রূপগঞ্জের শুটার রিয়াজ যেভাবে সিলেটে গ্রেপ্তার
পোস্ট ডেস্ক :

রূপগঞ্জের ‘ভয়ঙ্কর’ সন্ত্রাসী শুটার রিয়াজ। কথার আগে গুলি চালায়। ক’মাস ধরে তাকে হন্যে হয়ে খুঁজছিলেন সেনাবাহিনী ও র্যাব
সদস্যরা। সেই শুটার রিয়াজ নাটকীয়ভাবে গ্রেপ্তার হয়েছে সিলেটে। দুপুরে রিয়াজ তার ব্যবহৃত অত্যাধুনিক ‘টয়োটা ইয়ারিস ক্রস’ গাড়ি নিজেই ড্রাইভ করে জাফলং অভিমুখে যাচ্ছিলো। সঙ্গে তার স্ত্রী ও দুই সন্তান। র্যাব-৯’র সদস্যরা তাকে ধরতে জৈন্তাপুরের ৪নং বাংলাবাজার এলাকায় ফাঁদ পাতেন। র্যাব’র একটি টিম অবস্থান নেয় ওই এলাকার সিলেট-তামাবিল সড়কে। জাফলং অভিমুখী গাড়িটি খুব দ্রুতই চালাচ্ছিলো শুটার রিয়াজ নিজেই। র্যাব সদস্যরা এ সময় গাড়িটিকে সিগন্যাল দেন। চালকের আসনে থাকা শুটার রিয়াজ সিগন্যাল না মেনে গাড়ির গতি আরও বাড়িয়ে দেয়। র্যাব সদস্যদের আহত করে সে ওই এলাকা থেকে পালায়। এরপর র্যাব’র পক্ষ থেকে সব বাহিনীকে মেসেজ পাঠালে সিলেট নগরের প্রবেশমুখ, গোয়াইনঘাট সদর সহ নানা জায়গায় চেকপোস্ট বসানো হয়।
বাংলাবাজার থেকে পালিয়ে যাওয়ার পর র্যাব’র একটি টিম তার পিছু নেয়। গোয়াইনঘাট সদরে পুলিশ চেকপোস্ট বসিয়ে ওই গাড়িকে সিগন্যাল দিলেও থামেনি। সামনে অনেক পথচারীকে আহত করে গাড়িটি দ্রুত গতিতে ছুটতে থাকে। একপর্যায়ে গোয়াইনঘাট থেকে প্রায় দুই কিলোমিটার দূরের পথ আলীগ্রামের কাছে গিয়ে গাড়ি থামায় শুটার রিয়াজ। পেছনে থাকা র্যাব-পুলিশের ধাওয়া থেকে বাঁচতে গাড়িতে থাকা দুই সন্তানকে সঙ্গে নিয়ে গ্রামের ভেতর দিয়ে পালাচ্ছিলো। ওই এলাকা ভারত সীমান্ত থেকেও বেশি দূরে নয়। দুই শিশুকে নিয়ে এক ব্যক্তি পালিয়ে যেতে দেখায় এলাকার লোকজনের সন্দেহ হয়। তারা ছেলে ধরা সন্দেহে শুটার রিয়াজকে ধাওয়া করে। আলীগ্রামের আব্দুল মালেকের বাড়ির উঠানে দুই সন্তানকে রেখে ফের পালাতে শুরু করলে স্থানীয় জনতা তাকে আটক করে। এ সময় তাকে গ্রামের লোকজন মারধর করেন। খবর পেয়ে পুলিশ ও র্যাব’র দল সেখানে গিয়ে শুটার রিয়াজকে আটক করেন। এ সময় উত্তেজিত জনতা রিয়াজকে মারধর করা ছাড়াও তার ব্যবহৃত অত্যাধুনিক গাড়িটিও ভাঙচুর করে। পুলিশ জানায়- দুই শিশুকে নিয়ে দৌড়াতে দেখে জনতা রিয়াজের ওপর এতটাই ক্ষুব্ধ হয় তারা পুলিশের কাছে তাকে হস্তান্তর করতেও রাজি হয়নি।
পরে জনগণকে শান্ত করে রিয়াজকে গোয়াইনঘাট থানায় নিয়ে আসা হয়। আটকের পর জানা যায় গাড়িতে বসা ছিল তার স্ত্রী ও এক কাজের মেয়ে। আর দুই শিশুর পিতাও সে। এদিকে- আটকের পর গোয়াইনঘাট থানায় র্যাব ও পুলিশ সদস্যরা তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করেন। এ সময় রিয়াজ নিজেকে শুটার রিয়াজ বলে পরিচয় দেয়। বিকালে কানাইঘাট থানার ওসি তরিকুল ইসলাম জানিয়েছেন- শুটার রিয়াজকে আটক করা হয়েছে। সে তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসী। র্যাব-৯ এর মিডিয়া অফিসার কেএম শহিদুল ইসলাম সোহাগ জানিয়েছেন- র্যাবের সিগন্যাল না মেনে জৈন্তাপুরে সে দ্রুতগতিতে গাড়ি চালিয়ে চলে যায়। এরপর সবখানে এ্যলার্ট করা হয়। শেষে র্যাব ও পুলিশের যৌথ অভিযানে তাকে গোয়াইনঘাট থেকে আটক করা হয়। তিনি বলেন- শ্যুটার রিয়াজকে আটকের পর সিলেটে নিয়ে আসা হচ্ছে। এরপর তার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হবে। এদিকে শুটার রিয়াজ আটকের খবর সন্ধ্যায়ই পৌঁছে গেছে রূপগঞ্জে। সে রূপগঞ্জের আতঙ্ক। নাম শুনলেই আঁৎকে ওঠেন সবাই। রূপগঞ্জের সাংবাদিকসহ কয়েকজন সচেতন নাগরিক জানিয়েছেন- রূপগঞ্জের মোড়াপাড়া গ্রামে শুটার রিয়াজের বাড়ি। তার পুরো না রিয়াজুল ইসলাম। বয়স খুব বেশি নয়। ২৬ অথবা ২৭ বছর। ২১-২২ বছরেই সে নারায়ণগঞ্জের শীর্ষ সন্ত্রাসী হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে।
তার সঙ্গে যে কথাটি এলাকায় প্রচলন আছে সেটি হচ্ছে- কথার আগে গুলি চালায় রিয়াজ। এ কারণে তাকে শুটার রিয়াজ নামেই চিনেন সবাই। তার বড় ভাই শওকতও এক সময় এলাকার শীর্ষ সন্ত্রাসী ছিল। ৭-৮ বছর আগে র্যাব’র ক্রসফায়ারে সে নিহত হয়। বর্তমানে তার মেঝো ভাই মোহাম্মদ আলীও রূপগঞ্জের ত্রাস। তবে শ্যুটার রিয়াজ কেবলমাত্র আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহারের কারণে সবার কাছে আতঙ্কের চরিত্রের পরিনত হয়েছেন। তার বহরে রয়েছে শতাধিক যুবক। তারাও সবাই অস্ত্রবাজ এবং অস্ত্র চালনায় দক্ষ। অত্যাধুনিক এমন কোনো অস্ত্র নেই, যা তার বাহিনীর কাছে নেই। সব ধরনের আগ্নেয়াস্ত্রই তারা ব্যবহার করে। আওয়ামী লীগের জমানায় স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতারাই তাকে শেল্টার দিতেন। ভূমি দখল, আধিপত্য বিস্তার সহ নানা কাজে তাকে ব্যবহার করা হয়েছে। গণ-অভ্যুত্থানের পর সে বিএনপি’র নেতাদের শেল্টারে চলে। তবে-গত এক বছরে শুটার রিয়াজ নিজেই নেতৃত্ব দিয়ে শতাধিক ঘটনা ঘটিয়েছে। আর এসব ঘটনায় প্রকাশ্য আগ্নেয়াস্ত্র প্রদর্শন, গুলিবর্ষণ সহ নানা ঘটনা ঘটায়।
এ কারণে ৩-৪ মাস আগে তার ওপর আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নজর পড়ায় সে এলাকায় আত্মগোপনে চলে যায়। তবে মাঝে-মধ্যে এলাকায় গেলেও বেশিক্ষণ স্থানীয় এলাকায় থাকতো না। সেনা, র্যাব সদস্যরা এরই মধ্যে তাকে ধরতে রূপগঞ্জ সহ দেশের বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালিয়েছেন। তার বিরুদ্ধে ২০ টিরও অধিক মামলায় রয়েছে। এসব মামলায় সে পলাতক আসামিও। এলাকার লোকজন জানান- রূপগঞ্জ ও সোনারগাঁ এলাকায় ত্রাস রিয়াজ বাহিনী। সর্বশেষ ২০২২ সালের ৬ই এপ্রিল ঢাকায় বাহিনীর চার সদস্য সহ র্যাব’র হাতে ধরা পড়েছিলো সে। তখন তার বিরুদ্ধে ১৫টি মামলা ছিল। ওই সব মামলায় জামিন নিয়ে সে ৩-৪ মাসের মধ্যে বেরিয়ে আসে। এর আগেও সে একাধিকবার কারান্তরীণ হয়েছিল। তারা জানান- ৫ই আগস্টের আগে শুটার রিয়াজ ছাত্র-জনতার ওপর গুলিবর্ষণ করেছিল। সে এলাকায় প্রকাশ্যেই অস্ত্র নিয়ে মহড়া দেয়। প্রেক্ষাপট পরিবর্তনের পর সে লেবাসও পাল্টে ফেলে। তবে তার সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের কারণে র্যাব ও সেনা সদস্যরা তাকে হন্যে হয়ে খুঁজছিলেন। বার বার অবস্থান পরিবর্তন করায় তাকে গ্রেপ্তার করা সম্ভব হয়নি।




