"নিষেধাজ্ঞা দিয়ে কোন কিছু দাবিয়ে রাখা যায়না, ঐতিহাসিক সাতই মার্চের ভাষণ মুছে ফেলা সম্ভব নয় "
লন্ডনে মহাসমারোহে প্রদর্শিত হলো দ্রোহের চলচ্চিত্র ‘মাইক’

Published: 30 April 2025

নিলুফা ইয়াসমীন হাসান, লন্ডন: বঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ এবং মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম শ্লোগান ‘জয় বাংলা’ নিষিদ্ধ করেছিল পঁচাত্তর পরবর্তী সরকার। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারও একই কাজ করেছে। কিন্তু নিষেধাজ্ঞা দিয়ে কোন কিছু দাবিয়ে রাখা যায়না, ইতিহাস মোছা সম্ভব নয়, সেটাই তুলে ধরা হয়েছে আন্তর্জাতিক পুরস্কারপ্রাপ্ত চলচ্চিত্র ‘মাইক’-এ।

একাত্তরের ৭ই মার্চ রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধুর কালজয়ী ভাষণ ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’ শুনে উজ্জীবিত এবং প্রতিবাদের স্পৃহাকে উপজীব্য করে একদল কিশোরের দ্রোহের গল্প নিয়ে নির্মিত শিশুতোষ চলচ্চিত্র মাইক প্রদর্শিত হয়েছে পূর্ব লন্ডনের জেনেসিস সিনেমা হলে। ‘মাইক’ সিনেমা দেখতে প্রচুর দর্শকের সমাগম ঘটেছিল ২৭শে এপ্রিল রোববার।

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণকে কেন্দ্র করে নির্মিত পূর্ণদৈর্ঘ্য প্রথম শিশুতোষ চলচ্চিত্র ‘মাইক’ অসম্ভব সুন্দর একটি সিনেমা। মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ, বঙ্গবন্ধু, বর্তমান প্রজন্মসহ নানা বিষয় খুব চমৎকারভাবে চলচ্চিত্রে উপস্থাপন করা হয়েছে।

লেখক, কলামিস্ট ও সংগঠক এফ এম শাহীনের প্রযোজনায় মাইক চলচ্চিত্রটি যৌথভাবে পরিচালনা করছেন এফ এম শাহীন ও হাসান জাফরুল বিপুল।

দর্শক নন্দিত চলচ্চিত্র ‘মাইক’-এর এক্সক্লুসিভ স্ক্রিনিং ‘ডায়েসপাড়া ‘৭১’ এর সার্বিক তত্ত্বাবধানে পূর্ব লন্ডনের জেনেসিস সিনেমা হলে দুপুর ২টায় প্রদর্শিত হয়। শিশুতোষ পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র ‘মাইক’-এর মাধ্যমে তরুণ প্রজন্ম বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণসহ স্বাধীনতার ইতিহাস আবার নতুন করে জানতে পেরেছেন। আয়োজকদের পক্ষ থেকে জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান একাত্তরের রণাঙ্গনের বীর মুক্তিযোদ্ধারের উৎসর্গ করে এই সিনেমা প্রদর্শিত হয়েছে।

সম্পূর্ণ গ্রামীন লকেশনে চিত্রায়িত ইংরেজি সাবটাইটেল করা শিশুতোষ ছায়াছবি মাইক দেখতে বাবা মায়ের সাথে শিশু কিশোরদের উপস্থিতিও ছিল বেশ।

পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র ‘মাইক’ বাংলাদেশ সরকারের অনুদানে নির্মিত। ‘মাইক’ সিনেমায় অভিনয় করেছেন বিশিষ্ট অভিনেতা তারিক আনাম খান, চিত্রনায়ক ফেরদৌস আহমেদ ও অভিনেত্রী তানভীন সুইটি, অভিনেতা নাদের চৌধুরী, ঝুনা চৌধুরী, জয়িতা মহলানবিশ, সংগীতা চৌধুরী, রহিম সুমন, ইকবাল হোসাইন, শিশুশিল্পী সানজিদ রহমান খান, আলী আবদুল্লাহ দাইয়ান ভূঁইয়া, খোন্দকার মেঘদূত জলিল, মীর্জা ত্বাবীব ওয়াসিত প্রমুখ।

মাইক সিনেমা দেখে অনেক দর্শক তাদের প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করেছেন। একজন দর্শক বলেন, বঙ্গবন্ধুর এই ভাষণ আমাদের মুক্তির সনদ। এই ভাষণে তীব্র উৎসাহিত ও আন্দোলিত করার ক্ষমতা আছে। সেজন্য বিভিন্ন সময় এই ভাষণকে চাপিয়ে রাখার চেষ্টা হয়েছে। কিন্তু আমাদের সকলের দায়িত্ব এই ভাষণকে জাতির সামনে তুলে ধরা। নতুন প্রজন্মকে একাত্তরের সঠিক ইতিহাস জানানো এবং সেই জানানোর মাধ্যমে তাদের সঠিক পথধারায় রাখা, স্বাধীনতার পথধারায় রাখা। সেক্ষেত্রে ‘মাইক’ চলচ্চিত্রটি অনবদ্য ভূমিকা রাখবে| তাইতো আমি আমার সন্তানদের নিয়ে এসেছি। তবে, সিনেমায় ভাষণটি আরো ভালভাবে প্রচার করা উচিত ছিল।

বাংলাদেশের সীমানা পেরিয়ে মাইক চলচ্চিত্রটি প্রদর্শিত হচ্ছে বিভিন্ন দেশের প্রেক্ষাগৃহে। দর্শকনন্দিত হওয়ার পাশাপাশি পুরস্কারের ঝুলি ভরে উঠেছে ‘মাইক’ সিনেমার। ২০২৩ সালে দক্ষিণ এশিয়ার বেস্ট ফিচার ফিল্মের মুকুট জিতে নেয় ‘মাইক’। ‘টেক্কা ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল’-এ অফিসিয়াল সিলেকশনের পর বেস্ট এশিয়ান ফিচার ফিল্মের স্বীকৃতি পায় ‘মাইক’|

যুক্তরাজ্যের কার্ডিফ, লিডস, ওল্ডহ্যাম , অক্সফোর্ড সহ বিভিন্ন শহর থেকে এসেছিলেন সিনেমাপ্রেমীরা। হল ভর্তি দর্শক সিনেমায় বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শুনে উজ্জীবিত হয়ে করতালি দিয়ে ‘জয় বাংলা’ শ্লোগানে মুখরিত করে রাখেন হলরুম।

আয়োজকদের পক্ষে বক্তব্য রাখেন জেসমিন চৌধুরী এবং সৈয়দ এনামুল ইসলাম। তারা বলেন, ঐতিহাসিক ৭ই মার্চ দিবসকে সামনে রেখে ডায়াস্পোরা ৭১ টিমের সম্ভাব্য কর্মসূচি নিয়ে অনুষ্ঠিত সভায় ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইমস স্ট্রাটেজি ফোরামের পরিচালক ও ডায়াস্পোরা ৭১ এর প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ডক্টর রায়হান রশিদ যুক্তরাজ্যের বিভিন্ন শহরে তাঁর বন্ধু উদীয়মান চলচ্চিত্র নির্মাতা এফ এম শাহীনের মাইক ছবিটি প্রদর্শনের প্রস্তাব করেন। এফ এম শাহীনও তার সদয় অনুমতি প্রদান করেন। কর্মসূচির অংশ হিসাবে কার্ডিফে একটি শো হয়। আজকে অনুষ্ঠিত হচ্ছে যুক্তরাজ্যে ছবিটির ২য় প্রদর্শনী।

সৈয়দ এনাম আরো বলেন, আমি প্রথমেই ড: রায়হান রশিদ এবং এফএম শাহীনকে ডায়াস্পোরা ৭১ টিম এবং আজকে উপস্থিত সকল সম্মানিত দর্শকদের পক্ষ থেকে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি।
একাত্তরের হাতিয়ার আবারো গর্জে উঠার ছবি মাইক। যে সকল মুক্তিযোদ্ধা একাত্তরে জীবন বাজি রেখে যুদ্ধ করে আমাদেরকে একটি স্বাধীন দেশ ও চেতনা উপহার দিয়েছেন তাদেরকে গভীর শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করছি। যুক্তরাজ্য প্রবাসী রনাঙ্গনের বেশ কয়েকজন বীর মুক্তিযোদ্ধা প্রদর্শনীতে উপস্থিত আছেন। তাদেরকে সম্মান জানিয়ে এই প্রর্দশনীর আয়োজন। আমরা আজকের প্রদর্শনীটি একাত্তরে রনাঙ্গনের সকল বীর মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি উৎসর্গ করছি। উপস্থিত দর্শকরা হাত তালি দিয়ে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের স্বাগত জানিয়েছেন।

তিনি আরো বলেন, আজকের প্রদর্শনীটি বহু মানুষের শ্রম, সময়, সাহায্য সহযোগিতায় সম্পন্ন হচ্ছে। এদের মধ্যে আছেন ডায়াস্পোরা ৭১ টিমের সদস্যবৃন্দ, জেনেসিস সিনেমা হল কর্তৃপক্ষ, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, সামাজিক সাংস্কৃতিক ও মিডিয়া সংগঠন, সর্বোপরি আজকের দর্শকেরা যারা শত ব্যস্ততা ও আজকের বিশৃঙ্খল ট্রাফিক ব্যবস্থাকে পরাভূত করে হলে উপস্থিত হয়েছেন তারা। সময়ের সল্পতার কারনে সবার নাম উল্লেখ করা সম্ভব হচ্ছে না। আমি আপনাদের সবার প্রতি কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদ জ্ঞাপন করছি।

সৈয়দ এনাম বলেন, বিশেষ কয়েকজনের নাম উল্লেখ করতে চাই যাদের ভূমিকা ছাড়া আজকের শো সফলভাবে সম্পন্ন করা সম্ভব হতো না। আমি কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি রেইনবো ফিল্ম সোসাইটির প্রতিষ্ঠাতা চলচ্চিত্র নির্মাতা মোস্তফা কামাল, সৌধ আর্টস এর পরিচালক কবি টিএম আহমেদ কায়সার, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব শাহাব আহমেদ বাচ্চু, সাংবাদিক নিলুফা ইয়াসমীন হাসান ও জুয়েল রাজ, সাংস্কৃতিক সংগঠক মান্না রায়, স্মৃতি আজাদ, জাহিদ মিয়া, চিত্রনির্মাতা ড গোলাম রাব্বানী, শিক্ষক সবিতা শামসাদ, মিডিয়া ব্যক্তিত্ব ঊর্মি মাযহার, কামরুল আই রাসেল, প্রিন্টার নুর মোমেন, ইউকে আওয়ামীলীগের যুগ্ম সম্পাদক আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী, ইউকে আওয়ামী লীগের সহসভাপতি মো হরমুজ আলী, যুবলীগ নেতা জামাল খান ও সর্বইউরোপীয় বঙ্গবন্ধু পরিষদের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি আফজাল হোসেন সিদ্দিক মিয়াকে।
কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি আজকের প্রদর্শনীর আর্থিক স্পনসর সেকুলার বাংলাদেশ মুভমেন্ট এর সভাপতি কাউন্সিলর পুষ্পিতা গুপ্তা, এডিএস ড্রাইভিং স্কুলের কর্ণধার অতিশ সাহা ও কেরিয়ার রিসার্চ সেন্টার এর কর্ণধার বিশিষ্ট সোসাল মিডিয়া ঈনফ্লুয়েন্সার সুশান্ত দাশগুপ্ত কে। কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি আমাদের সকল মিডিয়া পার্টনার এবং আজকে যেসকল মিডিয়া প্রতিনিধিরা উপস্থিত হয়েছেন তাঁদের।

প্রায় ৬শতাধিক আসনের জেনেসিস সিনেমা হল পরিপূর্ণ ছিল দর্শকে। প্রদর্শনী শেষে বাইরেও ছিল দর্শকদের মতবিনিয়ম এবং বাংলাদেশ পরিস্থিতি নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উজ্জীবনের আকাঙ্খার প্রতিফলন। একটি সিনেমা দেখে চটজলদি এর মূল্যায়ন এবং মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার দর্শকদের চোখমুখের ভাষা এই প্রথম ভিন্নমাত্রায় লক্ষ্য করা গেল।

সংস্কৃতিকর্মী ও কা্উন্সিলার জাসমীন চৌধুরী ‘মাইক’ সিনোমটির গল্প এবং তার নির্মাণ সম্পর্কিত তথ্যাদি, নতুন প্রজন্মের ইতিহাস অনুসন্ধান প্রেরণাদায়ক কিভাবে হবে এই সিনেমাটি তা তুলে ধরেন। ’৭৫ পরবর্তী বধির সময়কে নিয়ে নির্মিত চলচ্চিত্রটি বর্তমান সময়েও প্রযোজ্য।

উল্লখ্য, এর আগে কার্ডিফ শহরেও চলচ্চিত্রটি ‘ডায়াস্পরা’৭১ প্রদর্শন করে। সেখানেও প্রচুর দর্শক সমাগম হয়। দর্শক নন্দিত এ সিনেমাটি যুক্তরাজ্যের অন্যান্য শহরেও প্রদর্শনের ইচ্ছা আছে বলে উদ্যোক্তারা জানিয়েছেন।