দ্য স্টেটসম্যানের নিবন্ধ

দ্য স্টেটসম্যানের নিবন্ধ
যেকোনো সময়ের চেয়ে দ্রুত শুকিয়ে যাচ্ছে গঙ্গা

Published: 28 September 2025

পোস্ট ডেস্ক :


দক্ষিণ এশিয়ার কোটি কোটি মানুষের জীবনরেখা গঙ্গা। অভূতপূর্ব এই নদী শুকিয়ে যাচ্ছে। বিজ্ঞানীরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তন, অনিয়মিত মৌসুমি বৃষ্টি, লাগাতার পানি উত্তোলন ও বাঁধ নির্মাণ গঙ্গাকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। এর ফলে গোটা অঞ্চলের খাদ্য, পানি ও জীবিকার ওপর ভয়াবহ প্রভাব পড়ছে। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে গঙ্গা ও তার শাখা নদীগুলো পৃথিবীর অন্যতম ঘনবসতিপূর্ণ অঞ্চলকে টিকিয়ে রেখেছে।

হিমালয় থেকে বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত বিস্তৃত এই নদী অববাহিকা ৬৫০ মিলিয়নেরও বেশি মানুষকে সহায়তা করে। ভারতের এক-চতুর্থাংশ মিঠা পানির যোগান দেয় এবং বিপুল খাদ্য ও অর্থনৈতিক মূল্য বহন করে। অথচ সাম্প্রতিক গবেষণা জানাচ্ছে, ইতিহাসে রেকর্ডকৃত যেকোনো সময়ের চেয়ে দ্রুতগতিতে শুকিয়ে যাচ্ছে গঙ্গা। বিজ্ঞানীরা ১৩০০ বছরের প্রবাহ রেকর্ড পুনর্বিন্যাস করে দেখেছেন, সাম্প্রতিক কয়েক দশকের খরা প্রাকৃতিক জলবায়ু পরিবর্তনের সীমা ছাড়িয়ে গেছে।

যে নদীপথে সারা বছর নৌ চলাচল হতো, গ্রীষ্মে এখন তা অচল। বড় বড় নৌকা, যেগুলো আগে বিহার ও বাংলা হয়ে বারাণসী, এলাহাবাদ পর্যন্ত যেত, এখন অগভীর পানিতে সেসব আটকে যায়। যে খাল এক প্রজন্ম আগে সপ্তাহের পর সপ্তাহ সেচের পানি সরবরাহ দিত, তা এখন অকালেই শুকিয়ে যায়। বহু কূপ, যেগুলো দশকের পর দশক পরিবারগুলোকে পানি সরবরাহ দিয়েছে, এখন তা সামান্যও দিচ্ছে না।

গ্লোবাল ক্লাইমেট মডেলও এ শুষ্কতার ভয়াবহতা অনুমান করতে পারেনি, যা আরও অস্বস্তিকর ইঙ্গিত দেয়- মানবিক চাপ ও পরিবেশগত পরিবর্তন এমনভাবে একসঙ্গে কাজ করছে, যা আমরা এখনো পুরোপুরি বুঝতে পারিনি। সেচের জন্য পানি সরানো হয়েছে। কৃষির জন্য ভূগর্ভস্থ পানি তোলা হয়েছে। শিল্প বসেছে নদীর দুই পারে। এক হাজারেরও বেশি বাঁধ ও ব্যারেজ নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ পাল্টে দিয়েছে। এদিকে জলবায়ু পরিবর্তনে অনিশ্চিত হয়ে উঠেছে মৌসুমি বৃষ্টি। ফলে নদী নিজেকে পুনর্গঠন করতে পারছে না।

হিমালয়ের গঙ্গোত্রী হিমবাহ মাত্র দুই দশকে প্রায় এক কিলোমিটার পিছু হটেছে।
হিমালয়ের সর্বত্রই একই প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। তাপমাত্রা বাড়ায় হিমবাহ দ্রুত গলছে। প্রথমে এতে আকস্মিক বন্যা হয়। কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে তার ফলে শুষ্ক মৌসুমে প্রবাহ কমে যায়। এগুলোকে বলা হয় ‘এশিয়ার পানির টাওয়ার’। কিন্তু সেই টাওয়ার ভেঙে পড়ায় গঙ্গা ও তার শাখা নদীগুলোর গ্রীষ্মকালীন প্রবাহও হ্রাস পাচ্ছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ভূগর্ভস্থ পানির অযাচিত উত্তোলন। গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র অববাহিকা পৃথিবীর দ্রুততম হারে পানিশূন্য হওয়া ভূগর্ভস্থ জলাধারগুলোর একটি, যেখানে প্রতিবছর ১৫-২০ মিলিমিটার করে পানি নিচে নেমে যাচ্ছে। তার ওপর অনেক ভূগর্ভস্থ পানি আর্সেনিক ও ফ্লুরাইডে দূষিত, যা মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য হুমকি এবং কৃষিও বিপন্ন করছে।

মানবসৃষ্ট প্রকৌশলও পরিস্থিতি খারাপ করেছে। ভারতের ফরাক্কা ব্যারেজ শুষ্ক মৌসুমে বাংলাদেশে প্রবাহ কমিয়ে দিয়েছে। ফলে ভূমি লবণাক্ত হচ্ছে এবং বিপন্ন হচ্ছে সুন্দরবন, পৃথিবীর বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন। স্বল্পমেয়াদি অর্থনৈতিক লাভকে প্রাধান্য দেওয়ার কারণে নদীর পরিবেশগত স্বাস্থ্য মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। উত্তরবাংলা ও পশ্চিমবঙ্গের বহু ছোট নদী গ্রীষ্মে শুকিয়ে যাচ্ছে, কৃষি ও পশুপালনের পানি-সংকট তৈরি করছে।

এসব ছোট শাখা নদীর অদৃশ্য হয়ে যাওয়া আসন্ন বিপদের ইঙ্গিত দিচ্ছে। যদি গঙ্গা এই পতনের ধারা অব্যাহত রাখে, গোটা অঞ্চলের লাখ লাখ মানুষ কয়েক দশকের মধ্যে তীব্র খাদ্য সংকটে পড়তে পারে। তাই জরুরিভিত্তিতে সমন্বিত পদক্ষেপ নিতে হবে। খণ্ডিত সমাধান যথেষ্ট হবে না। গঙ্গা ব্যবস্থাপনা নতুনভাবে ভাবতে হবে। এর মানে হলো, ভূগর্ভস্থ পানির অযৌক্তিক উত্তোলন কমানো, নদীতে ন্যূনতম প্রবাহ নিশ্চিত করা এবং নীতি-নির্ধারণের জন্য উন্নত জলবায়ু মডেল ব্যবহার করা- যেখানে মানবিক চাপ ও মৌসুমি বৃষ্টির অস্থিরতা একত্রে বিবেচিত হবে।

পাশাপাশি আন্তঃদেশীয় সহযোগিতাও অপরিহার্য। ভারত, বাংলাদেশ ও নেপালকে তথ্য ভাগাভাগি, বাঁধ ব্যবস্থাপনা এবং জলবায়ু পরিবর্তনের প্রস্তুতিতে আরও ভালোভাবে কাজ করতে হবে। আন্তর্জাতিক তহবিল ও রাজনৈতিক চুক্তিতে গঙ্গার মতো নদীকে বৈশ্বিক অগ্রাধিকার দিতে হবে। সর্বোপরি, নদী পুনরুদ্ধারের প্রচেষ্টায় স্থানীয় কণ্ঠস্বরকে বিজ্ঞানী ও নীতিনির্ধারকদের সঙ্গে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।
গঙ্গা শুধু একটি নদী নয়।

এটি একটি জীবনরেখা, পবিত্র প্রতীক এবং দক্ষিণ এশীয় সভ্যতার ভিত্তি। কিন্তু এটি আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে দ্রুত শুকিয়ে যাচ্ছে। আর দেরি করার সুযোগ নেই। এখনই পদক্ষেপ নিতে হবে, যাতে গঙ্গা প্রবাহিত থাকে- শুধু আমাদের জন্য নয়, আগামী প্রজন্মের জন্যও।

(লেখক: লিভারহুলম আর্লি ক্যারিয়ার ফেলো, ভূগোল বিভাগ, ম্যানচেস্টার বিশ্ববিদ্যালয়। প্রবন্ধটি প্রকাশিত হয়েছে অনলাইন দ্য কনভারসেশনকে উদ্ধৃত করে স্টেটসম্যানে। সেখান থেকে অনুবাদ)