ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধ: যুক্তরাজ্য ও বাংলাদেশের অর্থনীতিতে সম্ভাব্য প্রভাব

Published: 18 June 2025

Anupam Saha, Columnist and Accountant

ইরান ও ইসরায়েলের সামরিক উত্তেজনা যদি পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধে রূপ নেয়, তাহলে তার প্রভাব বিশ্বজুড়ে অর্থনৈতিক অস্থিরতা তৈরি করবে—এমনটাই আশঙ্কা করছেন বিশ্লেষকরা।

মধ্যপ্রাচ্যে ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হলে তার প্রভাব শুধু ওই অঞ্চলেই সীমাবদ্ধ থাকবে না—তা ছড়িয়ে পড়বে বৈশ্বিক অর্থনীতিতে, যার অন্যতম ভুক্তভোগী হতে পারে যুক্তরাজ্য। প্রথম যে প্রভাব আসবে, তা হচ্ছে জ্বালানি সংকট। হরমুজ প্রণালি বন্ধ বা ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়লে বিশ্ববাজারে তেলের দাম হঠাৎ করে লাফিয়ে বাড়বে। যুক্তরাজ্য কিছু পরিমাণ গ্যাস ও এলএনজি আমদানি করে কাতারসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো থেকে, যা এই রুটের ওপর নির্ভরশীল। এর ফলে জ্বালানি ও বিদ্যুতের দাম বাড়বে, যা সরাসরি প্রভাব ফেলবে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রায় এবং পুনরায় মুদ্রাস্ফীতির ঝুঁকি বাড়িয়ে তুলবে।

ইরান বৈশ্বিক জ্বালানি সরবরাহের মাত্র ৩% অংশীদার হলেও এটি বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম প্রাকৃতিক গ্যাস সরবরাহকারী দেশ এবং গুরুত্বপূর্ণ হরমুজ প্রণালির নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। এ কারণে ইরান জড়িয়ে যাওয়া যেকোনো সামরিক সংঘাত বিশ্ব অর্থনীতিতে বড় প্রভাব ফেলতে পারে, বিশেষ করে যখন বিশ্ব ইতিমধ্যে যুক্তরাষ্ট্রপ্রণীত বাণিজ্য যুদ্ধের চাপের মুখে। ইসরায়েল-ইরান উত্তেজনার কারণে শুক্রবার বিশ্ববাজারে তেলের দাম একদিনেই ১৩% পর্যন্ত বেড়ে গেছে, যা ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর সর্বোচ্চ।

দ্বিতীয়ত, এই জ্বালানি মূল্যবৃদ্ধির ফলে যুক্তরাজ্যে দীর্ঘমেয়াদি কস্ট অব লিভিং বা জীবনযাত্রার ব্যয় আবারও বেড়ে যেতে পারে। খাদ্য, পরিবহন ও গৃহস্থালি পণ্যের দাম বাড়বে, ফলে নিম্ন ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির ওপর চাপ বাড়বে। এটি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের জন্য একটি নীতিগত সংকট তৈরি করতে পারে, কারণ মূল্যস্ফীতির চাপ থাকলে সুদের হার কমানো সম্ভব হবে না—ফলে অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার আরও বিলম্বিত হতে পারে।

তৃতীয়ত, যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে বৈশ্বিক শেয়ারবাজার ও বিনিয়োগ পরিবেশে অস্থিরতা তৈরি হবে। FTSE 100-সহ ব্রিটিশ বাজারে পতনের সম্ভাবনা বাড়বে, বিশেষ করে জ্বালানি-নির্ভর খাতগুলোতে। বিনিয়োগকারীরা নিরাপদ সম্পদে ঝুঁকতে শুরু করলে ব্রিটিশ পাউন্ডের মানেও কিছুটা দুর্বলতা দেখা দিতে পারে। এর ফলে বিদেশি আমদানি ব্যয় বাড়বে, যা মূল্যস্ফীতিকে আরও তীব্র করে তুলতে পারে।

চতুর্থ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হলো আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ওপর প্রভাব। যুক্তরাজ্য এশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যের সঙ্গে যেসব বাণিজ্যপথ ব্যবহার করে, সেগুলোর অনেক অংশই যুদ্ধক্ষেত্রের আশেপাশ দিয়ে যায়। যুদ্ধ দীর্ঘ হলে জাহাজ চলাচল বিলম্বিত হতে পারে, বাড়তে পারে বীমা ও পরিবহন ব্যয়, যা শেষ পর্যন্ত ব্রিটিশ আমদানি ও রপ্তানিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।

সবশেষে, যুদ্ধ পরিস্থিতিতে মধ্যপ্রাচ্যে শরণার্থী সঙ্কট, কূটনৈতিক উত্তেজনা এবং মানবিক সহায়তার প্রয়োজন বাড়বে। যুক্তরাজ্যের ওপর আন্তর্জাতিক চাপ তৈরি হতে পারে সামরিক বা আর্থিক সহায়তা দেওয়ার ক্ষেত্রে। সেইসঙ্গে যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়লে ইউরোপীয় নিরাপত্তা পরিস্থিতিও জটিল হয়ে উঠবে, যার পরোক্ষ চাপ পড়তে পারে অভ্যন্তরীণ রাজনীতি ও অর্থনীতিতে।

মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধের শঙ্কা: বাংলাদেশের জন্য বিপদের বার্তা

বাংলাদেশে এর প্রভাব পড়বে জ্বালানি, বাণিজ্য, রপ্তানি, প্রবাসী আয় এবং খাদ্য নিরাপত্তার ওপর।

বিশ্বজুড়ে প্রতিদিন ব্যবহৃত তেলের প্রায় ২০ শতাংশ সরবরাহ হয় হরমুজ প্রণালি দিয়ে। এটি সাময়িকভাবে বন্ধ হলেও বিশ্ববাজারে ব্যাপক অস্থিরতা তৈরি হবে। বাংলাদেশও এর প্রভাব থেকে মুক্ত থাকবে না। দেশের বিদ্যুৎ খাত এলএনজি ও পরিশোধিত জ্বালানির ওপর নির্ভরশীল। কাতার ও ওমান থেকে আমদানিকৃত এলএনজির একমাত্র পথ হরমুজ প্রণালি। এই পথ বন্ধ হলে বাংলাদেশের গ্যাস সরবরাহ বিঘ্নিত হবে, উৎপাদন খরচ বাড়বে এবং শিল্প খাতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।

বাংলাদেশের রপ্তানি খাত বিশেষ করে তৈরি পোশাক শিল্প আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে যে কোনো ধরণের ব্যাঘাতের শিকার হতে পারে। পণ্য পরিবহন বিলম্ব হলে ক্রেতারা অর্ডার বাতিল করতে পারেন, মূল্যছাড় দিতে হতে পারে। এতে বৈদেশিক আয় কমে যাওয়ার শঙ্কা রয়েছে।

মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়লে বাংলাদেশের প্রবাসী শ্রমিকদের চাকরি হারানোর আশঙ্কাও রয়েছে। বিশেষ করে ওমান, যা বাংলাদেশের ষষ্ঠ বৃহত্তম রেমিট্যান্স উৎস। যুদ্ধ পরিস্থিতিতে দেশগুলো নতুন কর্মী নিয়োগ কমাতে পারে, ফ্লাইট বাতিল হতে পারে, যাতায়াতে ব্যয় বাড়তে পারে।

সব মিলিয়ে ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধ শুধু একটি আঞ্চলিক সংঘাত নয়, বরং বৈশ্বিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থার ওপর এক ভয়াবহ ছায়া ফেলে দিতে পারে। বাংলাদেশের জন্য এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হবে জ্বালানি নিরাপত্তা, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ এবং রপ্তানি ও রেমিট্যান্স খাতকে সচল রাখা।

সব মিলিয়ে, ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধ বিশ্বব্যাপী একটি নতুন অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার যুগের সূচনা করতে পারে, যার সরাসরি না হলেও গভীর প্রভাব যুক্তরাজ্যের অর্থনীতি, বাজার ও সাধারণ মানুষের জীবনে পড়ার সম্ভাবনা প্রবল।

আমি আশা করি যুক্তরাজ্য সরকার সরাসরি বা পরোক্ষভাবে এই যুদ্ধে জড়াবে না, যেমনটা যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে যে তারা ইসরায়েলের সঙ্গে মিলে ইরানকে আক্রমণ করতে পারে। যদি যুক্তরাজ্য সরকার এই যুদ্ধে যোগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়, তবে তাদের অবশ্যই আগে সংসদের সম্মতি নিতে হবে এবং গোটা দেশের জনগণের মতামত বিবেচনায় নিতে হবে।

এই যুদ্ধ প্রতিরোধ করা সম্ভব যদি জাতিসংঘ, মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম দেশগুলো এবং পশ্চিমা প্রভাবশালী দেশগুলো একসাথে সক্রিয় কূটনৈতিক উদ্যোগ গ্রহণ করে। শান্তিপূর্ণ আলোচনার মাধ্যমে উত্তেজনা কমিয়ে আনা এবং সকল পক্ষকে সংযত রাখা এখন সবচেয়ে জরুরি। আমরা আশা করি, এই যুদ্ধ বন্ধ হবে এবং এই অঞ্চলে আবারও শান্তি ফিরে আসবে।