নাটক “গ্রোয়িং ঔল্ডার ইন দ‍্য ইস্ট এণ্ড” পূর্ব লণ্ডনের একদল নিঃসঙ্গ মানুষের গল্প

Published: 13 November 2025

কাইয়ূম আবদুল্লাহ
“গ্রোয়িং ঔল্ডার ইন দ‍্য ইস্ট এণ্ড” শীর্ষক নাটকটি দেখেই দেরি না করে বেরিয়ে পড়লাম বেথনাল গ্রিনের রিচমিক্স সেন্টার থেকে। বাহিরে মেঘমুক্ত হৈমন্তিক পরিষ্কার আকাশ। কিন্তু চারিদিকে ঝরাপাতার একটা ভাবগম্ভীর ভারী পরিবেশ বিরাজ করছে। তারচেয়েও বেশি ভারি হয়ে আছে মানসিক অবস্থা। কোথাও যেন একটা শূন্যতার আগাম অদৃশ্য হাতছানি অনুভূত হলো। নাটক, সিনেমা কিংবা গানের আসরতো বেশিরভাগই উপভোগের বিষয়। কিন্তু এই নাটকটিকে স্রেফ উপভোগ‍্য হিসেবে চিত্রায়িত বা মন্তব্য করা যাবে না। কারণ, যে জীবনঘনিষ্ট বিষয়গুলো এতে চিত্রিত বা উপস্থাপিত হয়েছে তাতে উপভোগ নয় বরং অনুধাবন ও অনুভূতিকে নাড়া দেয়ার বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। আর তা হচ্ছে— চারপাশ, সমাজ-সংসার কেমন যাচ্ছে বদলে যাচ্ছে যুগের হাওয়ায়। বিশেষ করে আমাদের এল্ডারলি বা বয়স্কদের মানসিক স্বাস্থ্য ও জীবন প্রবাহের গতি প্রকৃতি। তাদের চাওয়া পাওয়া, স্বপ্ন আকাঙ্ক্ষার অব‍্যক্ত আকুলতা কিংবা আবেগ অনুভূতি! নাটকটিতে কয়েকজন প্রবীণের যে আখ‍্যান উপস্থাপিত হয়েছে সেটা হয়তো আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে। কিংবা আমাদের প্রবীণদের প্রতি অর্পিত দায়িত্ব তথা আমরা কি তাদের কাঙ্ক্ষিত সেবা দিতে পারছি?
এটা শুধু আমার নয়, আমার বিশ্বাস দর্শকদের অনেকেরই এমন অনুভূতি হয়েছে।

হেমন্তের ঝরাপাতা মাড়িয়ে গিয়ে গাড়িতে উঠি এবং ওয়েস্ট এণ্ডের দিকে যাই। তখনও মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল নাটকটির নানা দৃশ্য ও সংলাপ। চারপাশে ছড়িয়ে থাকা ঝরাপাতার মর্মর শব্দে যেন এইমাত্র দেখে আসা নাটকের বৃদ্ধবৃদ্ধাদের কষ্টের গুঞ্জরণ অনুরণিত হচ্ছে। একটু এগোতেই একের পর এক সুউচ্চ নান্দনিক নতুন বিল্ডিং যেমন- গার্কিন, স্কাই গার্ডেন ও হিরন টাওয়ারের মতো আকাশ প্রায় ঢেকে যাওয়া স্কাইক্র‍্যাপারগুলো দৃষ্টি সীমাকে বাধাগ্রস্ত করে। শুধু ওয়েস্ট এণ্ডই নয় ইস্ট এণ্ডও এখন সুউচ্চ সব দালানে ভর্তি। লণ্ডনের ফাইনান্সিয়াল ক‍্যাপিটাল খ‍্যাত ইস্ট লণ্ডনের ক‍্যানারি ওয়ার্ফ এলাকায় এই কয়েক বছর আগেও একটিমাত্র উঁচু বিল্ডিং ছিল, যেটি ছিল লণ্ডন তথা ইংল‍্যাণ্ডের সর্বোচ্চ বিল্ডিং। এখন এর চারপাশে অনেকগুলো বিশাল ও সুউচ্চ ভবন গড়ে উঠেছে যা পূর্বের একমাত্র বিল্ডিংটিকেও ঢেকে ফেলেছে প্রায়। এছাড়া কাউন্সিলগুলো পার্ক, খোলা জায়গা ধ্বংস করেও নতুন নতুন হাউজ নির্মাণ করছে তথাপি মানুষের বাসস্থানের চাহিদা পূরণ হচ্ছে না। দিনে দিনে কাউন্সিলগুলোতে ঘর প্রত‍্যাশীদের ওয়েটিং লিস্ট দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয়। পরিবারগুলোতে সদস্য সংখ্যা বেড়ে একসময় হয়ে ওঠে ওভার ক্রাউডেড। আর এই ওভার ক্রাউডের মাসুল যায় বয়স্কদের উপর দিয়ে। কোনো কোনো পরিবারে বয়স্করা হয়ে পড়েন অপাংক্তেয়। কারণ, শিশুদের খেলার স্পেসসহ খেলনা সামগ্রী রাখার জায়গা প্রদান এমনকি বিবাহিত সন্তান সন্ততির প্রাইভেসির জন্য ঘর ছেড়ে কেয়ার হোমে আশ্রয় নিতে হয় পরিবারের একসময়ের অভিভাবক বাবা কিংবা মাকে। এছাড়া সন্তানদের ব‍্যস্ততার কারণে পারিবারিক যত্নের অভাবে বয়স্ক মা বা বাবার ডে কেয়ার সেন্টারই হয় সময় কাটানোর একমাত্র মাধ্যম। পুঁজিবাদী এই সমাজ ব্যবস্থা নাগরিকদের জন্য লোভনীয় নানা সার্ভিস সুবিধা দিলেও তাদের মনের শূন্যতা বা একাকিত্ব দূর করতে পারে না।

 

বিশ্বের অন‍্যতম ব‍্যস্ত শহরে একটি বিরাট অংশের মানুষের এই সমস্যা হয়তো অনেকেরই নজরে পড়ে না। তবে বছর কয়েক আগে ব্রিটিশ রেডক্রসের নতুন একটি গবেষণা প্রকাশিত হয়েছিল। তাতে দেখা যায়, যুক্তরাজ্যেই লাখ লাখ মানুষ একাকীত্ব এবং সামাজিক বিচ্ছিন্নতায় ভোগেন। অন্তত ৪ হাজার মানুষের উপর গবেষণা চালিয়ে জানা যায়, তাদের বেশিভাগেরই কোনো প্রিয় বন্ধু নেই। তিনভাগের একভাগ বলেছেন, তারা মাঝে মাঝে এতটাই একাকীত্ব বোধ করেন যে, তাদের মনে হয় তাদের কথা বলার মতো কেউ নেই।

গত ৮ নভেম্বর, শনিবার দুপুরে পূর্ব লণ্ডনের রিচমিক্স সেন্টারে গল্পকার ও সাংবাদিক সাঈম চৌধুরী রচিত নাটক “গ্রোয়িং ঔল্ডার ইন দ‍্য ইস্ট এণ্ড” মঞ্চায়ন করে মঞ্চশৈলী। নাটকটিতে অভিবাসী পরিবারগুলোর কষ্টক্লিষ্ট দিনযাপনের এই চিত্রই নাটকের মাধ্যমে দৃশ‍্যায়িত হয়েছে। বিশেষ করে পূর্ব লণ্ডনের বাংলাদেশী কমিউনিটির বয়স্কদের শারীরিক, মানসিক ও বাসস্থানগত সমস্যা নিয়ে কষ্টের মধ্যে দিয়ে যাপিত জীবনের বাস্তব ও করুণ চিত্র ফুটে উঠেছে।

ইতিপূর্বে ওপেন ইউনিভার্সিটি পূর্ব লন্ডনের বাংলাদেশি প্রবীণদের হাউজিং সমস্যার উপর রিসার্চ করে যে কী ফাইণ্ডিং বা প্রধান ইস্যুগুলো চিহ্নিত করেছেন সেই বিষয়গুলোই সাঈম চৌধুরী তাঁর রচিত নাটকের মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করেছেন। ওপেন ইউনিভার্সিটি ছাড়াও “আমার বাড়ি আমার জীবন” শীর্ষক গবেষণার সাথে যুক্ত ছিলো বাংলা হাউজিং এসোসিয়েশন, হাউজিং লার্নিং এন্ড ইমপ্রুভমেন্ট নেটওয়ার্ক। পুরো নাটক দেখার পর দর্শকদের আবেগমথিত মন্তব্য এবং অভিব্যক্তি থেকে একথা নিশ্চিত বলা যায় যে, নাট‍্যকার সাঈম চৌধুরী তাঁর শৈল্পিক কল্পনা দিয়ে বাস্তবতার চিত্রায়নে যেমন সফল হয়েছেন তেমনি চরিত্রাভিনেতারাও তাদের সাবলীল পারফরম্যান্সের মাধ্যমে দর্শকদের প্রশংসা কুড়িয়েছেন।

একটি ডে কেয়ার সেন্টারের পাঁচজন বয়স্ক নারী-পুরুষের প্রতিদিনের বলা না বলা কথা, ক্ষণিক হাসি কিংবা কষ্টজনিত হাহুতাশ এবং চাওয়া পাওয়ার অব‍্যক্ত অনুভূতি। যা ডে কেয়ারের চার দেয়ালেই যেন আটকা পড়ে থাকে। নিয়ম করে হাউজিং অফিসার কিংবা স‍্যোশাল ওয়ার্কার আসেন এবং তাদের অভাব, অভিযোগ শোনার চেষ্টা করেন ঠিকই কিন্তু সেসব সমাধান দেখতে পাওয়া যায় না।

প্রতিদিন সকালে বাস এসে তাদের ডে কেয়ার সেন্টারে নিয়ে যায় আবার বিকেলে দিয়ে যায়। দিনের এই কয়েক ঘণ্টা তারা পরস্পরের সাথে গল্প করেন। হাস‍্যরসিকতাসহ গান, কবিতা পাঠের মাধ্যমে মনকে আনন্দ দেয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু দিন দিন মনের কোণে জমতে থাকে অনেক অভিমান ও অদৃশ‍্য অসুখ। তাদের কারো কারো কষ্টটা এমন পর্যায়ে পৌঁছায় যে তখন কেউ বলতে বাধ্য হন— “ঘর থেকে কবর ভালো!”

নাটকটির ১১টি চরিত্রের মধ্যে ৫টি চরিত্র ছিল মূলত প্রধান। পূর্ব লণ্ডনের বাসিন্দা, বাংলাদেশী অভিবাসী এই পাঁচ বয়স্ক ব্যক্তির শারিরীক, মানসিক ও বাসস্থান সম্পর্কিত সমস্যায় জর্জরিত জীবনালেখ‍্যের বাস্তবতা নিয়ে মূলত এই নাটক। এই পাঁচজনের একজন সিরাজুল ইসলামকে নাতির খেলনা রাখার জন্য তাঁর থাকার রুমের অনেক জায়গা ছেড়ে দিতে হয়। হাতপা কাঁপাসহ মূত্রনালির অসুখে আক্রান্ত আব্দুল জলিলের বাথরুমের জন্য উপর নিচ করতে করতে কাহিল অবস্থা। তাঁর উপর সন্তানের জ্বালাতন। কাফন দাফনের জন্য তিলে তিলে জমানো টাকাগুলোও ছেলে নিয়ে নিতে চায়। স্ট্রোকের পর এক পা অবশ হওয়া জাহানারা এবং মৌল বা শ‍্যাওলা, জংধরা ঘরে থেকে শ্বাসকষ্টে ভোগা আলেয়া বেগম ছাড়াও দেখতে সুঠাম, সুস্বাস্থ্যের অধিকারী এবং নিজেকে সুখী ও সম্পদশালী মানুষ হিসেবে পরিচিত করে তোলা জসিম উদ্দিন আসলে আইডেন্টিটি ডিসঅর্ডারে আক্রান্ত। এই পাঁচজনকে ঘিরেই মূলত নাটকটির প্রধান গল্প বা চরিত্র সাজানো হয়েছে। আর এই চরিত্রগুলোই যেন পূর্ব লণ্ডনের কোনো না কোনো বাঙালি পরিবারের নিঃসঙ্গ তথা দুখী মানুষের জীবনচিত্র হয়ে ফুটে উঠেছে।

নাটকটি শুরু হয় লিভিং রুমে দাদা সিরাজুল ইসলামের সাথে ছোট্ট শিশু আয়ানের খেলার মধ্য দিয়ে। মধ‍্যখানে ডে কেয়ার সেন্টারে প্রাত‍্যহিক যাতায়াত, সেখানে পারস্পরিক খুশগল্প, খুনসুটি, নামাজ কালাম এবং মাঝেমধ্যে আসা হাউজিং অফিসারের সাথে বাসস্থান সংক্রান্ত নানা বাকবিতণ্ডায়। তন্মধ্যে জসিম উদ্দিনের চরিত্রটি বেশ মনস্তাত্তিক। তাঁকে অন্যান্যদের মনে হয়, জগতের সুখী মানুষের একজন। তিনি সমস‍্যাক্রান্ত অন‍্যান‍্যদের বলতে থাকেন তাঁর বিশাল একটি বাড়ি রয়েছে, যেখানে ইচ্ছে করলে সবাই একসঙ্গে নিজেদের মতো করে থাকতে পারবেন একদিন সেখানে তাদের নিয়ে যাবেন। আর সেটি হচ্ছে, ওয়াইটচ‍্যাপেল থেকে আণ্ডারগ্রাউণ্ড ট্রেনে গুণে গুণে সাত স্টপ এবং তারপর মাত্র দশ মিনিট হাঁটা। আসলে স্ত্রী মারা যাওয়ার পর তিনি আইডেন্টিটি ডিসওর্ডারে ভুগছিলেন। সর্বশেষ তাঁরই সিংহভাগ অর্থে কেনা বাড়িতে স্থান সংকুলান সংকটের কারণে ছেলের বউয়ের ইচ্ছায় তাকে যখন কেয়ার হোমে যাবার সিদ্ধান্ত হয়। অতঃপর একদিন তিনি অন‍্যান‍্যদের নিয়ে সত্যিই নিরুদ্দেশ হয়ে যান।

ছোটগল্পের মতো নাটকটি আসলে এখানেই শেষ হতে পারতো। কিন্তু তাদের নিরুদ্দেশ নিয়ে স্বাভাবিকভাবেই স্বজনদের উদ্বেগ আর খোঁজাখুঁজি শুরু হয়। তাদের সঙ্গী না হওয়া আলেয়া বেগম শোনা কথাবার্তা, শলাপরামর্শ থেকে ক্লু দেওয়ার চেষ্টা করেন। তবে তাতেও বোঝা মুশকিল হয়ে পড়ে। “হোয়াইট‍চ‍্যাপেল থেকে দশ স্টপ তারপর ১০ মিনিট হাঁটা”! কিন্তু তা কোন দিকে, পূর্ব না পশ্চিমে, ডিস্ট্রিক্ট, হ‍্যামারস্মিথ এণ্ড সিটি নাকি এলিজাবেথ লাইন? অবশেষে নানা চিন্তাভাবনা করে তাদের বাকিংহাম প্যালেসের সামনে আবিষ্কার করা হয়। “এইতো আমার বাড়ি”, “এইতো আমার বাড়ি” বলতে বলতে মাটিতে লুটিয়ে পড়া মানসিকভাবে অসুস্থ জসিম সাহেবের অস্বাভাবিক আচরণে তার সঙ্গীরা থ বনে যান।

এই শেষ অংশটি কারো কারো কাছে অতিরিক্ত মনে হলেও আমার মনে হয়, এখানেও বিরাট একটা ম‍্যাসেজ রয়েছে। আর তা হচ্ছে— বৃটেন বা ইউরোপ, আমেরিকায় আসার পেছনে সবারই সেই সোনার হরিণ তথা অবচেতন মনে রাজকীয় জীবনযাপনের স্বপ্ন কাজ করে। কিন্তু সেই স্বপ্ন বিলাস পূর্ণতা লাভ দূরে থাক, কারো কারো ঠিকমতো মাথা গোঁজার ঠাঁই হয় না। ডে কেয়ার এবং কেয়ার হোমই হয় জীবনের শেষ ঠিকানা। নাট‍্যকার সাঈম চৌধুরী কল্পনার মননশীল মুন্সিয়ানায় হয়তো সেই চরম সত্যটিই ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করেছেন।

নাটকটির বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করেন— প্রধান পাঁচ চরিত্র যথাক্রমে: সিরাজুল ইসলাম চরিত্রে এবিএম নাজমুল হাসান, আব্দুল জলিল চরিত্রে জিয়াউর রহমান সাকলায়েন, জাহানারা বেগম মৌসুমী সামান্তা, আলোয়া বেগম চরিত্রে সোনিয়া সুলতানা, জসীম উদ্দীন চরিত্রে হুমায়ুন কবির মাহিন। এছাড়া মুকুল চরিত্রে ফজলে রাব্বি চৌধুরী, সামিয়া চরিত্রে এ‍্যানি পারভিন, ছোট্ট শিশু আয়ান চরিত্রে কাজী আয়ান তায়‍্যিব, হাউজিং এডভাইজার রাসেল আহমেদ চরিত্রে কাজী তারিফ তায়‍্যিব আহমেদ। বিভিন্ন পর্বে স্টোরি টেলারের ভূমিকায় ছিলেন নাজিম উদ্দিন। নাটকটি পরিচালনা করেন রাজীব দাস, সহকারী পরিচালক ছিলেন রুহুল আমিন এবং প্রোডাকশন ম‍্যানেজারের দায়িত্বে ছিলেন সৈয়দ আরিফুজ্জামান।

সামগ্রিক বিবেচনায় বলা যায়, নাটকটির পরিবেশনা এবং সবার অভিনয় ছিল চমৎকার ও সাবলীল। তবে বাবা আব্দুল জলিলের সাথে ছেলের কথোপকথন কিছুটা বিসদৃশ ঠেকেছে। কারণ, বাবা কথা বলছিলেন সিলেটের আঞ্চলিক ভাষায় আর ছেলে বলছিলেন ভিন্ন আঞ্চলিক ভাষা ও অ‍্যাকসেন্টে। যেটি বাবা ছেলের সম্পর্কের সাথে মিলে না। হয়তো হতে পারে যে, সেই চরিত্রের জন্য সেরকম অভিনয়ে দক্ষ কাউকে পাওয়া যায়নি। এমনটি লক্ষ্য করা গেছে, বিখ্যাত নাট‍্য ব‍্যক্তিত্ব শাকুর মজিদের বহুল আলোচিত আঞ্চলিক নাটক “লণ্ডনী কন‍্যা”র বেলায়ও। প্রধান দুই চরিত্রের মধ্যে তৌকির আহমদ ছিলেন লজিং থাকা শিক্ষক তাই তাঁর প্রমিত ভাষায় কথা বলায় সমস্যা নেই। কিন্তু শমী কায়সারের সিলেটী কথোপকথন পর্বে অ‍্যাকসেন্ট পুরোপুরি না এলেও অভিনয় গুণে তা উৎরে গিয়েছিল বলা যায়।
এছাড়া যেহেতু বিলেতের বাংলাদেশীদের নিয়ে বাংলা ভাষার নাটক সেহেতু কোনো বাংলা নামকরণই আরো যুতসই ও যথার্থ হতো বলে মনে হয়েছে।
তবে বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের আবাসন ও স্বাস্থ্যগত নানা সমস্যা জর্জরিত কথোপকথনের মধ্যেও তাদের মধ্যে বিভিন্ন কারণে পারস্পরিক হাস‍্যরসিকতা, কথার মধ্যখানে সিল্লক (সিলেটী আঞ্চলিক প্রবাদ বাক্য) বলা, গুরুগম্ভীর ভারী পরিবেশকে হালকা করায় সহায়ক ছিল। এ কারণেও নাট‍্যকারের মুন্সিয়ানার প্রশংসা করতে হয়। তবে নাটকটির ভালো ও পূর্ণ পর্যবেক্ষণ তুলে ধরতে পারবেন একজন অভিজ্ঞ নাট‍্য ক্রিটিক। একজন সাধারণ দর্শক হিসেবে নাটকটি আমার কাছে ভালোই লেগেছে।

নাটকটির অন‍্যতম মেসেজ বা শিক্ষণীয় বিষয় হলো— নতুন নতুন আবাসন হচ্ছে স্কাইক্রেপার বিল্ডিং উঠছে কিন্তু সেই হিসেবে সঠিক মানের আবাস্থল হচ্ছে না! বাণিজ্যিক ভবনগুলোতে যে অর্থ ব্যয় এবং মেইনটেন‍্যান্ট বা তদারকি সুবিধা থাকে সাধারণ নাগরিকদের বাসস্থানের ক্ষেত্রে তেমনটা করা হয় না। তাই জং ধরা দেয়াল আর স‍্যাতস‍্যাতে পরিবেশ থেকে স্বাস্থ্যহানী ঘটছে।
ছোট্ট ছেলে মেয়ে বাড়ি না ফিরলে তাদের জন্য কান্দার মানুষ থাকে কিন্তু বৃদ্ধবৃদ্ধাদের জন্য কেউ কাদার থাকে না! তাই নতুন প্রজন্ম তথা আমাদের সন্তানদের বৈষয়িকতা বোঝার পাশাপাশি হৃদয়জ তথা পারিবারিক বন্ধনের বিষয়টিও বোঝার চেষ্টা করা উচিত।

নাটকটির কাল্পনিক চরিত্রগুলোর সাথে বাস্তবতার যে যথেষ্ট মিল রয়েছে তা অস্বীকারের সুযোগ নেই। কারণ, এই কয়েক বছরেই বিরাটাকারে বদলে গেছে লণ্ডন কিন্তু সেই তুলনায় বাড়েনি পর্যাপ্ত বাসস্থান সুবিধা। অবকাঠামোগত উন্নয়নে লণ্ডন দিনে দিলে তিলোত্তমা হচ্ছে ঠিকই কিন্তু সেই অনুযায়ী নিম্ন বা মধ্যবিত্ত মানুষের চাহিদা পূরণে বাড়ে তাদের পছন্দ মাফিক বাসস্থানের।

শুধু লণ্ডনই নয় পৃথিবীর প্রায় সবকটি উন্নত শহরের একই অবস্থা। বিশ্বের পুঁজিবাজারের কেন্দ্রস্থল নিউ ইয়র্কের বাসিন্দারাও সুখে নেই। বিশেষ করে অভিবাসী সম্প্রদায়ের লোকজন। তাই ইতিহাস সৃষ্টিকারী নব নির্বাচিত মেয়র জোহরান মামদানির মুখে ছিল এফোর্ডেবল হোম, শিশু পরিচর্যা, ফ্রি বাস সার্ভিসসহ নিম্ন ও মধ্য আয়ের নাগরিকবান্ধব নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি।

পরিশেষে বলতে চাই, এই নাটকটি শুধুই পূর্ব লণ্ডনের বাংলাদেশী পরিবারগুলোর নানা সমস্যা চিত্রায়ণেই সীমাবদ্ধ থাকেনি। এটি হয়ে উঠেছে অনেকটা বিশ্বায়নেরও বার্তা। কারণ, বলতে গেলে শান্তি প্রায় কোথাও নেই, বিলেতের বৈভবপূর্ণ জীবনে কিংবা দেশে। গ্লোবাল সংস্কৃতিতে এখন প্রায় সব দেশই সমান। বিলেত কিংবা ইউরোপ আমেরিকায় যেমন কেয়ার হাউজ দেশেও তেমনি বাড়ছে বৃদ্ধাশ্রম কালচার!
জনসচেতনতা বৃদ্ধিতে নাটকটি বিশেষ ভূমিকা রাখবে বলে আমার দৃঢ় বিশ্বাস এবং এটির বহুল প্রচার হওয়া প্রয়োজন।

কাইয়ূম আবদুল্লাহ
লণ্ডন, ১০ নভেম্বর ‘২৫