অমুসলিম পরিবারে শিশু লালন-পালন : মুসলিম শিশুরা কি হালাল খাবার পাচ্ছে?

Published: 28 May 2025

শায়েখ আব্দুল কাইয়ূম

পৃথিবীর নানা প্রান্তে চলমান যুদ্ধ ও সংঘাত—ফিলিস্তিন থেকে সিরিয়া, সুদান থেকে আফগানিস্তান—মানবিক বিপর্যয়ের যে দৃশ্যপট তৈরি করেছে, তা হৃদয়বিদারক। হাজার হাজার শিশুকে নিরাপত্তার জন্য পালাতে হয়েছে, যাদের অনেকে যুক্তরাজ্যে একাকী এসে পৌঁছেছে। আজকের জুমার খুতবায় আমি এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে কিছু চিন্তা শেয়ার করতে চাই, যা আমাদের সম্মিলিত বিবেককে নাড়া দেয়—আর তা হলো মুসলিম লালন-পালনকারীর প্রয়োজনীয়তা। ইস্ট লন্ডন মসজিদের প্রধান ইমাম ও খতীব শায়খ আব্দুল কাইয়ুম গত ২৩ মে শুক্রবার জুমার খুতবা উপস্থাপন করছিলেন।

তিনি বলেন, বর্তমানে যুক্তরাজ্যে প্রায় ৭,০০০ অনাথ ও একাকী আশ্রয়প্রার্থী শিশু সরকারি তত্ত্বাবধানে রয়েছে। এদের একটি বড় অংশ আসে মুসলিম-প্রধান দেশ যেমন সুদান, ইরিত্রিয়া, আলবেনিয়া, ইরাক, ইরান, আফগানিস্তান, ইথিওপিয়া এবং সিরিয়া থেকে। যুক্তরাজ্যের অনেক এলাকায় ৯০ শতাংশের বেশি মুসলিম শিশু এমন পরিবারে লালিত-পালিত হচ্ছে, যেখানে তাদের ইসলামি পরিচয় রক্ষা সম্ভব নয়, কারণ মুসলিম লালন-পালনকারীর সংখ্যা যথেষ্ট নয় ।

এসব কেবল পরিসংখ্যান নয়। এগুলো জীবন্ত প্রাণ। এরা আমাদের উম্মাহর অংশ । যদি আমরা এগিয়ে না আসি, তবে এ শিশুরা সালাত পড়ার সুযোগ ছাড়াই বড় হবে, সেই রুহানিয়াতের দিশা পাবে না- যা তাদের অধিকার, আর ইসলামের সাথে তাদের সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে । কেউ কেউ দয়া ও সদয় আচরণের মাঝে বড় হবে, কিন্তু তাদের ঈমান থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ার আশঙ্কাও থেকে যাবে।
আমাদের প্রিয় নবী মুহাম্মদ (সাঃ) নিজেও ছিলেন একজন অনাথ। তাঁকে প্রথমে দাদা আব্দুল মোত্তালিব এবং পরে চাচা আবু তালিব লালন-পালন করেছিলেন। আল্লাহ তা’আলা পবিত্র কুরআনের সূরা আদ-দোহাতে বলেন: তিনি কি আপনাকে এতিম অবস্থায় পাননি, অতঃপর আশ্রয় দেননি? এটি কেবল অতীতের ঘটনা নয়; এটি আমাদের জন্য একটি বাস্তব আহ্বান।
আল্লাহ তায়ালা একই সূরায় আরও বলেন : অতএব, এতিমের উপর কঠোর হবেন না।

তাছাড়া সূরা মাউন-এ আল্লাহ বলেন: “আপনি কি তাকে দেখেননি, যে ব্যক্তি প্রতিদানকে অস্বীকার করে, সে-ই তো এতিমকে তাড়িয়ে দেয়” । এই আয়াতগুলো অত্যন্ত স্পষ্ট করে বলে দিচ্ছ, অসহায় শিশুদের উপেক্ষা করা কোনো ছোট অপরাধ নয়; এটি এক গুরুতর ব্যর্থতা। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এতিমের যত্ন নেওয়ার জন্য বিশাল পুরস্কার ঘোষণা করেছেন । তিনি বলেন: “আমি এবং যে ব্যক্তি এতিমের যত্ন নেয়, জান্নাতে আমরা এভাবে একসাথে থাকব । এরপর তিনি তার তর্জনী ও মধ্যমা আঙুল একসাথে করে দেখান । এ চেয়ে বড় প্রেরণা আর কী হতে পারে?

শিশু লালন-পালন শুধু নাগরিক দায়িত্ব নয়; এটি একটি ইবাদত। এটি একটি সদকাহ যা দীর্ঘমেয়াদে প্রভাব রাখে—কারো জীবনের রূপরেখা ও হৃদয় গঠন করে । এটি একটি সুযোগ—শেখানোর, দিকনির্দেশনা দেওয়ার, এবং একটি কোমল হৃদয়কে ঈমানের আলোয় বিকশিত করার।

স্থানীয় কর্তৃপক্ষ ও ফস্টারিং এজেন্সিগুলো মুসলিম লালন পালনকারীর জন্য বারবার আবেদন করছে । শিশুদের অ-মুসলিম পরিবারে রাখতে হচ্ছে বাধ্য হয়েই । প্রশ্ন জাগে—তারা কি হালাল খাবার পাচ্ছে? তারা কি নামাজ শিখছে? তারা কি আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (সাঃ) সম্পর্কে জানতে পারছে?

জিলহজ মাসের বরকতময় দিনগুলো সামনে আসছে । রাসূল (সাঃ) বলেছেন: এই দিনগুলোতে আল্লাহর কাছে নেক আমল সবচেয়ে প্রিয় । অর্থাৎ জিলহজের প্রথম দশ দিন। তিনি আরও বলেন, এমনকি জিহাদও জিলহজ মাসের আমলের তুলনায় কিছু নয়—যদি না কেউ তার সমস্ত কিছু নিয়ে জিহাদে যায় এবং কিছুই নিয়ে ফিরে না আসে।

এই দিনগুলোতে আমাদের উচিত আল্লাহর সঙ্গে সম্পর্ক নবায়ন করা—রোজা, নামাজ, দান-সদকা এবং জিকিরের মাধ্যমে । বিশেষভাবে এই সময়ে আমরা যেটি বেশি করে পড়ব তা হলো তাকবির: “আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু, আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার, ওয়া লিল্লাহিল হামদ”।

এই তাকবিরাত কেবল নামাজের পর নয়, সারাদিন জুড়েই পড়তে হবে—হাঁটার সময়, বাজারে, বাড়িতে । সাহাবাগণ এগুলো জোরে পড়তেন, যাতে অন্যরাও স্মরণে রাখে এই পবিত্র দিনগুলোকে।
এটাই আমাদের সময়। একজন শিশুকে আশ্রয় দেওয়া, ঈমান ও ভালোবাসাভিত্তিক একটি পরিবারে লালন-পালন করা, হতে পারে আপনার জীবনের সবচেয়ে বরকতময় কাজ। এ হচ্ছে আল্লাহ’র সৃষ্টির সেবা করার মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের পথ।

আল্লাহ যেন আমাদের হৃদয় খুলে দেন, আমাদের পথনির্দেশ করেন এবং আমাদের এই মহৎ কাজে অংশ নেওয়ার তাওফিক দেন। তিনি যেন এতিমদের যত্নকারীদের উত্তম পুরস্কারে ভূষিত করেন এবং দুনিয়া ও আখেরাতে উচ্চ মর্যাদা দান করেন। আমিন।

ইস্ট লন্ডন মসজিদ এন্ড লন্ডন মুসলিম সেন্টার। শুক্রবার, ২৩ মে ২০২৫।