শেখ হাসিনার রায় : ভারত-বাংলাদেশ কূটনৈতিক পরীক্ষা
পোস্ট ডেস্ক :

বাংলাদেশে গত কয়েক ঘণ্টা ছিল অত্যন্ত ঘটনাবহুল। কারণ একটি আদালত দেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মৃত্যুদণ্ডের ঘোষণা দিয়েছেন। এই রায় ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের জন্যও একটি কূটনৈতিক পরীক্ষা। রায় ঘোষণার পর পরই অনলাইন বিবিসির খবরে এ কথা বলা হয়। এছাড়া বিদেশি সংবাদ মাধ্যমগুলো রায় ঘোষণার পরপরই রিপোর্টে এ খবর গুরুত্ব সহকারে প্রকাশ করেছে। বিবিসি আরও লিখেছে, আদালত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে মানবতাবিরোধী বিভিন্ন অপরাধে দোষী সাব্যস্ত করেছে। তার অনুপস্থিতিতেই বিচার করা হয়। কারণ ক্ষমতা থেকে অপসারিত হওয়ার পর থেকে তিনি ভারতে নির্বাসিত জীবনযাপন করছেন। তিনি সব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন এবং ট্রাইব্যুনালকে ‘ক্যাঙ্গারু কোর্ট’ বলে আখ্যা দিয়েছেন। এই রায় বাংলাদেশে এক গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তের জন্ম দিয়েছে।
কারণ ২০২৪ সালের বিক্ষোভ ছিল দীর্ঘদিনের দমনপীড়ন ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা সংকোচনের বিরুদ্ধে জমে থাকা ক্ষোভের বিস্ফোরণ- এমনটাই বিশ্লেষণ করেছেন বিবিসির গ্লোবাল অ্যাফেয়ার্স সংবাদদাতা অনবারাসান ইথিরাজন। এই রায় ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের জন্যও একটি কূটনৈতিক পরীক্ষা। কারণ জটিল ভূরাজনৈতিক পরিস্থিতির মধ্যে ঢাকা আনুষ্ঠানিকভাবে হাসিনার প্রত্যার্পণ চেয়েছে। কিন্তু ভারত এ পর্যন্ত এতে কোনো আগ্রহ দেখায়নি। কঠোর নিরাপত্তার মধ্যে রায় ঘোষণা করা হয় এবং রায় ঘোষণার সময় ঢাকায় হাসিনা-বিরোধী সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। ইয়েনি শাফাক তার খবরে লিখেছে, ঢাকার একটি ট্রাইব্যুনাল সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে।
গত বছরের সহিংস বিক্ষোভে ১৪০০ জনেরও বেশি মানুষের মৃত্যু হয়। এর পর তিনি ভারত পালিয়ে যান। পলাতক এ নেত্রীর বিরুদ্ধে আনা ঐতিহাসিক মামলার এ রায় বিচারিক প্রক্রিয়ার নাটকীয় সমাপ্তি টানে। এতে আরও বলা হয়, ঢাকার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বিচারপতি মো. গোলাম মর্তুজা মজুমদারের নেতৃত্বে গঠিত তিন সদস্যবিশিষ্ট বেঞ্চ হাসিনাকে গণ-আন্দোলনের সময় সংঘটিত নৃশংসতার ‘সুপিরিয়র কমান্ড রেসপনসিবিলিটি’ বা ঊর্ধ্বতন দায়ে দোষী সাব্যস্ত করেন। ৪৫৩ পৃষ্ঠার রায়ে আদালত উল্লেখ করেন যে, হাসিনা ছিলেন সব নৃশংসতার ‘সর্বোচ্চ নির্দেশদাতা’ এবং এসব অপরাধ তার ‘পূর্ণ জ্ঞানেই’ সংঘটিত হয়েছে। অর্থাৎ তিনি এসব দমনপীড়ন সম্পর্কে সচেতন ছিলেন এবং তা সহ্য করেছেন। পলাতক অবস্থায় থাকা সাবেক প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে এ মৃত্যুদণ্ডের রায় বাংলাদেশের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক ইতিহাসের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। প্রায় দেড় দশক দেশ শাসন করা হাসিনা এখন দেশের বাইরে অবস্থান করেই মৃত্যুদণ্ডের মুখোমুখি। এই রায় বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি ও আঞ্চলিক পরাশক্তিগুলোর সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্কের ওপর গুরুতর প্রভাব ফেলতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
চ্যানেল নিউজ এশিয়া লিখেছে, বাংলাদেশের একটি ট্রাইব্যুনাল গত বছরের সরকারবিরোধী বিক্ষোভে প্রাণঘাতী দমনপীড়নের অভিযোগে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে। মানবতাবিরোধী বিভিন্ন অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হওয়ায় এই রায় দেয়া হয়। হাসিনার বিরুদ্ধে বিচারটি অনুপস্থিতিতে অনুষ্ঠিত হয়। কারণ তিনি বর্তমানে ভারতে নির্বাসিত জীবনযাপন করছেন। দশকের মধ্যে কোনো সাবেক বাংলাদেশি প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে এটাই সবচেয়ে নাটকীয় ও গুরুত্বপূর্ণ আইনি পদক্ষেপ। আগামী ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় নির্বাচন হওয়ার কথা থাকায় রায়টি রাজনৈতিকভাবে আরও তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে উঠেছে। হাসিনার আওয়ামী লীগকে ইতিমধ্যেই নির্বাচনে অংশ নেয়া থেকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। ফলে আশঙ্কা করা হচ্ছে রায়টি নতুন অস্থিরতার জন্ম দিতে পারে।
ওদিকে ভারতের অনলাইন টেলিগ্রাফ লিখেছে, বাংলাদেশের অপসারিত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে মানবতাবিরোধী অপরাধে দোষী সাব্যস্ত করে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল (আইসিটি) গঠন করা হয়েছিল তার নিজের আওয়ামী লীগ সরকারের সময়। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় সংঘটিত অপরাধের বিচার করার উদ্দেশ্যে তিনি গঠন করেছিলেন এই আদালত। ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টের ছাত্র আন্দোলন দমনে অভিযুক্ত হয়ে শেখ হাসিনা ও তার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল- দু’জনকেই মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছে। সাবেক পুলিশপ্রধান চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল-মামুনকে দেয়া হয়েছে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড। হাসিনার মৃত্যুদণ্ড ঘোষণা করা হলে আদালতকক্ষে করতালিতে ফেটে পড়েন উপস্থিত মানুষরা। হাসিনা ও কামাল গত বছরের গণঅভ্যুত্থানের পর দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান। অনুপস্থিতিতেই তাদের বিচার হয়। হাসিনা ভারতে নির্বাসনে রয়েছেন। কামালের বর্তমান অবস্থান অজানা। সাবেক আইজিপি আল-মামুন আদালতে উপস্থিত ছিলেন। প্রায় তিন ঘণ্টা ধরে ট্রাইব্যুনালের প্রধান বিচারক মো. গোলাম মোরতুজা মজুমদার ৪৫৩ পৃষ্ঠার রায় পাঠ করেন, যা সরাসরি প্রচারিত হয় বিটিভিতে। মামুন রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষী হয়ে পুরো ঘটনার সম্পূর্ণ বিবরণ দিয়েছেন বলে জানা যায়। তিনি ট্রাইব্যুনালকে সঠিক সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে গুরুত্বপূর্ণ প্রমাণ দেয়ায় তাকে পাঁচ বছরের সাজা দেয়া হয়। টানা প্রায় এক মাস শুনানি শেষে ট্রাইব্যুনাল গত ২৩ অক্টোবর মামলার যুক্তিতর্ক শেষ করে। প্রায় ১০ হাজার পৃষ্ঠা সম্বলিত ১৪ খণ্ড নথি- যার মধ্যে স্থানীয়-আন্তর্জাতিক প্রতিবেদন, আহত-নিহতদের চিকিৎসা প্রতিবেদন, ময়নাতদন্ত, ব্যালিস্টিক রিপোর্ট, হাসিনা প্রশাসন বিদ্রোহ দমনে হেলিকপ্টার ব্যবহারের সময়সূচি, মিডিয়া ফুটেজ- সবই উপস্থাপন করা হয়। এ ছাড়া গুলির খোসা, রক্তমাখা কাপড়, হাসিনা ও অন্যান্য কর্মকর্তাদের ফোনালাপের প্রতিলিপি পর্যালোচনা করা হয়। চিকিৎসক, আন্দোলনকারী ও তদন্ত কর্মকর্তাসহ ৫৪ জন সাক্ষী আদালতে জবানবন্দি দেন। হাসিনার পুলিশের শীর্ষ কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথোপকথনের কিছু অংশ আদালতে রায় ঘোষণার সময় পড়ে শোনানো হয়।
এক সপ্তাহ ধরে রায়ের দিন ঘনিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলায় সহিংসতা বাড়তে থাকে। নিষিদ্ধ ঘোষণা করা আওয়ামী লীগ রায়ের প্রতিবাদে সারাদেশে হরতালের ডাক দিয়েছে। সোমবার সকালে রায় পড়া শুরুর আগেই আদালত এলাকার কাছে রাস্তায় একটি ছোট বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। ধানমন্ডিতে শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক বাড়ির ধ্বংসাবশেষের সামনে বিক্ষোভকারীরা জড়ো হয়। এই বাড়িটি গত বছর হাসিনা পালানোর পর বিক্ষোভকারীরা ভাঙচুর করে। সোমবার পুলিশ ও সেনাবাহিনী দুইটি এক্সকাভেটর নিয়ে যাওয়া বিক্ষোভকারীদের প্রতিহত করে। তারা বাড়িটির বাকি অংশ ভেঙে ফেলতে চেয়েছিল।১৯৭৫ সালে এ বাড়িতেই শেখ মুজিব ও তার পরিবারের সদস্যদের হত্যা করা হয়। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের প্রধান শেখ মোহাম্মদ সাজ্জাত বাহিনীকে নির্দেশ দেন, যদি কোনো গাড়িতে আগুন দেয়া হয় বা বোমা নিক্ষেপ করা হয়, তবে গুলি চালাতে।




