ইসরাইল ইরান যুদ্ধ কেন এবং কোন দিকে যাচ্ছে

Published: 19 June 2025

Dr Zaki Rezwana Anwar FRSA

পাঠকদের ২২ বছর আগের একটি পুরনো নাটকের কথা মনে করিয়ে দেই। নাটকের শিরোনাম হচ্ছে: ওয়েপন অফ ম্যাস ডিষ্ট্রাকশন। নাটকের নায়ক বলেছিলেন, এক দেশের রাজা ওয়েপন অফ ম্যাস ডিষ্ট্রাকশন নামে সাংঘাতিক এক যন্ত্র আবিস্কার করেছেন যেটিকে ৪৫ মিনিটের মধ্যেই সক্রিয় করে সব কিছু ধ্বংস ক’রে ফেলা সম্ভব। তারপর তিনি দলবল নিয়ে রওনা হলেন যুদ্ধ ক’রে সে দেশের মানুষকে রক্ষা করতে। ২০২৫ সালেও সে রকম নাটকের অবতারণা করা হয়েছে। বৃটিশ পত্রিকা দ্যা টেলিগ্রাফ ও কয়েকটি টিভি চ্যানেলে বলা হয়েছে যে, ইরান গোপনে তিন হাজার মাইল দূরত্ব অতিক্রম করতে পারে এমন ব্যালিষ্টিক মিসাইল প্রোগ্রাম তৈরী করেছে যা দিয়ে তেহরান থেকে সরাসরি লন্ডনে হামলা করা সম্ভব। রাজনৈতিক ও সামরিক প্রপাগান্ডার কথা কে না জানে? তবে প্রপাগান্ডা তৈরী করার আগে একটু দূরত্ব মেপে নিলে ভাল হত, কারণ এই দূরত্বের সঙ্গে কিন্তু আরো দু’হাজার মাইল যোগ করা প্রয়োজন ছিল।

প্রশ্ন হচ্ছে,  ইসরাইল সমস্ত আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন ক’রে ইরানকে আক্রমণের জন্যে ঠিক এই সময়টিকে বেছে নিল কেন এবং কোন্ দিকে যাচ্ছে এই যুদ্ধ?

আমাদের মনে থাকার কথা ২০১৫ সালে ওবামার আমলে পি ফাইভ প্লাস ওয়ান (P5 + 1) অর্থাৎ জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের পাঁচটি স্থায়ী দেশ (যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, রাশিয়া, চীন ও ফ্রান্স) এবং জার্মানীর সাথে ইরানের একটি  চুক্তি হয়। এই চুক্তিতে সক্ষমতা থাকা সত্বেও ইরান তার পারমানবিক কার্যক্রম সীমিত করতে সম্মত হয় যার মধ্যে ছিল ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণের মাত্রা ও পরিমাণ কমানো। শুধু তা-ই নয়, ইরান চুক্তিটি মানছে কিনা তা দেখতে আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকদের ইরানের পারমানবিক স্থাপনাগুলো পরিদর্শনের ব্যাপারেও ইরান সম্মত হয়। বিনিময়ে ইরানের উপর থেকে আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়।  কিন্তু বাস্তবে দেখা গেল, ওবামার পরে ট্রাম্পের প্রথম টার্মেই ট্রাম্প এই চুক্তি থেকে বেরিয়ে যায় এবং ইরানের উপর আবারো অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। ফলে স্বাভাবিকভাবেই ইরানও ধীরে ধীরে এই চুক্তি থেকে বেরিয়ে আসতে শুরু করে। ফলে ঐ চুক্তিটি মেটামুটিভাবে অকার্যকর হয়ে পড়ে।

এবার দ্বিতীয়বারের মত ট্রাম্প ক্ষমতায় আসার পর ট্রাম্প আবার সেই চুক্তিটি চালু করার জন্যে একটি জঘন্য কূটকৌশলের আশ্রয় নিয়েছেন। চুক্তির ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে আলোচনা চলাকালে যুক্তরাষ্ট্র এবার নতুন পথ ধরল। ২০১৫ সালের চুক্তিতে ছিল পারমানবিক কার্যক্রম সীমিতকরণ, কিন্তু এবার ট্রাম্পের দাবী পারমানবিক কার্যক্রম সীমিত নয়, একেবারে শূন্যে নামিয়ে আনা। রাজী না হওয়ার মত এই প্রস্তাবে যাতে শেষ পর্যন্ত ইরান রাজী হয় সেজন্যে  ইরানকে বোমা মেরে একটু ভীত ও দূর্বল করা প্রয়োজন তাহলে যুক্তরাষ্ট্র যেমন ইচ্ছা চাপ দিয়ে ইরানকে দিয়ে চুক্তি স্বাক্ষর করিয়ে নিতে পারবে। ইরান এই প্রস্তাবে রাজী হবেনা ধরে নিয়েই নির্ধারিত ৬০ দিন শেষ হওয়ার দু’দিন আগেই ইসরাইল অতর্কিতভাবে জাতিসংঘের নিয়ম ভেঙ্গে ইরানের উপর আগ্রাসন শুরু করে।

এবারে যুদ্ধ চলার কয়েক দিনের মাথায় ট্রাম্প ইরানকে নি:শর্ত আত্মসমর্পনের হুমকি দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের প্রস্তাবিত চুক্তিতে স্বাক্ষর করতে বলেন এবং বলেন একমাত্র তাতেই শান্তি অর্জন সম্ভব। ইরান স্বদর্পে জানিয়ে দিয়েছে যে সে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে এই চুক্তিতে আর স্বাক্ষর করবেনা। ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ খামেনী সাফ বলে দিয়েছেন, ইরান কোনোভাবেই  আত্মসমর্পণ করবেনা এবং কারো চাপিয়ে দেওয়া যুদ্ধের বিরূদ্ধে রুখে দাঁড়াবে বলেও স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেলে। এর জন্যে হয়তো ইরানকে চরম মূল্য দিতে হবে।

এদিকে  যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর দু’টো অপ্রত্যাশিত বিষয়  লক্ষ্য করা গেছে।

প্রথমটি হচ্ছে, ইসরাইলের ষ্ট্রেটেজি ছিল যদি একেবারে প্রথম দিকেই ইরানের উর্ধ্বতন পারমানবিক বিজ্ঞানীদের এবং ঊর্ধ্বতন সামরিক কর্মকর্তাদের মেরে ফেলে যায় তাহলে একটা শূন্যতার সৃষ্টি হবে এবং ইরানের পক্ষে চট করে প্রতিঘাত করা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়বে। অথচ সবাইকে অবাক করে দিয়ে অল্প সময়ের মধ্যেই ইরানের প্রতিঘাত আরো প্রবল হল। মনে হল তাদের মধ্যে কার অবর্তমানে কে দ্বায়িত্ব নেবে -এসব কিছু যেন পরিকল্পনা করাই ছিল।

দ্বিতীয়টি হচ্ছে, সবগুলো না হলেও বহু সংখ্যক ইরানের মিসাইল ইসরাইলে আঘাত হানতে সক্ষম হয়েছে যেগুলোর ভিডিও ফুটেজ সামাজিক মাধ্যমগুলোতে দেখা গেছে। এটা ইসরাইলের বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা যেমন ডেভিড স্লিং, আয়অন ডোম ও দ্যা এরোস – এসব প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাও যে অপ্রতুল তা বিশ্বের কাছে প্রতীয়মান হয়েছে।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এবার ইরানের পক্ষ থেকে জোরালো প্রতিরোধে ইসরাইল নতুন করে কী হিসেব কষছে আর এই যুদ্ধের শেষই বা কোথায়? 

গত কয়েকদিনের দৃশ্যপট বলে দিচ্ছে ইসরাইলের একার পক্ষে ইরানে পারমানবিক স্থাপনাগুলোকে সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করার কাজটি হয়তো সম্পন্ন করা সম্ভব নয়। ইসরাইলের পক্ষ থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে যুদ্ধে সরাসরি অংশগ্রহণের আহ্বানের আংশিক কারণ বোধকরি এই অপারগতা। তবে ট্রাম্পের সমর্থক MAGA গ্রুপ (Make America Great Again) এই যুদ্ধে সরাসরি অংশগ্রহণের চরম বিপক্ষে। তাঁদের অনেকেই মনে করছেন ট্রাম্প ইতোমধ্যেই তাঁর নির্বাচনী প্রতিশ্রুতির প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা শুরু করেছেন। শুধু তা-ই নয়, মার্কিন জনগণও এই সিদ্ধান্তের বিরূদ্ধে দাঁড়িয়ে যাবে। তাছাড়া যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি যুদ্ধে অংশ নিলে বিশ্বব্যাপী যে তেলের মূল্যবৃদ্ধি দেখা যাবে তাতে যুক্তরাষ্ট্রও বাদ পড়বেনা।

বলা বাহুল্য, ট্রাম্প ২ এর নির্বাচনী প্রচারণায় বলা হয়েছিল রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের অনেক অর্থনৈতিক ক্ষতি হয়েছে ও যুক্তরাষ্ট্রের ঋণ বেড়েছে। কাজেই ট্রাম্প ক্ষমতায় এলে তেমনটি তিনি হতে দেবেন না এবং যুদ্ধের পেছনে অর্থ ব্যয় বন্ধ করবেন, অথচ এক বছর যেতে না যেতেই দেখা যাচ্ছে ট্রাম্প সেই বাইডেনের পদাঙ্কই অনুসরণ করছেন। এখন এই ইসরাইলকে উস্কে দিয়ে ইরানের উপর হামলার খরচের ভার অবশ্যই যুক্তরাষ্ট্রকে নিতে হবে। জেলেনেস্কিকে ট্রাম্প নয়-ছয় বুঝিয়ে খারিজ করে দিতে পারেন কিন্তু নেতানিয়াহু কড়ায় গন্ডার ট্রাম্পের কাছ থেকে সব আদায় করবে।

ইসরাইলের অবশ্য আরেকটি কৌশল হবে ইরানের শাসকগোষ্টীর পতন ঘটানো যা তারা ইতোমধ্যে প্রকাশ্যেই বলছে। ইরানের বর্তমান শাসকগোষ্ঠী খুব যে জনপ্রিয় তা নয়, তবে গত কয়েকদিন ধরে ইসরাইল যেভাবে ইরানের সাধারণ জনগণের উপর বোমা ফেলছে, রাতে ঘুমন্ত জনগণের বাড়ীতে বিমান হামলা করেছে, যেভাবে ইরানের বিজ্ঞানী ও উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের হত্যা করা হয়েছে – সে প্রেক্ষিতে সাধারণ জনগণ সরকারকে পছন্দ না করলেও তাঁদের মধ্যে ‘ফ্ল্যাগ ফেনোমেনন’ (যখন জনগণ নিজেদের পতাকার পেছনে জড়ো হয়ে দাঁড়ায় এটা বোঝাতে যে বিদেশী আক্রমণের সময় তাঁরা তাঁদের সরকারের পেছনে রয়েছে) দেখা গেছে।

যদিও ইরান পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর সাথে সুসম্পর্ক রাখতে চায় তবে যদি  ইসরাইলী হামলায় তাঁদের পিঠ দেয়ালে ঠেকে যায় এবং  যদি প্রতিবেশী দেশগুলো ইরানকে আক্রমণের জন্যে তাদের ভূখন্ড ব্যবহার করতে দেয় তেমন পরিস্থিতিতে ইরান হরমুজ প্রণালী বন্ধ করে দিতে পারে। পৃথিবীতে যে ক’টি গুরুত্বপূর্ণ choke point রয়েছে হরমুজ প্রনালী তার একটি। সৌদি আরব সহ মধ্যপ্রাচ্যের প্রত্যেকটি দেশকেই তেল রপ্তানীর জন্যে এই হরমুজ প্রণালী ব্যবহার করতে হয়। পৃথিবীর প্রায় ২৫% থেকে ৩০% তেল রপ্তানী হয় এই হরমুজ প্রণালী দিয়ে। হরমুজ প্রনালী বন্ধ ক’রে দিলে বিশ্বব্যাপী তেলের দাম হুহু ক’রে বাড়তে থাকবে। এমনিতেই বিভিন্ন দেশে ট্রাম্পের আরোপিত ট্যারিফের কারণে বিশ্ব বাণিজ্য অনেকটা স্থবির হয়ে পড়েছে, তার উপর তেলের দাম বেড়ে গেলে খোদ যুক্তরাষ্ট্র সহ বিশ্বের প্রতিটি দেশের অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।

শেষ বিশ্লেষণে এই যুদ্ধের ফল হিসেবে দু’টো বিষয় মোটামুটি নিশ্চিতভাবে বলা যায়:

প্রথমত: ইরানের সমস্ত পারমানবিক পরীক্ষা নিরীক্ষা একেবারে অন্ধকারে চলে যাবে, অর্থাৎ এতদিন ইরান যেমন ইন্টারন্যাশনাল এনার্জি এজেন্সিকে পারমানবিক কর্মকান্ড পরিদর্শনে অনুমতি দিত – এখন থেকে তা আর দেবেনা। বিশেষ ক’রে ইরান যখন দেখছে রাশিয়া ইউক্রেনের পারমানবিক স্থাপনাগুলোতে বোমা ফেললে পশ্চিমা দেশগুলো রীতিমত ঝাঁপিয়ে পড়ে নিন্দা জানিয়েছিল এবং বলেছিল সেটি ছিল যুদ্ধের আইনের লঙ্ঘন অথচ ইসরাইল ইরানের পারমানবিক স্থাপনাগুলো আক্রমণ করার পরও পাশ্চিমা দেশেগুলো মুখে কুলুপ এঁটে বসে আছে – তখন ইরান আর তাঁদের সঙ্গে সহযোগিতা করবেননা। এর অর্থ হল, আন্তর্জাতিক মহল ইরানের উপর পাহারাদারিত্ব হারাবে।

দ্বিতীয়ত: গত কয়েকদিনে ইসরাইলের হামলায় ইরানের জনগণ যেভাবে চোখের সামনে সাধারণ নিরীহ জনগণের মৃত্যু দেখেছে, যে দুর্দশা ভোগ করছে তাতে তাঁদের মনে নিজের দেশকে রক্ষার জন্যে অস্ত্রায়নে মনেযোগী হওয়ার আকাঙ্খা বহু গুণে বেড়ে যাবে। অতীতে ইরানের জনগণের একটি বড় অংশ বিশেষ ক’রে সুশীল সমাজের এতে আপত্তি ছিল। তাঁরা চাইতেন পারমানবিক শক্তি শুধু প্রযুক্তিতে ব্যবহৃত হোক, অস্ত্র তৈরীতে নয়। এই ধারণা থেকে তাঁরা বেরিয়ে আসবে বিশেষ করে যখন তাঁরা দেখছে ইসরাইল সকল আন্তর্জাতিক আইনের ঊর্ধ্বে এবং ইসরাইল নিজে পারমানবিক সমৃদ্ধী সীমিতকরণে  চুক্তিতে স্বাক্ষর করতে রাজী হয়নি এবং আন্তর্জাতিক পরিদর্শকদের পরিদর্শনের অনুমতি দেয়না।  কাজেই ইরান যে আরো অস্ত্রায়নের দিকে এগিয়ে যাবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তাতে ইরান শত হুমকির মুখে যে কেনো ঝুঁকি নেবে। ইরানের অবস্থা হবে মৃতের জন্যে আর মৃত্যু হুমকি কী?

……………….

লেখক Dr Zaki Rezwana  Anwar FRSA, MBBS, DTM&H, MS & PhD একজন চিকিৎসক, জনপ্রিয় সংবাদ পাঠক, কলামিষ্ট ও পাবলিক স্পীকার