওয়া উচিত? মোটেও না। সাংবাদিকদের কি AI  সম্পর্কে সচেতন ও সাবধানী হওয়া উচিত? অবশ্যই! সাংবাদিকতা করবে সাংবাদিক, AI  নয়। এডিটরিয়াল মান রক্ষার জন্যে বোদ্ধা সাংবাদিকের প্রয়োজন ফুরিয়ে যাবেনা। অনেক প্ল্যাটফর্ম যেমন মেটা ও এক্স ফ্যাক্ট চেকিং থেকে সরে এসেছে। ধীরে ধীরে সবাই যখন তা জানতে পারবে, বুঝতে পারবে তখন যারা fact checked source থেকে তথ্য নিয়ে তার সাথে নিজেদের অর্জিত জ্ঞান মিলিয়ে গবেষণামূলক সম্পাদকীয় লিখবেন তাঁদের লেখার মূল্য থাকবেই। যে মাধ্যম fact based তথ্য পরিবেশন করে বলে আস্থাভাজন করবে আগামী দিনগুলোতে সেসব মাধ্যমকে লোকে নির্ভরযোগ্য মনে করবে বেশী।

বর্তমানে যে  AI দ্বারা তৈরী মিথ্যা তথ্য ও, সংবাদ বানের জলের মত  সাংবাদিকতার বাস্তুতন্ত্রের মধ্যে ঠুকে পড়েছে সেটি মূলত দুষ্টু চক্রের লোকজন দ্বারা এআই-এর অপব্যবহারের কারণে। আসল সমস্যা হচ্ছে, AI টেকনোলজি এত দ্রুত সম্প্রসারিত হচ্ছে এবং এত দ্রুত যে পরিমাণ অর্থ এতে বিনিয়োগ করা হচ্ছে – সেই গতির সঙে তাল মিলিয়ে এ সংক্রান্ত প্রয়োজনীয় আলোচনা যেমন: সামাজিক আলোচনা ও নৈতিক আলোচনার মাধ্যমে নৈতিক নির্দেশনাগুলো স্থির করার কার্যক্রম প্রণয়ন করা হয়ে উঠছেনা। এই নির্দেশনাগুলো স্থির করতে হলে প্রযুক্তির বর্তমান নয়, ভবিষ্যতকে আঁচ করে নীতিমালা নির্ধারণ করতে হবে।

আমাদের মনে রাখতে হবে, সঠিক সংবাদ পাওয়া যে জনগণের অধিকার সেই সত্যটিকে বাস্তবে প্রতিষ্ঠিত করার কাজটি আগের যে কোনো সময়ের চাইতে এখন বেশী প্রয়োজনীয় হয়ে পড়েছে। প্রেস ফ্রিডম ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধকে খর্ব  না করে বর্তমান যুগে AI -কে ভয় না পেয়ে একে আয়ত্তে এনে সাংবাদিকতাকে যেন আরও শক্তিশালী করা যায় – সেটিই আমাদের উদ্দেশ্য হওয়া উচিত। অর্থাৎ AI কেই নিযুক্ত করতে হবে AI দিয়ে দুষ্টু চক্রের দুষ্কর্মগুলোকে যাচাই করার কাজে। AI দ্বারা তৈরী মিথ্যা সংবাদের পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে  AI -এর সাহায্য নিয়েই দ্রুত ফ্যাক্ট চেক ককতে হবে – অর্থাৎ যাকে বলে  Fight fire with fire.

…………………..

লেখক Dr Zaki Rezwana Anwar FRSA, MBBS, DTM&H, MS & PhD একজন চিকিৎসক, জনপ্রিয় সিনিয়র সংবাদ পাঠক, কলামিষ্ট ও পাবলিক স্পীকার।