খুলনায় চার খুন
পোস্ট ডেস্ক :

খুলনা শহর যেন শোকে স্তব্ধ। রাতে জিন্নাপাড়ার এক নিস্তব্ধ বাড়িতে রবিবার (১৬ নভেম্বর) যে দৃশ্য মানুষ দেখেছে- তা কোনো মা-বাবার সহ্য করার নয়। হাসপাতালে দুই নিষ্পাপ শিশু ও বাড়ির মুরগির খামারে তাদের নানির রক্তাক্ত নিথর দেহ। ঘরের বাইরে কান্নায় ভেঙে পড়া এক মা রুবিয়া বেগম।
তার সেই আর্তনাদ এখনো বাতাসে লেগে আছে ‘আমার বাচ্চাগুলা নাই- আমি আর এই দেশে থাকব না- আল্লাহ, তুমি আমায় এ কেমন পরীক্ষায় ফেললে?’
হাসির ঘরে আজ শুধু নিরবতা : সকাল ৮টায় দুই সন্তানকে নাস্তা খাইয়ে বাবা-মা বের হয়েছিলেন কর্মস্থলে। রাতে বাড়ি ফিরে পান মৃত্যুর নিরবতা-গেট বন্ধ। বাড়ির ভেতর অন্ধকার। ডাক দিলে কারো সাড়া নেই।
দেয়াল টপকে বাড়িতে ঢুকে শেফার আহমেদ দেখলেন- মুরগির খামারের মেঝেতে লুটিয়ে পড়ে আছে তিনজন মানুষ।
তার দুই আদরের সন্তান মোস্তাকিম (৮) ও ফাতিহা আহমেদ (৭)। সঙ্গে তাদের নানি সাহিদুন্নেছা (৫৫)। রক্তে ভেজা ছোট ছোট জামা-কাপড় দেখে তিনি ভেঙে পড়েন।
দুই সন্তানকে কোলে তুলে তিনি হাসপাতালের দিকে দৌড়ান। কিন্তু ডাক্তার শুধু মাথা নেড়ে বললেন, ‘আর নেই’। একথা শোনার পর শেফারের মুখে আর একটি শব্দ নেই। বাড়িতে স্ত্রী রুবিয়া বেগম শুধু আর্তনাদ করছিলেন- ‘আমার
দুই সন্তানকে কে মারল? আমার মা কী দোষ করেছিল? আমি এই দেশে আর বাঁচতে চাই না।’
মায়ের হৃদয়বিদারক স্বপ্নভঙ্গ : রুবিয়া বেগম বলেন, ‘আমার বাচ্চা দুটো আমাকে চাকরি ছেড়ে দিতে বলেছিল।
কিন্তু ওদের ভবিষ্যতের জন্য আমরা দুজনেই চাকরি করি। আমার মা তাদের দেখতো। আজ তিনজনই নাই। আমি আর কী নিয়ে বাঁচব?’ তার চোখের পানি পুরো পাড়ার মানুষকে কাঁদিয়েছে।
পাড়াজুড়ে শোক ‘এত নির্মম হতে পারে মানুষ?’ : শত শত মানুষ রাতেই জড়ো হন সেই বাড়িতে। কেউই চোখের পানি ধরে রাখতে পারেননি। এক প্রতিবেশী বলছিলেন- ‘দুইটা ফুলের মতো বাচ্চা। হাসি খুশি ছিল সবসময়। এমন নিষ্ঠুরতা আমি জীবনে দেখিনি।’ মোল্লাপাড়ার ইতিহাসে এমন ভয়াবহ ঘটনা এর আগে কখনো ঘটেনি। অনেকে বলছেন- হত্যাকারীরা নিশ্চয়ই কোনো পরিচিত ব্যক্তি। না হলে ফাঁকা বাড়িতে এত সময় কেউ কাটায় কীভাবে?
শিক্ষকের কণ্ঠ কাঁপছিল স্মৃতি বলতে গিয়ে : টুটপাড়ার হাবিব-লাইলি মাদরাসার সুপার ইয়াসির আরাফাত চোখ মুছতে মুছতে বললেন- ‘ওরা ক্লাসে খুব শান্ত ছিল। কী অপরাধ ছিল তাদের? কিভাবে সহ্য করবে এই শোক তাদের বাবা-মা?’
আরো একজনকে গুলি ও গলা কেটে হত্যা : শহরের অন্য প্রান্তে একই সন্ধ্যায় আরেকটি ঘরে কান্না। সোনাডাঙ্গা থানার করিমনগরে তিন মোটরসাইকেলে ছয় অস্ত্রধারী গিয়ে প্রথমে গুলি, তারপর গলা কেটে হত্যা করে আলাউদ্দিন মৃধা (৩৫) নামের একজনকে। তার স্ত্রী নার্গিস বেগম অশ্রুসিক্ত কণ্ঠে বলেন, ‘ও ভুল পথে ছিল, কিন্তু এখন ভালো হয়ে গেছিল। দিনমজুরি করত। ওরা তাকে আবার টানতে চাইছিল। না বলায় মেরে ফেললো।’
একই দিনে ৪ খুন, শোকের শহর খুলনা : এক দিনে চারটি লাশ। দুই শিশু, এক নানি, এক যুবক। ঘরের আলো নিভে গেছে তিনটি পরিবারে। খুলনার রাস্তায় মানুষ বলছে- ‘আমরা কি নিরাপদ?’
পুলিশের বক্তব্য : খুলনা মেট্রোপলিটন পুলিশ-কেএমপি’র অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার রাশিদুল ইসলাম খান জানান, ‘দুটো হত্যাকাণ্ড একই দিনে ঘটেছে, কিন্তু ঘটনা আলাদা। অপরাধীরা যারা তাদের শনাক্তে কাজ চলছে।’
কেএমপির উপ-পুলিশ কমিশনার (দক্ষিণ) সুদর্শন কুমার রায় বলেন, ‘এটি খুবই মর্মান্তিক। বিশেষ করে দুই শিশুর হত্যা। বিষয়টি আমরা সর্বোচ্চ গুরুত্বে তদন্ত করছি। দুই ঘটনায় চার হত্যার কারণ এখনো জানা যায়নি।’




